শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

  © ফাইল ফটো

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ রয়েছে গত এক মাসের বেশি সময় ধরে। রপ্তানিমুখী কিছু শিল্প কারখানা চালু হওয়াতে লকডাউন পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল হয়ে গেলেও এখনও এ পরিস্থিতি থেকে স্বাভাবিক সময়টা আমাদের থেকে কতটা দূরে আছে তা কোনভাবেই অনুমান করা যাচ্ছে না। তাই এখনও প্রায় অনেককেই বাসায় বসে থেকে বিষন্ন এ দিনগুলো গুনতে হচ্ছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষগুলোকে। এদিকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা মানুষের সংখ্যা এক মাসেই প্রায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩০ শতাংশেরও বেশি হয়ে গেছে। তাই দেখা যাচ্ছে, এ করোনা মহামারীতে নিম্ন আয়ের মানুষগুলোকে স্বাস্থ্য এবং অর্থ দুটিরই সংকটময় সময় পার করতে হচ্ছে।

গত ২৬ এপ্রিল থেকে রপ্তানিমুখী কিছু কারখানা চালুর কারণে অনেক শ্রমিক কর্মস্থলে যোগ দেয়ার জন্য গ্রাম থেকে শহরে এসেছে এবং আসছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও চাকরি বাঁচানোর স্বার্থে পণ্যবাহী ট্রাক, মাইক্রোবাস কিংবা রিক্সা-ভ্যানেও ২/৩ গুণ ভাড়া মিটিয়ে খুব হয়রানি হয়ে আসতে হয়েছে কর্মজীবী এসব সাধারণ মানুষকে। এতে বিভিন্ন এলাকায় লকডাউন অব্যাহত থাকলেও সেগুলো বাস্তবায়নে যথাযথ প্রয়োজনের অভাবে বেশিরভাগ এলাকায় তা নামে মাত্র লকডাউন ছিল।

এভাবে দেশের আইন না মেনে কর্মস্থলে আসাতে আমরা তাদেরকে অসচেতনতার চোখে দেখলেও জীবিকা রক্ষার স্বার্থে সচেতনতা খুব একটা বড় ব্যাপার নয় তাদের কাছে। জীবিকার স্বার্থে তাদের সচেতনতার অভাব যেমন ছিল তেমনি যার যার অবস্থানে থাকার জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে এবং নিজ অবস্থানে থাকার আশ্বাস দিতে পারিনি আমরা। ফলে অনেকেই এ ছুটিতে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়েছিল।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে কারখানা চালুর কথা বললেও, জনবহুল এ কারখানা গুলোতে স্বাস্থ্য বিধি মেনে কাজ করা খুবই কঠিন। কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ এখনও বেড়েই যাচ্ছে। সংক্রমণ ঠেকানো এখনও যেহেতু জরুরী তাই খুব ভালভাবেই খোঁজ রাখতে হবে যে কারখানাগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে কাজ চলছে কিনা এবং সীমিত আকারে শ্রমিক নিয়ে কাজ চললেও বাকি শ্রমিকদের চাকরি এবং মজুরীর নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে কিনা। বিশেষ করে গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে।

নির্দিষ্ট সময়ে শত শত মানুষ একসাথে অফিসে প্রবেশের ফলে এত মানুষের চাপের মধ্যে দুরত্ব বজায় রেখে সবার শরীরের তাপমাত্র পরীক্ষা করে, হাত ধোঁয়ার ব্যবস্থা করে তারপর আবার দুরত্ব বজায় রেখে কাজ করা যেকোন কারখানার জন্য খুবই চ্যালেঞ্জের। যেসব শ্রমিকের বাসা অফিস থেকে দূরে, গণপরিবহন বন্ধ থাকার কারণে তাদেরকে দ্বিগুন ভাড়া দিয়ে ভ্যান কিংবা অটো রিক্সায় খুব চাপাচাপি বসে অফিসে আসতে হচ্ছে। এত মানুষের ভীড়ে সামাজীক দুরত্ব বজায় রেখে চলাচল করা এবং জনবহুল এসব কারখানায় কাজের সময়ও দুরত্ব বজায় রেখে কাজ করা তাদের সবার পক্ষে সম্ভব না। তাই স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে অর্থনীতি টেকানোর জন্য দক্ষ পরিচালনা ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার মত সচেতন মানুষ, দুটোরই যথেষ্ঠ অভাব রয়েছে আমাদের দেশে। কিন্তু অবশেষে, বাধ্য হয়ে নিম্ন আয়ের মানুষগুলোকেই স্বাস্থ্য ঝুঁকিটা বেশি নিতে হয় সবসময়। পাশাপাশি জীবিকার ঝুঁকিটাও নিতে হয় তাদেরকে।

স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে বাইরে বের হলে সবাইকে মাস্ক ব্যবহারে বাধ্য করতে দেখা গেছে আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীর লোকজনকে। কিন্তু, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের মতে সাধারণ কর্মজীবী মানুষগুলো যেসব মাস্ক পড়ে চলাফেরা করতেছে সেগুলো অস্বাস্থ্যকর। অনেক পোশাক কারখানা তাদের অতিরিক্ত কাপড় দিয়ে মাস্ক বানিয়ে শ্রমিকদের দিচ্ছে। এদিকে কেউ কেউ ফুটপাতে কিংবা রাস্তার পাশের বিভিন্ন দোকানে সাধারণ কাপড়ের মাস্ক কিংবা নন-ওভেন স্বস্তা থার্মোপ্লাষ্টিকের শপিং ব্যাগের তৈরি কাপড়ের মাস্ক কিনে ব্যবহার করছে। কিছু বস্ত্র প্রকৌশলী এসব সাধারণ মাস্কের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন।

এগুলো ধুলাবালি থেকে কিছুটা রক্ষা করলেও করোনা সংক্রমিত কোন ব্যাক্তির হাঁচি বা কাশি থেকে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য মোটেও কার্যকরী নয়। তারপরও সাধারণ মানুষ এসব মাস্ক ব্যবহার করছে। আর না করেও উপায় নেই। অনেক বিশেষজ্ঞ ন্যূনতম প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন ফার্মেসীতে পাওয়া সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ দিলেও সেগুলো প্রায় ৫-৮ গুন বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। একাধিকবার ব্যবহার উপযোগী না হওয়ার কারণে সেসব মাস্ক ১৫- ২০ টাকা দিয়ে কিনে ব্যবহার করার মত সামর্থ্য নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর নেই। আর এন-৯৫ মাস্ক ব্যবহারের কথা তো প্রশ্নেই আসে না। তাই ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজের জন্য বাইরে গেলেও খুব একটা সুরক্ষিত নন শ্রমিকরা।

স্বাস্থ্যবিধির চাইতেও যে চিন্তাটা নিম্ন আয়ের মানুষগুলোকে সবসময় তাড়া করে বেড়ায় তা হলো বাসা ভাড়া পরিশোধ এবং পরিবারের খাদ্যসামগ্রী কেনাসহ অন্যান্য ব্যয়। করোনা মহামারীর প্রকৃত এবং চূড়ান্ত প্রভাব এখনও আমাদের সামনে আসেনি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেতনের দাবিতে আন্দোলন করার খবর পাওয়া গেলেও বিজিএমইএ বলছে তাদের সদস্য কারখানাগুলো মার্চ মাসের প্রায় ৯৫ শতাংশ বেতন পরিশোধ করেছে। তার মানে গত এপ্রিল মাসে খরচ করার মত টাকা অনেক শ্রমিকের হাতে ছিল। এখনও হয়ত অল্প কিছু আছে কারো কারো হাতে। কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে সরকারের সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর অনেক কারখানা লে-অফ ঘোষণার নোটিশ দিয়ে কারখানা বন্ধ রেখেছে। ফলে এপ্রিল মাসের সম্পূর্ণ বেতন পাচ্ছে না শ্রমিকরা।

ইতিমধ্যে ৬০ শতাংশ বেতন পরিশোধের জন্য ঘোষণা আসলেও সেটা মে মাসের কত তারিখের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে তারও কোন সুনির্দিষ্ঠ তারিখ নেই। অন্যান্য মাসে নিয়মিত কর্ম ঘন্টার পরে অতিরিক্ত কাজ করে সংসার চালানোর মত একটা অর্থ পেয়েছিল তারা। কারখানাগুলো বন্ধ থাকার ফলে সেটা আর এ মাসে পাচ্ছে না তারা। আর মূল বেতনের ৬০-৬৫ শতাংশ হলে তারা প্রায় ৫ হাজার টাকার মত পাবে। আর এত কম টাকা দিয়ে তারা কিভাবে সংসার চালাবে এটা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে শ্রমিকরা। অনেক কারখানাতে ইতিমধ্যে এপ্রিল মাসের বেতনের দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন করতে দেখা গেছে।

শ্রমিকদের বেতন যদি মে মাস এবং পরবর্তী মাসগুলোতে সঠিকভাবে সঠিক সময়ে পরিশোধ করা না হয় খুব সংকটে পড়ে যাবে তারা। তাই এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিলে, দেশে শ্রমিকদের জীবীকা বাঁচানোর অস্থিরতাটা তখন খুব চূড়ান্ত আকার ধারণ করতে পারে যা সামাল দেয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়বে।

কর্ম সংকটের এ সময়ে গ্রামে বোরো ধান কাটাই-মাড়াইয়ের কাজ শুরু হওয়াতে গ্রামের কৃষি শ্রমিকরা কাজ পেলেও শহরের বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের কাজ অনেকদিন থেকেই বন্ধ। এই রমযানে পরিবারের জন্য ভালভাবে বাজার করার জন্য যথেষ্ঠ টাকাও অনেকের হাতে নেই। অনেকের আবার সামান্য সঞ্চয় যা ছিল তা শেষ হয়ে গেছে। আর সঞ্চয় যে তাদের খুব বেশি থাকে না সেটা আমরা ভালভাবেই জানি। সম্পূর্ণ মাসে যা আয় করে তা দিয়ে বাসা ভাড়া, খাবার, ছেলে-মেয়েদের খরচ মিটিয়ে মাস শেষে খুব সামন্যই থাকে সঞ্চয়ের জন্য। অনেকের ক্ষেত্রে সেটাও থাকে না।

সরকার কিংবা বিভিন্ন সংস্থা থেকে সাময়িক কিছু সাহায্য শুধুমাত্র হতদরিদ্রদের হাতে গেলেও নিম্ন মধ্য-বিত্তরা কোন সাহায্য পাচ্ছে না। তারা সরকারি সাহায্য নেওয়াতে অভ্যস্ত না তাই চুপ থেকেই অনেকে দিন কাটাচ্ছে। তাদেরও জরুরি আর্থিক সহোযোগিতা দরকার।

তাই করোনার সেই প্রকৃত প্রভাবের সময়টার কথা মাথায় রেখে সরকারকে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে মে এবং জুন মাসটা নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর জন্য কঠিন সময়। বর্তমানে উভয় সংকটে পড়ে গেছে তারা। না পাছে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বাইরে গিয়ে কাজ করতে আবার না পারতেছে বাসায় বসে থাকতে। জীবন আর জীবিকার মধ্যে তাদের কোন পছন্দ থাকে না এসময়। সব ভুলে জীবিকাই আগে বেঁচে নিতে হয় তাদেরকে। দেশের অর্থনীতির চাকা কিছুটা হলেও সচল রাখতে যেসব শ্রমিককে কাজ করতে হচ্ছে এতে তাদের নিজেদের এবং পরিবারের বাকি সদস্যদেরর জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

তাই সরকার এবং বিভিন্ন ব্যবাসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুধু অর্থনীতি কিংবা শুধু স্বাস্থ্য ঝুঁকির দিকে তাকালে হবে না। দু’টিরও সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হবে পুরো দেশে। জনগণের স্বাস্থ্য এবং আর্থিক অবস্থা কোনটিই যেন বড় কোন হুমকির মুখে না পড়ে সে ব্যাপারে নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর উপর বিশেষ নজর রাখতে হবে সরকারকে। তা নাহলে অনেক পরিকল্পনা আর চেষ্ঠা করে কমানো দারিদ্র্যের এ হার আবার বেড়ে গিয়ে এমন স্থানে পৌঁছাবে যে, ভবিষ্যতে সেটা কমানো খুবই কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ বিষয় হয়ে দাড়াবে।


লেখক: শিক্ষার্থী, এম বি এ, আই বি এ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ