মুনতাসীর মামুন: একটি প্রতিষ্ঠান
- আবুল বাশার নাহিদ
- প্রকাশ: ১২ মে ২০২০, ১১:৫৫ PM , আপডেট: ১৩ মে ২০২০, ১২:২২ AM
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের পরিচয় বহুমাত্রিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত শিক্ষক, বিশিষ্ট লেখক, সংগঠক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনের অগ্রগণ্য পুরোধা, গবেষক, গল্পকার, অনুবাদক, শিশু সাহিত্যিক, শিল্প সমালোচক, বুদ্ধিজীবী এবং বরেণ্য রাজনৈতিক ভাষ্যকার। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন। একই বিভাগে ১৯৭৪ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং “বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক” হিসেবে সর্বশেষ অবসরে যান ।
জন্ম চাঁদপুরের বিখ্যাত প্রগতিশীল রাজনৈতিক পরিবারে। তবে ছোটবেলা কেটেছে চট্রগ্রামে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়ালেখা চট্রগ্রামে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে থাকতেন তাঁর চাচা প্রখ্যাত সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর এর বাসায় যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন।
মুনতাসীর মামুন ১৯৬৩ সালে তার শিশু সাহিত্যের জন্য প্রেসিডেন্ট স্বর্ণ পদক লাভ করেন। লেখালেখির হাতেখড়ি হয়েছিল সেই ছোট বেলা থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করেছেন ছাত্র ইউনিয়নের। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাকসু নির্বাচনে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল থেকে সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ডাকসুর মুখপত্র "ছাত্রবার্তা" বের হত তারই সম্পাদনায়। এ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল "দালাল শিক্ষকরা এখনো হালাল কেন?" এ প্রবন্ধ প্রকাশ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তা ব্যক্তি ভিসির সাথে তার আলোচনা সুখকর ছিল না। এরপর তৎকালীন ডাকসুর ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের পরামর্শে পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেস থেকে "ছাত্রবার্তা" প্রকাশ না করে অন্য জায়গা থেকে প্রকাশ করা হয়েছিল। তবুও প্রশাসনের অন্যায্য কথায় সায় দেয়নি। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি।
ইতোমধ্যে বিচিত্রা পত্রিকা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তিনি সেখানে নিয়মিত লিখতেন। তাঁর কলমে ফুটিয়ে তুলতেন অচেনা ঢাকাকে নতুন রুপে। তার বিভিন্ন ধরণের লেখালেখির সাথে সাথে একাডেমিক লেখা প্রকাশ হতে থাকে। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি, ডাকসুর নির্বাচিত সম্পাদক, সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি, এবং ব্যাপক জনপ্রিয় "বিচিত্রা" পত্রিকার লেখক হিসেবে মুনতাসীর মামুন ক্যাম্পাসে ছিলেন জনপ্রিয় মুখ।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক শহিদ হন। অনেক শিক্ষক রাজাকার হিসেবে চাকুরি হারান। ইতিহাস বিভাগের তিনজন শিক্ষক শহিদ হন এবং সম্ভবত দুইজন শিক্ষক রাজাকার হিসেবে বিভাগ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৭৪ সালে ইতিহাস বিভাগে যে পাঁচজন শিক্ষক যোগদান করেন মুনতাসীর মামুন তাদের মধ্যে একজন। তিনি শিক্ষাজনিত শূন্যপদে ৫/৬ বছর চাকুরী করার পরে স্থায়ী হন। তিনি মনে করেন ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষকগণ যদি শহিদ না হতেন তাহলে হয়তোবা তাঁর এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা হত না। ফলে শহিদ বুদ্ধিজীবী শিক্ষকদের বিচারের দাবী এবং কার্যকর করা তাঁর পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করেন। যে পাঁচজন শিক্ষক যোগদান করেছিলেন তাদের মধ্যে অধ্যাপক শরিফুল্লাহ ভূঁইয়া এবং তিনিই শেষ পর্যন্ত ছিলেন। বাকিরা বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। তবে তিনি শিক্ষকতার থেকে গ্ল্যামার চাকুরী না করে এখানে থাকার কারণ ছিল শিক্ষক এবং লেখক হতে চেয়েছিলেন। সারা জীবন শিক্ষকতা করেছেন আর লিখেছেন।
১৯৭১ সালে তার চাচা বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সাথে অবরুদ্ধ দেশে পত্রিকা বের করতেন। বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে সংবাদ পৌঁছে দিতেন। ১৯৭২ সালের শুরুর দিকে শহিদ মিনারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে যে সমাবেশ হয়েছিল সেখানে উপস্থিত ছিলেন উনিশ বছরের মুনতাসীর মামুন। সে সমাবেশে ছিলেন জাহানারা ইমাম, পান্না কায়সার প্রমূখ। কথা সাহিত্যিক জহির রায়হানের মৃত্যুর আগের দিনও তিনি ও তার বন্ধু বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবীর একসাথে সময় কাটিয়েছেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ইতিহাস বিভাগ থেকে প্রথম পিএইচডি লাভ করেন মুনতাসীর মামুন। পিএইচডি থিসিস ছিল বাংলা ভাষায়। উনিশ শতকের পূর্ব বাংলা ছিল তার গবেষণার বিষয়। তার সুপারভাইজার ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমদ। পরীক্ষক ছিলেন অধ্যাপক এ আর মল্লিক এবং ভারতের অধ্যাপক সুমিত সরকার।
তাঁর দীর্ঘ পাঁচ দশকের কর্মজীবনের আলোচনা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। ক্লাস রুমে যেরকম ছিলেন নিয়মিত তেমনি বাংলাদেশের প্রতিটি সাংস্কৃতিক এবং গণ আন্দোলনে ছিলেন সরব। দুহাতে লিখেছেন অবিরাম। প্রায় চারশত বই প্রকাশ হয়েছে তার লেখা এবং সম্পাদনায়। ইতিহাসের জটিল কঠিন গবেষণার বিষয় যেমন তার কলমে এসেছে তেমনি লিখেছেন ভ্রমন কাহিনী, স্মৃতিকথা, অনুবাদ, ছোট গল্প, শিশু সাহিত্য, শিল্প সমালোচনা। নিয়মত লিখেছেন বিভিন্ন পত্রিকায় রাজনৈতিক ভাষ্য- বিশ্লেষণ যা ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়।
পূর্ব বাংলার ইতিহাস, ঢাকার ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন বহু ধরণের বই। এ তিনটি বিষয়ে মুনতাসীর মামুনকে যারা অপছন্দ করেন তারাও তাঁর অবদানকে অস্বীকার করতে পারবেন না।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে হলে মুনতাসীর মামুনের লেখা পড়তে হবে এটা তার বিরোধীরাও অকপটে স্বীকার করেন। ব্যক্তি উদ্যোগে অধ্যাপক মামুন “মুক্তিযুদ্ধ কোষ” লিখার মত অসাধ্য কাজ করে দেখান। লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক নিয়ে।
আর বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীর বিচারে যে কয়েকজন ব্যক্তি অসামান্য ভূমিকা পালন করেন মুনতাসীর মামুন তাদের একজন। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবীতে যেভাবে রাজপথে সরব ছিলেন, "ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি" সংগঠনের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তেমনি লিখেছেন অবিরাম যুদ্ধপরাধীর বিচার কেন জরুরী সে বিষয়ে। তিনি এ সংগঠনের সহ-সভাপতি। এ সংগঠন করতে গিয়ে দীর্ঘ চার দশক সহ্য করতে হয়েছিল বহু অত্যাচার। সমাজের এলিটশ্রেণি যারা পাকিস্তানিমনা, এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও আছেন যারা ঘাদানিক বলে হাসা-হাসি করতেন। রাষ্ট্রযন্ত্র তার সকল শক্তি দিয়ে থামিয়ে দিতে চেয়েছিলো, কারাবরণ করতে হয়েছিল কিন্তু তারা দমে যাননি বরং তাদের দাবী বাস্তবায়ন করেছেন জনগনে সমর্থন নিয়ে। থামিয়ে দিয়েছেন একাত্তরের পরাজিত শক্তির মিথ্যে আস্ফালন।
মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দিক হল গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ। পাকিস্তানি হায়েনারা দেশটাকে জাহান্নামে পরিণত করেছিল। পঁচাত্তরের পরে মুক্তিযুদ্ধের বয়ান বদলে ফেলা হয়। বিজয়কে মানস পটে নিয়ে আসা হয়। মুনতাসীর মামুন এবার মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক নিয়ে লেখা শুরু করলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যাকে সামনে আনলেন। গড়ে তুললেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গণহত্যা জাদুঘর। মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য বধ্যভূমি যা হারিয়ে যাচ্ছিল তা তিনি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলেন। প্রকাশ করছেন গণ হত্যার উপর অসংখ্য বই। তিনি মুক্তিযুদ্ধের উপর শুধু বই লিখেননি বরং পরবর্তী গবেষকদের জন্য রেখে গেছেন ইতিহাসের উৎসের নানা উপকরণের সমাহার।
মুক্তিযুদ্ধোকে যখন জন মানস থেকে সামরিক সরকার, স্বাধীনতা বিরোধীরা মুছে দিতে চেষ্টা করেছিল তিনি তার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। ফলে তাকে স্বীকার করতে হয়েছিল জেল জুলুম এমনকি দেশদ্রোহী মামলা! কিন্তু তিনি থেমে যাননি বরং নব প্রেরণায় ফিরে এসেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনকে তরুন সমাজের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় করে তোলেন। ফলে স্বাধীনতার চার দশক পরে এসে স্বাধীনতা বিরোধিদের ফাসির দড়িতে ঝুলানো সম্ভব হয়। সামরিক শাসনেরও তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু থেকেই প্রগতিশীল গোলাপী দলের রাজনীতি করতেন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শিক্ষক সক্রিয় থাকলেও পরবর্তীতে ততটা সক্রিয় ছিলেন না। কারণ ততদিনে শিক্ষক রাজনীতির বৈশিষ্ট্য বদলে গেছে। ভিসি বা প্রভোস্ট হওয়াই যেন এখন এর মূল লক্ষ্য। মুনতাসীর মামুন এসবে ছিলেন না। তবে তিনি কখনো দল বদল করেনি বরং শেষ পর্যন্ত গোলাপী দলেই ছিলেন। কোন দলের পদলেহন করে কোন পদে যাননি। মুনতাসীর মামুন এখানে অন্যদের থেকে আলাদা। ক্ষমতালোভী ছিলেন না। তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল এবং সিনেটের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে।
ঢাকার ইতিহাস চর্চার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন "সেন্টার ফর ঢাকা স্টাডিজ"। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের "মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইনিস্টিটিউট " এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। জাতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ড, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং জাতীয় আর্কাইভের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন।
বাংলাদেশ লেখক শিবির ও বাংলাদেশ লেখক ইউনিয়নের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং যথাক্রমে ছিলেন প্রথম যুগ্ম আহবায়ক ও যুগ্ম সম্পাদক। ঢাকা নগর জাদুঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা। প্রতিষ্ঠা করেছেন " মুনতাসীর মামুন- ফাতেমা মামুন ট্রাস্ট" যেখান থেকে গরিব মেধাবী শিক্ষার্থী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করা হয়।
মুনতাসীর মামুনের নিজস্ব সংগ্রহে আছে ১০-১২ হাজার বই। অরিজিনাল পেইন্টিং আছে ৩০০ এর উপরে। বিভিন্ন দেশের আড়াইশোর উপরে কাঠের পুতুলের কালেকশন আছে তার। মুখোশের কালেশন, প্রাচীন আমল থেকে বর্তমান পর্যন্ত কয়েনের কালেকশন আছে অনেক।
নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন "বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী " নামক অসাম্প্রদায়িক ও গণমুখী ইতিহাস চর্চার অনন্য প্রতিষ্ঠান। ইতিহাস চর্চাকে শুধুমাত্র ইতিহাসের ছাত্র শিক্ষকের জন্য সীমিত করেননি বরং ইতিহাস আগ্রহী প্রতিটি মানুষের মিলনমেলার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এ সংগঠন রূপ নিয়েছে। এ সংগঠন আয়োজন করে থাকে বিভিন্ন দিবসে সেমিনার, আলোচনা সভা। প্রকাশ করে থাকে গবেষণা পত্রিকা। দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন শেষে এখন প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।
১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের বোর্ড অফ ট্রাস্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এটি দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গণহত্যা জাদুঘর। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ প্রতিষ্ঠান যোগ করেছে নতুন মাত্রা। পাকিস্তানি বাহিনী কতটা নির্মম ,বর্বর নির্যাতন করেছিল একাত্তরে তা অনেক ক্ষেত্রে আলোচনার বাইরে থেকে গিয়েছিল। ত্রিশ লক্ষ শহিদ সংখ্যা এবং পাকিস্তানিদের গণহত্যা অস্বীকারের যে অপচেষ্টা তা রুখে দিতে এ প্রতিষ্ঠানের সার্বিক কর্মকান্ড ঈর্ষনীয়। এ প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর আয়োজন করছে আন্তর্জাতিক সেমিনার। অধ্যাপক মামুন বলতে চান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিচার যদি করা হত তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নতুন করে আর একটা গণহত্যা চালাতে পারতো না।
অধ্যাপক মামুন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন। রাষ্ট্র পরিচালিত হবে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের ভিত্তিতে যা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সংবিধানের মূলনীতি। রাষ্ট্র হবে গণতান্ত্রিক। যারা রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করার সুযোগ এবং গণতন্ত্রের কবর রচনা করে সামরিক শাসন জারি করেছিল তিনি এর প্রতিবাদে ছিলেন সোচ্চার। ফলে যারা ধর্মভিত্তিক এবং উর্দি পোশাকের রাজনীতির খেলায় মেতেছিল তারা অধ্যাপক মামুনের শত্রু হয়ে উঠল।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের বিকাশ হয়নি । বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে ইতিহাসের বহু পথ পাড়ি দিয়ে। এ দেশের ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে জড়িয়ে আছে মাটি-মানুষের গল্প। ভাটির বাংলার মানুষের ইতিহাস চেতনা অসাম্প্রদায়িক এবং নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমন্ডিত যা এক জন ছাত্রের জানা থাকলে সে কখনো উগ্র, জঙ্গী হতে পারে না। আর একজন ছাত্র সে ইতিহাস জানবে তার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। অধ্য়াপক মামুন এ বিষয়টি আলোচনার সামনে আনলেন। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে "বাংলাদেশের অভুদ্যয়ের ইতিহাস " পাঠ বাধ্যতামুলক করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকাই প্রধান। দায়িত্ব পালন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন গোলাম আজমের বিরুদ্ধে। নব্বইয়ের দশকে গোলাম আজমের নাগরিকত্বের প্রশ্নে এবং জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণ আদালতে যে বিচার হয়েছিল সেখানে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
ঘুরে বেরিয়েছেন দুনিয়ার বিখ্যাত লাইব্রেরিগুলোতে। গবেষণার জন্য ব্রিটিশ ইন্ডিয়া লাইব্রেরিতে বহুদিন পড়ালেখা করেছেন। ব্রিটিশ লাইব্রেরীর স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, "আমার খেয়াল আছে আমি যখন ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে পড়ছি, ওখানকার যে পরিচালক,আমাকে এসে বলেন যে, মুনতাসীর তুমিই একমাত্র লেখক গত দশ বছরে দেখলাম পাঁচবার এসেছ, প্রতিবারই তোমার দেশে গিয়ে দুইটা তিনটা বই প্রকাশ করেছ। আমরা তোমার সব বই জোগাড় করেছি, বলে একটা লিস্ট এনে দেখালেন বাংলায়। আমি বললাম আরও আছে কিছু। উনি বললেন তাই নাকি? তাদের কাছে ৪০টা বই ছিল" (স্মৃতিপটেঃ ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগ এ্যালামনাই এসোসিয়েশন ১৭ তম পুনমির্লনী ২০২০)
ঘুরেছেন দুনিয়ার বিভিন্ন জনপদে। দেখেছেন, শিখেছেন আর দু হাতে লিখেছেন। ২০১৯ সালে দুনিয়ার বিখ্যাত গণহত্যার জাদুঘরগুলোতে ঘুরে বেরিয়েছেন। এপ্রিলে ছুটে গিয়েছেন কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামসহ এ অঞ্চলের গণহত্যা জাদুঘরগুলোতে। নভেম্বরে গেছেন ইউরোপের গণহত্যা জাদুঘর দেখতে।
জীবনের বিভিন্ন সময়ে ঘুরেছেন ক্যান্টন,হংকং,ম্যাকাও,বেইজিং,জাপান,কোরিয়া,ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন। ঘুরেছেন পশ্চিমের দেশ- জার্মানি,ইতালি,ফ্রান্স,স্পেন। ঘুরছেন আর ফিরে এসে লিখছেন সাধারণ পাঠক, গবেষকদের জন্য।
মুনতাসীর মামুন এক দল গবেষক তৈরি করেছেন যারা মুক্তিযুদ্ধের নানান দিক এবং প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে কাজ করছেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এ শিক্ষক তার এক সাক্ষাৎকারে বলেন "আমার কোন অপ্রাপ্তি নেই। আমি লেখক হতে চেয়েছি। সেকেন্ড গ্রেড একটা লেখক হয়েছি। কিন্তু লেখক তো হয়েছি। শিক্ষকতা করতে চেয়েছি, উচ্চমানের না হলেও কেউ অপবাদ দেয়নি। " যিনি প্রায় চার শত বই লিখেছেন, যার ক্লাস করার জন্য ছাত্ররা অধীর অপেক্ষায় থাকতো, যিনি ইতিহাসকে জনমানসে প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা করে গেছেন,বাংলাদেশে সিভিল সোসাইটি প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন, যিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান, তার বক্তব্য কত বিনয়ী!!!
মুনতাসীর মামুন এদেশের ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি, এবং মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা বিষয়ে কতটা অনিবার্য এবং জনপ্রিয় তা গুগলে মুক্তিযুদ্ধের বই লিখে সার্চ দিলে বুঝা যাবে। বিষয় এবং লেখার ভিন্নতায় তিনি অনন্য। তিনি ইতিহাসকে শুধু শ্রেণী কক্ষে সীমাবদ্ধ করেননি বরং ইতিহাসের প্রয়োজনীয়তা তিনি জনমানসে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক মুনতাসীর মামুনের মত এত জন মানসে জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেননি। আর তিনি যে অসামান্য লেখালেখি করেছেন তা অনেকের জন্য কল্পনাতীত। মুনতাসীর মামুন সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন আবার কলম ধরবেন।
মুনতাসীর মামুন স্যারের লেখার বৈচিত্র্য সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে দুটি বইয়ের শিরোনাম দেখে। যা এ বছরের বই মেলায় জার্নিম্যান থেকে প্রকাশ হয়েছে। "চেরি ফোটার দিন" ও "বৃষ্টিভেজা স্মৃতির গান" । উল্লেখ্য এ বই মেলায় তাঁর বিশের অধিক বই প্রকাশ হয়েছে।
অধ্যাপক মামুন বেঁচে থাকবেন তার লেখনীতে। অধ্যাপক মামুন বেঁচে থাকবেন এ দেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইলের এ মাটি ও মানুষের হৃদয়ে। অধ্যাপক মামুন শুধু একজন ব্যক্তি নয় বরং একটা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের প্রগতিশীল মানুষের বাতিঘর। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন লেখার জগতে, সেটাই আমদের প্রত্যাশা।
লেখক: আবুল বাশার নাহিদ
লেকচারার, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী