ভারত ও নেপাল সীমান্ত বিরোধের প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ
- মোঃ ফাহাদ হোসেন হৃদয়
- প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২০, ১০:১৮ AM , আপডেট: ১৯ জুন ২০২০, ১০:১৮ AM
সম্প্রতি নেপাল সংসদের নিন্মকক্ষের মোট ২৭৫ জন সদস্যের মধ্যে ২৫৮ জনের ভোটে পাশ হয় নেপালের মানচিত্র সংক্রান্ত ঐতিহাসিক সংবিধান সংশোধন বিল। সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ভোট পড়ে সংবিধান সংশোধনের পক্ষে। অন্যদিকে সংবিধান সংশোধনের বিলের বিপক্ষে ভোট দেয়নি কোন সাংসদ। বিরোধী দলগুলোও সরকারের সংবিধান সংশোধন বিলে সমর্থন প্রদান করে নেপালের সংসদীয় ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনা করেছে ।
নেপালের হঠাৎ মানচিত্র সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনের প্রধান কারণ প্রতিবেশী ভারতের সাথে বেশকিছু সীমান্ত এলাকা নিয়ে বিরোধ। নতুন মানচিত্রে ভারতের সাথে বিরোধপূর্ণ লিপুলেখ পাস, লিম্পিয়াধুরা ও কালাপানি এলাকাকে নিজেদের এলাকা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে নেপাল। বার্তা সংস্থা রর্য়টাসের মতে, বিগত কয়েক দশক যাবত এসকল এলাকা নিয়ে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিরোধ চলছে। ক্ষুদ্র প্রতিবেশী নেপালের এমন সিদ্ধান্ত রীতিমতো হতবাক করেছে মোদি সরকারকে।
গত ৮ মে, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চীনের তিব্বত সীমান্তের লিপুলেখের সাথে সংযোগকারী ৮০ কিলোমিটার লম্বা সড়ক উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের সাথে সাথে নেপাল এর প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু ভারত সরকার তাৎক্ষণিকভাবে নেপালের প্রতিবাদকে কর্ণপাত করেনি। নেপালের দাবী, সড়কটি যে এলাকা দিয়ে গিয়েছে সেটি নেপালের নিজস্ব ভূখন্ড। ভারতের এমন কর্মকান্ড নেপালের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ করা। সরকারের পাশাপাশি গোটা নেপাল জুড়ে ভারত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। সাধারণ নেপালিরা রাস্তায় নেমে ভারতের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ প্রদর্শন করে। নেপাল সরকারে হঠাৎ সংবিধান সংশোধন করে বিরোধপূর্ণ এলাকাগুলোকে নিজেদের বলে ঘোষণা করে। কিন্তু এ সীমান্ত বিরোধের প্রেক্ষাপট কি শুধু এ ৮০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ? নাকি দীর্ঘদিনের জমা ক্ষোভ ও জাতীয়তাবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ?
নেপাল ও ভারতের বর্তমান সীমান্ত রেখা ইতিহাস অনেক পুরোনো। দুই দেশের মধ্যে রয়েছে বিশাল উন্মুক্ত সীমান্তরেখা, যেখানে অধিকাংশ স্থানেই কোন কাঁটাতারের বেড়া নেই। ১৮১৬ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও নেপালের মধ্যে সুগাউলি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তি অনুযায়ী, মহাকালি নামক নদী দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত রেখা হিসেবে বিবেচিত হবে। উভয়ই মহাকালি নদীকে নিজেদের সীমান্ত রেখা হিসেবে বিবেচনা করে । কিন্তু তাহলে সীমান্ত নিয়ে আসলে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিরোধ কোথায়?
ভারত ও নেপালের মধ্যে মহাকালি নদীর উৎস নিয়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্ব। নেপালের মতে, মহাকালি নদীর উৎপত্তি হয়েছে লিমপিয়াধুরা এলাকায়। সে এলাকাটি লিপুলেখ থেকে পশ্চিমে অবস্থিত। ফলে নেপালের দাবী, লিমপিয়াধুরা, লিপুলেখ ও কালাপানি এলাকা তাদের ভূখন্ডের অংশ ।
অন্যদিকে ভারতের দাবী, মহাকালি নদী লিপুলেখ এলাকায় উৎপত্তি হয়েছে। এর বিপরীতে নেপালের মতামত, ভারত যে নদীকে মহাকালি নদী বলছে, তা হচ্ছে মহাকালি নদীর একটি উপনদী। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ভারত বিরোধপূর্ণ এলাকাগুলোতে নিজেদের সেনা চৌকি স্হাপন করে। তখন থেকে নেপাল ও ভারতের মধ্যে সীমন্তবিরোধের বীজবপন হয়।
নেপাল ও ভারত দুই প্রতিবেশী এবং তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান শতবছর ধরে। স্থলবেষ্টিত দেশ হওয়ায় নেপালের পণ্য আমদানি ও রপ্তানি সিংহভাগই ভারতের ভূখন্ড ব্যবহার করে হয়ে আসছে। অন্যদিকে ভারতীয় আর্মিতে কর্মরত আছে ২০ ব্যাটেলিয়ন গুর্খা( নেপালের অধিবাসী জনগোষ্ঠী) সৈন্য। কিন্তু, ২০১৫ সালে ভারত কতৃক অঘোষিত সীমান্ত অবরোধ মোড় ঘুরিয়ে দেয় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক। নেপালের নতুন সংবিধান প্রনয়নে মোদি সরকারের সাথে সৃষ্ট বিরোধ জন্ম দেয় অঘোষিত এ সীমান্ত অবরোধ।
কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে সে অবরোধে ভারতের কোন লাভ হয়নি। নেপালের আরেক প্রতিবেশী চীন সে সুযোগে নেপালে পণ্য রপ্তানি মাধ্যমে অবরোধের সময় নেপালিদের জীবন রক্ষা করে পাকাপোক্ত ভাবে নেপালে তাদের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান বৃদ্ধি করে। তখন থেকেই নেপালের সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারত বিরোধী মনোভাব জেগে ওঠে। জমতে শুরু করে ভারত বিরোধী মনোভাব ও ক্ষোভ। যার চূড়ান্ত ফলাফল, বর্তমান সংবিধান সংশোধন বিল।
২০১৫ সালের অবরোধের পর থেকে নেপাল তাদের ভারত নির্ভরতা অনেকখানি কমিয়ে আনতে চেষ্টা করেছে। নতুন মিত্র চীনের সাথে কূটনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছে বিগত কয়েক দশকের তুলনায় বহুগুণ। ফলে, ভারতে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে চীন-নেপাল সম্পর্ক বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বর্তমানে, চীনের সাথে ভারতের লাদাখ সীমান্তে সংঘর্ষ চলছে। একই সময়ে নেপালের সাথে সামরিক ও অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার ফল ভারতের জন্য কল্যাণকর বয়ে আনবে না। এ সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে চাইবে, ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান। কাশ্মীর ইস্যুতে এখনো দুই দেশের সীমান্তে বিশাল সামরিক শক্তি মোতায়েন রয়েছে। এতে করে, ভারতের সামনে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল চ্যালেন্জ। যেকোনো পক্ষের হটকারি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দিতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পটভূমি।
অন্যদিকে, যদি ভারত ও নেপাল দ্বিপাক্ষিক আলোচনা মাধ্যমে নিজেদের সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করে তবে দুই দেশের মধ্যে সৃষ্ট টানাপোড়ন অনেকখানি হ্রাস পাবে। সামরিক শক্তি কিংবা অর্থনৈতিক অবরোধ কখনোই কোন সমস্যার সমাধান হতে পারে না। ভারত ও নেপালের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কিন্তু ভুল কূটনৈতিক নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে এ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যেনো শত্রুতে পরিণত না হয়; সে দিক বিবেচনা করতে হবে উভয়কেই। ২০১৫ সালের একটি ভুল কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত বদলে দিয়েছিলো, নেপাল ও ভারতের পারষ্পরিক সম্পর্কের গতিধারা।
করোনা বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়াতে ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতিদিন। অর্থনীতির গতি হ্রাস পেয়েছে গতবছরের তুলনায়। ফলে, এ পরিস্থিতিতে শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানে লক্ষ্যে আলোচনার কোন বিকল্প নেই।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।