করোনা যুদ্ধে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্টরা
- মো. আমিনুল ইসলাম
- প্রকাশ: ১৩ মে ২০২০, ০৭:৫৭ PM , আপডেট: ১৩ মে ২০২০, ০৭:৫৭ PM
করোনা শনাক্তকরণে সারাদেশে জীবন বাজি রেখে দেশের সেবায় স্বেচ্ছাসেবক বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্টরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে কাজ শুরু করেছে। তারা করোনার ভয়াবহতা এবং সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকির বিষয়ে জেনেও ডাক্তার ও মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের প্রশিক্ষণ দিতে যেয়ে ল্যাবে আসা নমুনা স্পর্শ করছে। যেকোনো ভাবে সে আক্রান্ত হতে পারে জেনেও দেশের কথা চিন্তা করে অকুতোভয় ও দুঃসাহসী এই অভিযানে আছেন এ স্বেচ্ছাসেবকগণ।
১৯৭১ সালে অনেক তরুণ যেমন পরিবারকে না জানিয়ে যুদ্ধে চলে গিয়েছিল কারণ পরিবার বাধা দিবে বলে তেমনই এই বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্টদের অনেকই পরিবারকে না জানিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে কোন প্রকার বিনিময় ছাড়াই। গ্রাজুয়েট বায়োকেমিস্ট এসোসিয়েশন (জিবিএ) এর মাধ্যমে অনেক আগে থেকেই বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্টদের স্বাস্থ্য খাতে স্থায়ীভাবে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়ে আসছিল যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় তা আমলে নেয়নি।
আবার সারাবিশ্ব যখন করোনাভাইরাসের মহামারীতে দিশেহারা তখনও দেশের সেবায় বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্টদের কাজে লাগানোর কথা বলে আসছিল জিবিএ। কারণ করোনা সনাক্তকরণ করে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সনাক্ত ও আইসোলেশনের মাধ্যমে বেশ কিছু দেশ করোনা প্রতিরোধে সফলতা পেয়েছে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা অনেক পিছিয়ে কারণ করোনা টেস্টের যে সর্বজনসিদ্ধ আদর্শ পদ্ধতি মানে RT-PCR তা চিকিৎসা সেবায় ব্যবহার হয়না ফলে ডাক্তার এবং মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা এই বিষয়ে তেমন অভিজ্ঞ না। ডাক্তার ও মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তারপর করোনা টেস্ট করা হচ্ছে তাই আমাদের দেশে টেস্টের পরিমাণ নগন্য বলা চলে।
কিন্তু এই কাজে যারা দক্ষ যেমন বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্ট তাদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার ইচ্ছা থাকলেও এতোদিন কাজে লাগানো হয়নি যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে জিবিএ চিঠি দিয়েছিল। আবার গত ২৯ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জিবিএ এর পক্ষ থেকে চিঠি দিলে গত ৩০ এপ্রিল অবশেষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যারা এই কাজে দক্ষ যেমন বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্টদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার অনুমোদন দেয়। তাদের এই পদক্ষেপকে আমরা বায়োকেমিস্টরা সাধুবাদ জানাই।
ইতোমধ্যে, কভিট-১৯ সনাক্তকরণের জন্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে দেশ এবং বিদেশের সব সনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষক এর মাধ্যমে জিবিএ একটি আন্তর্জাতিক মানের অনলাইন প্রশিক্ষনের আয়োজন করছে এবং তা সফলাতার সাথে সম্পন্নও করেছে এবং এক-দুই দিনের মধ্যে আবার দ্বিতীয় দফায় স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দিতে যাচ্ছে জিবিএ। লক্ষ্য হলো বায়োকেমিস্টদের আরও বেশি দক্ষ ও পরীক্ষার বিষয়ে সতর্ক থেকে দেশের সেবায় কাজে লাগানো। আর এই সামগ্রিক বিষয়ে দিন রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এই সংগঠনটির সভাপতি প্রফেসর ড. হোসেন উদ্দিন শেখার এবং সা. সম্পাদক আবু সাঈদ মুহাম্মদ শামীম।
দেশপ্রেম থেকে দেশের সেবায় বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্টদের কাজে লাগেতে বিভিন্ন ধরনের দিক-নির্দেশনা এবং পরামর্শ দিয়ে পাশে রয়েছেন জাবির সাবেক উপাচার্য ও বায়োকেমিস্ট প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইমরান কবির চৌধুরী, ভ্যাকসিন গবেষক ও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী, জিন বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. হাসিনা খান যিনি বাংলাদেশর পাট ও ইলিশের জীন নকশায় নেতৃত্ব দেন, ঢাবি ও জাবির বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সম্মানিত চেয়ারম্যান যথাক্রমে প্রফেসর ড. জেবা ইসলাম সেরাজ এবং প্রফেসর ড. নুরুল করিম, ঢাবির জেনেটিক ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. শরিফ আখতারুজ্জামান, রাবির বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. তানজিমা ইয়াসমিন, ঢাবি বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের প্রফেসর ড. সিরাজুল ইসলাম, কাতারে কর্মরত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভাইরলজিস্ট ড. রুবায়েত হাসান তানভী, বায়োকেমিস্ট ও জয়েন্ট কমিশনার অব কাস্টমস সাধন কুন্ডু এবং মো. মিনহাজ উদ্দিন, আইসিডিডিআরবির ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান ড. এনায়েত হোসাইন এবং বায়োসেফটি বিভাগের ড. আসাদুল গনী, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ড. সাব্রিনা মরিয়ম ইলিয়াস, আমেরিকায় কর্মরত গবেষক ও বিজ্ঞানী ড. আরিফুল ইসলাম ও ড. এহসান রহমান, জার্মানীতে কর্মরত বিজ্ঞানী ড. মো. রেজাউল করিম।
এছাড়া বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল যেমন ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, ময়মনসিংহ, রংপুর, ফরিদপুর, সলিমুল্লাহ, মুগধা, কুর্মিটলা, কুমিল্লা, বগুড়া, দিনাজপুর, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জে যারা শুরু থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডাক্তার ও মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন করোনা সনাক্তকরণের জন্য বায়োকেমিস্টদের সংগঠিত করেছেন এবং উদ্বুদ্ধ করেছেন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে তাদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার, বিজ্ঞানী, বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্ট হাবিবুল বারী সজীব, ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবের বিজ্ঞানী বায়েজিদ হোসেন , ঢাবির পোস্ট ড. ফ্যালো ড. রিচার্ড মালো। তাছাড়া রয়েছেন ড. নুরজাহান মালিহা, বায়োকেমিস্ট ও সিনিয়র রিচার্স ইনভেস্টিগেটর, আইসিডিডিআরবি; ড. বোরহান উদ্দিন, এসোসিয়েট প্রফেসর, বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগ, জাবি; বায়োকেমিস্ট এস. এম. হাসান আঃ লতিফ, সায়েন্টিফিক অফিসার, ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাব, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ; কাজী এবনুল হাসান, পিএইচডি করছেন বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি, চীনে; ঢাবির বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের মোছাঃ নুরজাহান বেগম ও ড. সাব্রিনা মরিয়ম ইলিয়াস, যারা পিএইচডি করছেন ঢাবির জেনেটিক্স বিভাগে; হাবিপ্রবি এর বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের আল আমীন শীতল; বিএসএমএমইউ এর তৌফিক, নবিপ্রবি আমিনুল।
তাছাড়া প্রায় শ'খানেক স্বেচ্ছাসেবক বায়োকেমিস্টকে প্রশিক্ষণ দিয়ে রাখা হয়েছে এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে জিবিএ এর মাধ্যমে দেশের এই সংকট মোকাবেলায়।
আমি নিজেও শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়ায় ডাক্তার ও মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের করোনা সনাক্তকরণ বিষয়ে এক সপ্তাহ প্রশিক্ষন দিয়ে এসেছি বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্ট হিসেবে এবং আরও কয়েক জায়গায় প্রশিক্ষন দেওয়ার কথা রয়েছে।
আমি মনে করি যারা বিনা পারিশ্রমিকে দেশ সেবায় এগিয়ে আসে তারাই প্রকৃত দেশ প্রেমিক এবং দেশের সম্পদ। যেকোন সংকটে দেশ এদের পাশে পাবে। তাই দেশের স্বার্থেই এদের কাজে লাগাতে হবে সরকারের এবং কাজের সুযোগ দিতে হবে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেরই স্বাস্থ্যখাত গবেষণামুখী তাই তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাও অনেক উন্নত এবং তারা চিকিৎসা পদ্ধতিতে প্রতিনিয়ত নতুন প্রযুক্তি সংযোজন করছে যা থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে।
করোনা সংকট আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের স্বাস্থ্যখাত কতটা নাজুক। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ গুলোর মধ্যে স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির সবচেয়ে কম অর্থ ব্যয় হয় আমাদের দেশে এবং গবেষণাধর্মী উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকার কারণে বছরের প্রায় ৪-৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। তাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচিৎ ডাক্তারদের পাশাপাশি বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্টদের স্বাস্থ্য খাতে অন্তর্ভুক্তির কথা ভাবা এবং এই খাতকে নতুন করে ঢেলে সাজানো যে কোন সংকট মোকাবেলায়।
করোনা মোকাবেলায় বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্টদের কি কি ভূমিকা পালন করতে পারে এ বিষয়ে কথা হয় প্রফেসর ড. সোহেল আহমেদ এর সাথে যিনি বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের সদস্য এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন।
তিনি জানান, বিগত প্রায় ত্রিশ বছরে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা খাতে রোগ সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে অভুতপূর্ব আধুনিকায়ন ও মানোন্নয়ন সাধিত হয়েছে যেখানে বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্টদের অবদান অগ্রগণ্য। অথচ এদের বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত তাদের অবদানকে এখনো উপযুক্ত মূল্যায়ন করতে পারেনি। তবে বৈশ্বিক মহামারী কোভিড -১৯ বিপর্যয়ে বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্টগণ নিজ দায়বদ্ধতা থেকে অকাতরে স্বেচ্ছায় পাশে দাঁড়ানোয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্টগণের অত্যাবশকতা কিছুটা হলেও অনুভব করেছেন।
প্রফেসর ড. সোহেল আহমেদ বলেন, SARS-CoV-2 বা করোনা ভাইরাস এমন এক শত্রু স্বত্তা যে খালে চোখে দেখা যায় না। যে শত্রুকে দেখা যায় না তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করা দুঃসাধ্য বলা চলে। আমরা এই ভাইরাসকে ধরতে পারবো না তবে সনাক্ত করতে পারবো যা করে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবক বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্টগণ। তাই করোনা মোকাবেলায় সম্মুখ যুদ্ধে ডাক্তারগণে পাশাপাশি বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্টদের দরকার।
তিনি আরও বলেন, করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্স অত্যন্ত জরুরী হয়ে পরেছে কারণ বাংলাদেশে এসে এই ভাইরাস কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে তা আমরা জানিনা, তাই করোনা শনাক্তকরণে জন্য কিট তৈরি এবং ড্রাগ ডিজাইন এর জন্য সিকুয়েন্সিং জরুরী যা কিনা বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্টদের জানা। তাই আমি মনে করি মাননির্ণীত এবং মানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থা তৈরিতে বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্টদের চিকিৎসাখাতে স্থায়ীভাবে অন্তর্ভুক্তি খুবই জরুরী।
লেখক: বায়োমেডিসিন গবেষক, স্বেচ্ছাসেবক বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্ট এবং প্রশিক্ষক, কভিট-১৯ শনাক্তকরণ