করোনায় শিক্ষাব্যবস্থা: বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক পেক্ষাপট
অলস বসে থেকে শিক্ষাজীবন দীর্ঘায়িত করা কাম্য নয়
- ড. জিএম সাদিকুল ইসলাম
- প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২০, ০৯:৫৬ PM , আপডেট: ২১ আগস্ট ২০২০, ১১:১৭ AM
১। দেশে করোনাভাইরাস প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। ডিসেম্বরে চীনে আত্মপ্রকাশ করার পর গণামধ্যমে ব্যাপক প্রচারে অভিভাবকদের মাঝে ভীতি তৈরি হওয়ায় ১৬ মার্চ হতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণার আগেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা হলত্যাগ করে নিজ বাসায় অবস্থান করতে থাকে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো হতে বিরত থাকেন। জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ঘরে পাঠিয়ে প্রাথমিক সংক্রমণ কমাতে পারলাম।
এরপর কয়েক দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বর্ধিত করে সর্বশেষ ৩১ আগষ্ট পর্য্ন্ত নির্ধারন করা হয়েছে। নতুন এই ভাইরাসের গতিবিধি ও সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সরকারি সিদ্ধান্তে সময়ের সাথে পরিবর্তন এসেছে। প্রথমদিকে সরকারি অফিসে সর্বোচ্চে ২৫ শতাংশ উপস্থিতির নির্দেশনা থাকলেও সর্বশেষ গত ২৯ জুলাই জারিকৃত প্রজ্ঞাপন মোতাবেক শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
সময়ের সাথে মানুষ সচেনত হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে কিন্তু একইসাথে জীবিকার তাগিদে বাইরে যেতে হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের মানুষের জীবনযাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসছে যদিও করোনা সংক্রমন কোন পর্যায়ে তা বলা কঠিন।
২। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা কার্য্ক্রম বিগত পাঁচ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। প্রথম এক-দেড় মাস চলে গেছে নতুন পরিস্থিতি বুঝে উঠতে। তারপর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বাইরের দেশের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে অনলাইনে ক্লাস পরিচালনার চেষ্টা করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা পরীক্ষামূলক পর্যায়েই থেমে গেছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিকট হতে মতামত জরিপ করে।
চুয়েটের মত অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের মতামত জরিপ করে। এসব জরিপ হতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে চলে আসে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষকদের তখনও প্রয়োজনীয় কম্পিউটার, ইন্টারনেট ও অন্যান্য আনুসাঙ্গিক সুবিধা প্রদান করতে পারেনি বলে শিক্ষকদের মতামত জরিপে উঠে আসে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের একটি বড় অংশ হল দরিদ্র-মধ্যবিত্ত মেধাবীরা।
চুয়েট জরিপে উঠে আসে প্রায় ৫% শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস করার জন্য কোন প্রকার কম্পিউটার, ট্যাব, স্মার্টফোন নাই। কমবেশি সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একই অবস্থা; এই শিক্ষার্থীদের অনেকে টিউশন করে দিনে একবেলা-দুবেলা খেয়ে পরিবারকে টাকা পাঠায় ও নিজে পড়ালেখা করে। এ ধরনের ইলেক্ট্রোনিক্স সামগ্রী তাদের কাছে নিতান্তই বিলাসিতা। জরিপে আরও উঠে আসে প্রায় ২০% শিক্ষার্থীর অনলাইন ক্লাস করার জন্য প্রয়োজনীয় মোবাইল ডাটা কেনার একবারেই সামর্থ নাই এবং ৫৫% শতাংশের জন্য তা কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে।
এমতাবস্থায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন হতে প্রায় একইভাবে বলা হয়েছিল যে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সহজ শর্তে ডিভাইস কেনার জন্য লোন দেওয়া প্রয়োজন। একই সাথে মোবাইল অপারেটরদের সাথে সরকারি উদ্দ্যোগে ক্লাস করার জন্য বিনামূল্যে বা সীমিত ব্যায়ে ডাটা সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনলাইন ক্লাস কার্য্ক্রম পরীক্ষামূলক পর্যায়ে থমকে যাওয়ার মূল কারণ এখানেই। আবার অপেক্ষাকৃত বেশী বয়সী ও সমর্থবান শিক্ষার্থীদের আমরা প্রকৌশলে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অনলাইন পাঠদান সুষ্ঠভাবে করতে পারছি।
৩। সপ্তাহ দুয়েক আগে অনলাইনে আমেরিকার নামকরা পুরকৌশলের অধ্যাপকদের সাথে তিন দিনব্যাপী একটি কর্মশালায় যোগদান করি। আমার বৃটিশ ও জাপানী অধ্যাপক (সুপারভাইজার) ও অন্যান্য সহকর্মীদের সাথেও করোনাকালীন বিভিন্ন বিষয়ে আলাপচারিতা হয়। একটি বিষয় পরিষ্কার যে দুনিয়ার সব শিক্ষকই মনে করেন যে ক্লাসরুম শিক্ষাদানের কোন বিকল্প নাই। কিন্তু শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকাল যাতে অযাচিত দীর্ঘায়িত না হয় তাই তারা শ্রেনীকক্ষ বন্ধের এক সপ্তাহের মধ্যে অনলাইনে পাঠদান-পরীক্ষা সবই চালু করেছে।
বাংলাদেশের মত সেখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ডিভাইস বা ডাটা সমস্যা না থাকায় ও প্রায় সকল শিক্ষকদেরই অনলাইনে কোন না কোনভাবে শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা থাকায় ব্যাপারটিতে তারা সহজে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। মূল্যায়নের জন্য তারা পরীক্ষায় উপর চাপ না দিয়ে Assisnment এর উপর গুরুত্বআরোপ করেছ। পরীক্ষার পুরোটা সময় অনলাইনে থেকে ভিডিও ক্যামেরা চালু রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাতে প্রত্যবেক্ষক তাকে সার্বক্ষণিক নজর রাখতে পারেন।
পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থী নিজের পরীক্ষার খাতা scan করে নিজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট আইটি স্টোরেজে রেখে তবেই ভিডিও অফ করতে পারবেন। এসব আমাদের দেশে চালু হওয়া এ মুহুর্তে অসম্ভব ও এখনও অনেক সময়ের ব্যাপার; সকলের বাসায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট নাই আবার যে কোন মুহুর্তে বিদ্যুৎ চলে যেতে পারে।
৪। Oregon State University এর পুরকৌশলের অধ্যাপক Jeson Ideker জানান, তারা আগামী সেমিস্টার হতে আমেরিকার প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ই হাইব্রিড পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের পরিকল্পনা করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও গ্রহনের আসল মজাটা দেওয়ার জন্য। সামজিক দুরত্ব বজায় রেখে ৫০ জনের নিচে শিক্ষার্থীদের নিয়ে শ্রেনীকক্ষে পাঠদান করা যাবে। যে সকল রক্লাসে আকার তার থেকে বড় সে সকল শিক্ষকদের বাধ্যাতামূলক অনলাইনে পাঠদান করতে বলা হয়েছে। বিকল্প হিসেবে যে সকল শিক্ষার্থী অনলাইনে যোগ দিতে চায় তাদের জন্য অনলাইন অপশন রেখে বাকীদের নিয়ে ক্লাসরুম শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তাই পাঠদান একই সাথে ক্লাসরুমে সরাসরি ও তা অনলাইনে প্রচারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ল্যাবরেটরি ক্লাসের ক্ষেত্রে একবারে স্বাভাবিক সময়ের ধারনক্ষমতার ১/৩ বা ১/২ শিক্ষার্থী ল্যাবে প্রবেশ করাতে বলা হয়েছে। বাকীরা এদের পরীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য দিয়ে রিপোর্ট লিখবে। পরের সপ্তাহে হয়ত অন্য অংশ পরীক্ষা করবে ও অন্যরা তাদের ফলাফল ব্যবহার করবে। তাছাড়া ল্যাবরেটরি হতেও ভিডিও প্রচার করার ব্যবস্থা রাখার বলা হয়েছে।
৫। আমরা যেহেতু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ মুহুর্তে সম্পূর্ণ অনলাইন নির্ভর শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারছি না, তাই হাইব্রিড পদ্ধতির দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দরকার নিজস্ব ব্যবস্থাপনা। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো সমাপনী বর্ষের শিক্ষার্থীরা। বিগত পাঁচ মাস শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকলে তাদের প্রায় সকলেই আজ চাকরির বাজারে প্রবেশ করত। দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারত, কেউবা উচ্চশিক্ষা শুরু করত। অনেকের পরিবার তার শিক্ষাজীবন শেষ হওয়া ও একটা চাকরির পথ চেয়ে আছে।
অভিভাবক মানেই সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হবেন। নীতি নির্ধারন সেভাবেই হতে হবে যাতে তারা মনে জোর পান। ইতিপূর্বে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ত্রৈমাসিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অভিভাবকদের হতে দিয়ে বাসায় পরীক্ষা গ্রহন করার সিদ্ধান্ত ইতিবাচক ছিল। কারণ এই শিশুরা স্কুলে আসলে অসতর্ক হয়ে সংক্রামিত হতে বা করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্বের শিক্ষার্থীদের (বিশেষকরে শেষ বর্ষের) নিকট হতে আমরা পরিণত আচরন আশা কারতে পারি। তারপরও যেহেতু আমরা জানি না একবারে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিলে কি হতে পারে তাই পর্যায়ক্রমে খোলার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা যেতে পারে।
সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস এখন পুরোদমে খোলা। শিক্ষা কার্যক্রম ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বন্ধ রাখতে নির্দেশনা দেওয়া আছে। সে মোতাবেক ১ সেপ্টেম্বর হতে শুধু সমাপনী বর্ষের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সীমিত পরিসরে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে। তাদের প্রায় সকলেরই হলে সিট থাকায় ও শুধু একটি বর্ষের শিক্ষা কার্যক্রম (পরীক্ষা/ক্লাস) চললে সামাজিক দুরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানা সোজা হবে। ৩/৪ সপ্তাহ চলার পর পরিস্থিতি বুঝে ৩য় বর্ষ্ ও তারপর বিরতি দিয়ে ২য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের আনা যেতে পারে। ক্লাসরুমগুলো সামান্য যন্ত্রাংশ দিয়ে উন্নত করলে যারা অনলাইনে বাসা থেকে ক্লাস করতে চায় তাদের ছাড় দেওয়া যেতে পারে।
এ সবের জন্য কর্মপরিকল্পনা করার লক্ষ্যে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন হতে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা দরকার। কিন্তু এভাবে অলস বসে থেকে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন দীর্ঘায়িত করা কাম্য নয়। বর্হিবিশ্বের সকলে এগিয়ে যাচ্ছে; আমাদের তার সাথে তাল মিলাতে হবে দেশে প্রেক্ষাপট ও সামর্থ নিয়ে।
লেখক: অধ্যাপক, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)