তওবা করলে আল্লাহ পাপকে নেকি দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন

ডক্টর তুহিন মালিক
ডক্টর তুহিন মালিক

আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করলেন। শয়তান আদমকে সিজদা না করে আল্লাহর নির্দেশকে অমান্য করলো। শয়তান আল্লাহর দরবার থেকে বহিষ্কৃত হলো। এরপর শয়তান মানুষের কাছ থেকে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য কসম খেলো। প্রতিজ্ঞা করলো। সে মানুষকে তার নিজের মতই পথভ্রষ্ট করে ছাড়বে। তার মত জাহান্নামী বানাবে।

আল্লাহ যখন শয়তানকে জান্নাত থেকে বের করে দিলেন। শয়তান তখন মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য পূনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আল্লাহর কাছে চারটি বিশেষ ক্ষমতা চাইলো।
১. শয়তানকে কিয়ামত পর্যন্ত হায়াত দিতে হবে।
২. তার রিযিকের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. তাকে লোক চক্ষুর আড়ালে রাখতে হবে।
৪. সে যেন মানুষের দেহের শিরায় শিরায় রক্তের চলাচলের সাথে চলতে পারে।

আল্লাহ শয়তানের এ চারটি প্রার্থনাই মন্জুর করলেন।

শয়তান আল্লাহ তা’য়ালাকে বললো। ‘আপনি আমাকে যেমন উদভ্রান্ত করেছেন। আমিও অবশ্য তাদের জন্যে আপনার সকল পথে বসে থাকবো। অতঃপর তাদের কাছে আসবো তাদের সামনের দিক থেকে। পেছন দিক থেকে। ডান দিক থেকে। এবং বাম দিক থেকে। আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না’ (সূরা আ’রাফ: ১৬ - ১৭)।

শয়তান যখন মানুষের ওপর চারদিক থেকে হামলা চালানোর বা ফাঁদ পাতার কসম খেলো। ‘তখন ফেরেশতারা বললেন, হে পরওয়ারদেগার! তাহলে মানুষ কিভাবে রক্ষা পাবে? শয়তানের হাত থেকে কিভাবে পালাবে? আল্লাহ বললেন, উপর ও নীচ থেকে দুটি পথ খোলা রয়েছে। মানুষ যখনই আল্লাহর সাহায্যের জন্য উপরের দিকে দোয়ার হাত উঠাবে অথবা মাটিতে কপাল ঠেকাবে তখন তারা শয়তানের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা পাবে।’

আল্লাহু আকবার! শয়তান মানুষের সামনে পেছনে। ডানে বামে। চতুর্পাশ্ব দিয়ে ক্ষতি করার ক্ষমতা চাইলো। আর আল্লাহ তাকে এ ক্ষমতা দিয়েও দিলেন। কিন্তু আল্লাহ গাফুরুর রাহীম মানুষকে ক্ষমার সুপ্রিম ক্ষমতা রেখে দিলেন। উপর ও নীচ থেকে দুটি পথ খোলা রেখে দিলেন। গ্যারান্টি দিয়ে বললেন। বান্দার গুনাহর পরিমান সমুদ্রের ফেনা রাশির সমান হলেও। বান্দা নিজের ভুল বুঝতে পেরে পাপের অনুশোচনা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া মাত্রই, আল্লাহ তার সব গুনাহ মাফ করে দিবেন।

আর এদিকে শয়তানের চ্যালেঞ্জ। সে কোনভাবেই মানুষকে তওবা করতে দিবে না। মানুষের মনে নানান আবোল তাবোল সন্দেহ তৈরি করে রাখে। এই করছি করছি করে। সময় পার করে দিয়ে। মানুষকে তওবা বিহীন অবস্থায়। তার সাথে জাহান্নামে নিয়ে যাবে।

তাই আমরা অনেকে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগি। আসলেই কি আমাদের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে? উত্তরে আল্লাহ বলেন, ‘বলে দাও, হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের উপর অবিচার করেছো। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না’ (সূরা যুমার: ৫৩)। ‘তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল।’ (সূরা নুহ: ১০)।

আসলেই কি আমাদের সব গুনাহই মাফ হয়ে যাবে? আল্লাহ বলেন, ‘তিনি আমাদের পাপকে নিশ্চিহ্ন করে দিবেন! (সূরা আনফাল:২৯)।

আবারও যদি পাপ করি, তাহলে? আল্লাহ বলেন, ‘তিনি বারবার ক্ষমা করেন, তিনি নিরন্তর দয়ালু’ (সূরা বাকারাহ: ৫৪)।

তাহলে কিভাবে ক্ষমা পাবো? আল্লাহ বলেন, ‘বিশুদ্ধচিত্তে তাওবা করলে আল্লাহ পাপ মাফ করে দিবেন এবং জান্নাতে প্রবেশ করাবেন’ (সূরা তাহরীম:৮)। অর্থাৎ আল্লাহ সকল গোনাহই ক্ষমা করে দিবেন, তওবার শর্তে।

আর যদি মাফ চেয়ে নেই, তাহলে? আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ অজ্ঞতাবশত: যদি মন্দ কার্য করে। অতঃপর তাওবা করে এবং সংশোধন করে নেয়। তবে তো আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (সূরা আন’আম:৫৪)

তওবায় কি আর কোন লাভ আছে? আল্লাহ শুধু ক্ষমাই করেন না। বরং ‘কেউ তওবা করলে, ঈমান আনলে এবং সৎকর্ম করলে। আল্লাহ তাদের পাপরাশিকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তিত করে দেবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (সূরা ফুরকান: ৬৮-৭০)

অথচ আল্লাহর এতো প্রতিশ্রুতির পরও, শয়তান আমাদের শুধু ধোঁকা দিতেই থাকে। ‘থাক, কি আর বয়স হয়েছে। এখন না হয় একটু গুনাহ করে নেই। পরে না হয় তওবা করে নিবো’। আর এভাবেই শয়তান আমাদের রক্তের শিরা উপশিরায় ঢুকে আমাদের তওবা করার ইচ্ছাশক্তিকে দুর্বল করে ফেলে। গুনাহকে সহজ স্বাভাবিক করে দেয়। ধীরে ধীরে গুনাহ করার আকাঙ্ক্ষাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে কমিয়ে দেয় তওবা করার সব ইচ্ছাকে।

একসময় আর তওবা করার কোন ইচ্ছাই থাকে না। আর আমরা রমজান কিংবা শবে ক্বদরে বা বিশেষ কোন দিনে তওবা করলেও। সেটাও তখন করি একেবারে দায়সারা ভাবে। অর্থ্যাৎ তওবা করি ঠিকই। তবে মুখে মুখে। যার মধ্যে কোন অনুশোচনা নাই। জাষ্ট মুখস্ত পড়ি। ঠোঁট নাড়ি। একদিকে জাস্ট মুখে মুখে তওবা। অন্যদিকে ভেতরে ভেতরে ঠিকই গুনাহ করার ধান্দায় থাকি।

অনেকে আবার ইচ্ছামত গুনাহ করতেই থাকি। ভাবি- ‘আরে, আল্লাহ তো ক্ষমা করে দেবেনই।’ অথচ আল্লাহর দেয়া বিধি-নিষেধের কোনো তোয়াক্কাই করি না। আর এভাবেই কিছু লোক আল্লাহর ক্ষমার অভিলাষ করলেও শেষ পর্যন্ত তওবা না করেই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাই!

আমরা হয়তো বুঝিই না, তওবা কি? আসলে তওবা হচ্ছে রিটার্ন বা গুনাহ থেকে প্রত্যাবর্তন। ধরুন। আপনি জোড়ে দৌড়াচ্ছেন। কিন্তু সামনে বিশাল গর্ত। নিশ্চিত মৃত্যু। এই মুহুর্তে কেউ আপনাকে বিপদ থেকে ফিরে আসতে বললো। আপনি ভুল বুঝে ফিরে আসলে, সেটা তখন রিটার্ন বা প্রত্যাবর্তন বা তওবা। আর কোন পাত্তা না দিয়ে মুখে মুখে ফিরবেন বলে ফিরে আসলেন না। সেটা তখন প্রত্যাবর্তন বা তওবা নয়।

আমরা যদি আসলেই আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই। তাহলে মনের মধ্যে তীব্র অনুশোচনা আনি। লজ্জিত হই। দৃঢ প্রতিজ্ঞা করি। আর কখনই গুনাহ করবো না। আজ থেকে ফুলস্টপ। সোজা রিটার্ন। নিজেকে কঠিনতম বিপদসংকুল মনে করি। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাই। আল্লাহর সাথে নিরিবিলি কথা বলি। কান্নাকাটি করি। চোখে অশ্রু আনি। মনটা পাথর হয়ে গেলেও কান্নার চেষ্টা করি। আরবী না জানলে। কিংবা দোয়ায় কি বলছি, সেটা না বুঝলে। নিজের ভাষাতেই আল্লাহর সাথে কথা বলি। ক্ষমা চাই। চাইতেই থাকি। আন্তরিকতার সাথে নিজের সব অপরাধগুলো স্বীকার করে নেই। আল্লাহর সামনে কোনো অজুহাত বা ইগো বা পার্সোনালিটি না দেখাই। নিজেকে পাপী মনে করি। অসহায় মনে করি। বিপর্যস্ত মনে করি। আর যেকোন মূল্যে নাছোড় বান্দার মতো কান্নাকাটি করে ক্ষমা চাইতেই থাকি। চাইতেই থাকি।

ইনশাআল্লাহ, আল্লাহর রহমতের সাগরে দয়ার জোয়ার বয়ে যাবে। কারন আল্লাহ ক্ষমাশীল। আল্লাহ ক্ষমা করতেই পছন্দ করেন। আর আল্লাহ তো সর্বদাই অপেক্ষমাণ আমাদের তওবা মন্জুর করার জন্য। আর আল্লাহর চেয়ে শ্রেষ্ঠতম ক্ষমাশীল আর কে আছেন? [ফেসবুক থেকে সংগৃহীত]


সর্বশেষ সংবাদ