শিক্ষার্থীদের ভাবনা
প্রস্তুতিহীন অনলাইন ক্লাস বিলাসী সিদ্ধান্ত
- আসিফ হাসান রাজু
- প্রকাশ: ১০ মে ২০২০, ০৪:৫০ PM , আপডেট: ১০ মে ২০২০, ০৬:৫৫ PM
‘করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকতে পারে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’ এমনটাই জানিয়ে দিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে ইউজিসি ও শিক্ষামন্ত্রাণলয় থেকে দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। এমন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কি ভাবছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা? এ নিয়ে ছয়জন শিক্ষার্থীর ভাবনা তুলে ধরছেন— রেদওয়ানুল ইসলাম
অনলাইন ক্লাস কতটা যৌক্তিক?
জারিন তাসনিম
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
করোনা ভাইরাসের ব্যাপকতা আটকাতে গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অনিশ্চয়তায় ঝুঁকছে শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাসহ আটকপ আছে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কার্যক্রম। এদিকে প্রতিনিয়ত বাড়ছে করোনা আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দিনগুলোতে আরও ভয়াবহ হতে পারে করোনার রুপ। অসুস্থ পৃথিবীতে কবে আসবে সুস্থতা-তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। এমতাবস্থায় অনলাইন ক্লাস কতটা যৌক্তিক? শিক্ষা কার্যক্রমের স্থবিরতা কাটাতে অনলাইন ক্লাস সহায়ক হতে পারে। পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হলেও এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে শিক্ষাদান কর্মসূচি।
এতে করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া মাত্রই পরীক্ষা নেয়ার মাধ্যমে সেশনজট কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব হবে। কিন্তু অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কোনো অসুবিধা আছে কিনা তা ভাবতে হবে। 4G যুগে বাংলাদেশে এখনো কিছু গ্রাম আছে যেখানে নেটওয়ার্ক সংযোগ যথেষ্ট না। "Out of service area", "Mobile network is not available" অবস্থার নেটওয়ার্কে থাকা গ্রামে 2G, 3G তো পূর্নিমার চাঁদ, 4G কল্পনাতীত। এমতাবস্থায় এসব এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ক্লাস যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হবে। ফলে মনে করি বিষয়টি আরোও ভেবে দেখা উচিত।’
অনলাইনে ক্লাস বাস্তবায়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ
আসিফ হাসান রাজু
নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে নিঃসন্দেহ অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা একটি যুগান্তরকারী সিদ্ধান্ত বলে মনে করি। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে তার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত না করতে পারলে বিশ্বায়নের এ যুগে টিকে থাকা মুশকিল। তবে বর্তমান দেশের প্রযুক্তিব্যবস্থা বিবেচেনায় আনলে অনলাইনে ক্লাস বাস্তবায়ন একটি চ্যালেঞ্জ। কেননা, এর জন্য যে টেকনিক্যাল সার্পোট প্রয়োজন সেইটি হয়ত সকল শিক্ষার্থীর নেয়। বিশেষ করে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সকল শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করে তার বেশির ভাগ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত-নিম্মবিত্ত ও গ্রামঞ্চলের। দেশে এখনও অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চল আছে যেখানে নেটওয়ার্কের পর্যাপ্ত সুযোগ নেয়। তাদের কাছে অনলাইনে ক্লাস যেন বিলাসিতার সামিল।
কেননা, অনলাইনে ক্লাস করতে হলে উচ্চ গতি সম্পন্ন ইন্টারনেট, ভালো স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার বা ল্যাবটপ প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশের মোবাইল অপারেটর ও তাদের নেটওর্য়াক, ইন্টারনেট সেবার মানও উন্নত বিশ্বের মত ভালো নয়। এছাড়া এই মহামারীতে এমন অনেক পরিবার আছে যাদের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে শ্রমজীবী সহ যারা টিউশনি, পার্টটাইম জব করে পরিবার ও নিজেদের খরচ বহন করত। তাদের কাছে এই মুহূর্তে অনলাইনে ক্লাস একেবারে বেমানান। তবে সরকার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি উদ্যোগ নেয় অনলাইনে ক্লাস ফ্রি করে দেওয়ার, তাহলে হয়ত অনেকে অংশগ্রহন করতে পারবে।
বাস্তবায়নে চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা
তন্বী আক্তার
শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমানে করোনা ভাইরাসের প্রকোপের কারণে সরকারি নির্দেশনায় বন্ধ আছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে, শিক্ষা মন্ত্রানলায় সহ ইউজিসি সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস হবে যেটি অনেক ভালো একটা সিদ্ধান্ত। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষার্থী এখন রাজধানীর বাইরে নিজ গ্রামে অবস্থান করছেন ফলে অনেকেই ইন্টারনেটের ধীরগতি কিংবা উচ্চমূল্যের কারণে ক্লাসের সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে না বলে মনে করি। কারণ এমন অনেক প্রত্যন্ত এলাকা রয়েছে যেখানে ফোনের নেটওয়ার্ক থাকে না, সেখানে অনলাইন ক্লাস কল্পনাতীত ব্যাপার।
এছাড়া, বর্তমান সময়ের একটি পরিচিত চিত্র যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে তা হলো অনেক পরিবারে দেখা দিচ্ছে আর্থিক অস্বছলতা ও মৌলিক চাহিদার সংকট। এমতাবস্থায় যদি অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের ক্লাস করতে হয় তা অনেকের জন্য অসম্ভব। যদি প্রযুক্তির ব্যবহার সবজায়গায় সফল ভাবে পরিচালিত হত, তাহলে এমন উদ্যোগ কার্যকরী হতে পারত। অনলাইন ক্লাস করার অন্যতম কারণ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে সেশনজটকে।
বর্তমানে সেশনজট অনেক কমিয়ে আনা হলেও করোনার প্রভাবে আবারো সেশনজটের আশংকা রয়েছে। তবে, শুধুমাত্র অনলাইনে কম-বেশি ক্লাস নিলেও এত দ্রুত এই সংকটের সমাধান হবে না। এর জন্য চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর শিক্ষা ক্যালেন্ডার সমন্বয় করে বেশি বেশি ক্লাস ও বেশি সময় নিয়ে ক্লাস করে এই সমস্যার সমাধান অনেকাংশেই সম্ভব বলে আমি মনে করি। এছাড়া শিক্ষা যেহেতু সার্বজনীন, তাই সবার সুবিধা ও অসুবিধার কথা বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
অনলাইনে ক্লাস করানোর সিদ্ধান্তটা নিতান্তই বিলাসিতা
সাদিয়া সাবাহ্
নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান সংকটকালীন সময়ে আমরা সবাই অনেকরকম সমস্যার মুখোমুখি। করোনা সংকটে পুরো বিশ্ব যেখানে থমকে গেছে সেখানে খুব স্বাভাবিকভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও স্থবির। অনেকেই ঘরে বসে থাকতে থাকতে একঘেয়ে এবং হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে, তেমনি অনেকেই নিত্যদিনের খাদ্য প্রাপ্তির অনিশ্চয়তাই ভুগছে। এমন অবসহায় অবস্থায় অনলাইনে ক্লাস কতটা যৌক্তিক সেটিই বড় প্রশ্ন। অনেকেই হয়তো বলবে ক্লাসটা যৌক্তিক।
বাস্তবতার দিক দিয়ে দেখলে, একদিন পৃথিবী সুস্থ হবে, আমাদের এই চিন্তা করেই ক্লাস অব্যাহত রাখা উচিত। কিন্তু এবিষয়ে আমি চরম অনীহা প্রকাশ করছি। উন্নত বিশ্বের তালমিলিয়ে যদি আমাদের দেশেও অনলাইনে ক্লাস চালু হয়, তাহলে আমরা নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হবো। যেমন, আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থীই দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের। যারা ইতোমধ্যে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়ে গেছে। যাদের বাড়ির কর্তা কৃষক তারা শাক-সবজি/ফসল বিক্রি না করাই আর্থিক দিক দিয়ে পঙ্গু হয়ে গেছে। এমনকি আমাদের দেশের অসংখ্য শিক্ষার্থীর বাবা মজুর, শ্রমিক যারা এখন বেকার। যেসব শিক্ষার্থী নিজেই টিউশনি এবং নানারকম পার্টটাইম চাকরির মাধ্যমে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতো।
এ মুহূর্তে অনলাইনে ক্লাসকে আমি শুধুমাত্র মানসিক চাপ বলে মনে করছি। আমাদের অনেক শিক্ষার্থীর কাছেই স্মার্টফোন অথবা ল্যাপটপ নাই। আর ইন্টারনেট ব্যবহার করার যে খরচটা লাগবে সেটাই বা কোথা থেকে! আর গ্রামে নেটওয়ার্ক সার্ভিসের কথা নাইবা বললাম। 2G নেটওয়ার্ক দিয়ে আর যাহোক, অনলাইনে ক্লাস করা যায় না। যদি অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হয় সেক্ষেত্রে আমি মনে করি, শুধুমাত্র রাজধানীসহ, বিভাগীয় ও জেলা শহরে যে সকল শিক্ষার্থীর বাসা তারা হয়ত ক্লাস করতে পারবে। আর বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী যারা গ্রামে বসবাস করে তারা বঞ্চিত হবে। তাই আমার কাছে এসময় অনলাইনে ক্লাস করানোর সিদ্ধান্তটা নিতান্তই বিলাসিতা।’
যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত, তবে কার্যকারীতা নিয়ে সংশয় থেকে যায়
রাবিবুল হাসান রাকিব
বাংলা বিভাগ, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্বায়নের এ যুগে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইনে যে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। তবে এর কার্যকারীতা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। কেনানা, উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশের প্রযুক্তি খাতে এখনও সেই মানের উন্নয়ন ঘটেনি। চড়া মূল্যের ইন্টারনেটের পাশাপাশি দুর্বল গতিতো রয়েছে সেই সাথে এমন অনেক অঞ্চল আছে যেখানে কথা বলার মত ভালো মোবাইল নেটওয়ার্কের সুযোগ নেয়।
যদি কতৃপক্ষ এ সিদ্ধান্তে অটুট থাকে তাহলে সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে সকল শিক্ষার্থীর অংশগ্রহন করতে পারবে কিনা সেই বিষয়টি। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল শিক্ষার্থীর দিক বিবেচনা করতে হবে। অন্যথায়, একটি অংশ উপকৃত হবে আর বৃহৎ অংশ হয়ত অংশ নিতে পারবে না। একটা বিষয় মানতে হবে, আমরা যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করছি তাদের একটি বৃহৎ অংশ গ্রামঞ্চল থেকে আশা। ফলে যেখানে কথা বলার নেটওয়ার্ক পাওয়া দুষ্কর, সেখানে অনলাইনে ক্লাস করাটা অসম্ভব। এমন পরিস্থিতে এ উদ্যোগ আশার মুখ দেখবে বলে মনে করি না। আর যদি কার্যকর হয় তাহলে একটি বৃহৎ অংশ বঞ্চিত হবে বলে মনে করি।
শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি সামর্থ্য বিবেচনায় রাখতে হবে
সালমান শাকিল
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
মহামারি, লকডাউনের মধ্যে শিখনের নয়াপদ্ধতি অনলাইনে ক্লাস। ডিজিটাল এই উদ্যোগ যদি কার্যকর করা যায় তাহলে শিক্ষার্থীদের একরকম ডিটাচড্ হয়ে যাওয়া লেখাপড়ায় কিছুটা হলেও সংযোগ ঘটবে। শিক্ষার্থীদের একাডেমিক জ্ঞান অর্জনের বর্তমান রুদ্ধতা কেটে যেতে পারে। তবে যাদের জন্য এই আয়োজন সে আয়োজনে সকলে অংশগ্রহণের সামর্থ্য রাখে কিনা সেদিকেও বিবেচনায় রাখা দরকার বলে আমি মনে করি।
কারণ আমাদের অনেক শিক্ষার্থী ভাই বোন আছেন যাদের প্রযুক্তি সামর্থ্য নেই। অধিকাংশই গ্রামে যাদের নেটওয়ার্ক পাওয়া নিয়েই অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। সেখানে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে অনলাইন ক্লাসে উপস্থিত হওয়াটা একরকম কষ্টসাধ্য। তাই সামর্থ্যরে উপর দৃষ্টি রেখে বেশিরভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে যাতে অনলাইন ক্লাসের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা যায় সেই দিকটা বিবেচনায় রাখতে বলবো।