দেশে করোনা চিকিৎসায় গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের অন্তর্ভুক্তি জরুরী

  © টিডিসি ফটো

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) এর তান্ডবে বিশ্বব্যাপী যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তার প্রধান কারণ এই ভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণ ক্ষমতা এবং কার্যকর ঔষধ বা প্রতিষেধক না থাকা। আধূনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে এই মহামারীতে, যা আগে কখনো ঘটেনি। উন্নত রাষ্ট্রের সর্বাধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে অকার্যকর প্রমানিত করে এই ভাইরাস বিশ্বজুড়ে আতংক ছড়িয়েছে।

আর এই পরিস্থিতিতে তৃতীয় বিশ্বের একটি জনবহুল দেশ হিসাবে বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে মারাত্মক ভাবে, প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। এদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর সাধারন মানুষের আস্থার অভাব রয়েছে আগে থেকেই তার অন্যতম কারণ কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত না করতে পারা। আর তা নিশ্চিত করতে হলে ডাক্তার, নার্স ও হেল্থ টেকনোলজিস্টদের পাশাপাশি প্রয়োজন গ্র্যাজুয়েট হসপিটাল বা ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্টদের, যারা নিশ্চিত পারবে ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর নির্দেশনা মতেও প্রত্যেক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে যেখানে কোনো শক্তিশালী ওষুধ ব্যবহার করা হবে সেখানে ফার্মাসিস্ট থাকা বাধ্যতামূলক।

কিন্তু এই অতিগুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য বাংলাদেশে সরকারী হাসপাতাল গুলোতে আজ পর্যন্ত নিয়োগ হয়নি কোন গ্র্যাজুয়েট হসপিটাল বা ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্টের, বেশীর ভাগ বেসরকারি হাসপাতালে নেই তাদের কাজের সুযোগ। যার ফলে সাধারণ জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে কার্যকর ও নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা থেকে যা মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম।

কোভিড-১৯ চিকিৎসায় বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত কোন কার্যকর ও নিরাপদ ঔষধ না থাকায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ রোগ চিকিৎসায় কিছু ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে সেখানে ওষুধের ব্যবহার সম্পর্কিত নীতিমালা, ওষুধের ব্যবহারবিধি, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা দেওয়া এবং ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চিকিৎসকদের সহায়তায় তাদের সাথে কাজ করছে অভিজ্ঞ গ্র্যাজুয়েট ক্লিনিক্যাল বা হসপিটাল ফার্মাসিস্টরা। বিশেষ করে কিছু কিছু মুমূর্ষু রোগীর ক্ষেত্রে আইসিইউ (ICU) ব্যবহার করা হয়, এই জটিল পরিস্থিতিতে কোন কার্যকর ও নিরাপদ ঔষধ না থাকায় রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে বিভিন্ন ডোজ ও রুটে বিভিন্ন ওষুধের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ, তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ এবং সেই অনুযায়ী নিরাপদ ঔষধের ব্যবহারের মত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে ক্লিনিক্যাল বা হসপিটাল ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

উন্নত বিশ্বের আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় রোগ নির্ণয়ে ডাক্তারা মূখ্য ভূমিকা পালন করলেও রোগ নিরাময়ের ওষুধের ব্যবস্থাপত্র থেকে শুরু করে ওষুধের ডোজ ও রুট নির্ধারণ, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ এবং তার চিকিৎসা, সর্বোপরি ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহারে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও পাকিস্তানেও রোগীর কার্যকর ও নিরাপদ চিকিৎসায় গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

ইন্টারন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল ফেডারেশন (আইপিএফ) তথ্য মতে বিশ্বে প্রায় ২৮ লাখ রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট আছে যার ৭৫ শতাংশ কমিউনিটি ফার্মাসিস্ট, ১৩ শতাংশ হসপিটাল ফার্মাসিস্ট এবং বাকী ১২ শতাংশ ওষুধ কোম্পানিসহ বিভিন্ন শাখায় নিয়োজিত। অথচ আমাদের দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট ওষুধ তৈরী, ফর্মূলেশন, মাননিয়ন্ত্রন ও বিপণন কাজে নিয়োজিত। দেশের হাসপাতাল গুলোতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের দায়িত্ব পালন করার সুযোগ খুবই সীমিত, ফলে দেশের মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে পূর্নাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা থেকে।

করোনাভাইরাসের মত পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ হাঁটছে তার সেই চির চেনা পূর্বের পথেই। আমরা দেখছি কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে গাইড লাইন তৈরী করেছে সেটি রাখা হয়নি কোন অভিজ্ঞ ফার্মাসিস্ট প্রতিনিধিকে। এমনকি ফার্মাসিস্ট প্রতিনিধিকে রাখা হয়নি করোনা ভাইরাস চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে যে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটিতে। সেখানে ফার্মাসিস্ট প্রতিনিধি থাকলে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতো এই মহামারী মোকাবিলায়। কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় প্রয়োজন এই সেক্টরের সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টার কারন এই ভাইরাস প্রতিনিয়ত মিউটেশনের ফলে পরিবর্তন করছে তাদের বৈশিষ্ট্যের এবং নতুন নতুন রূপে আরও ভয়াবহতার আভাস দিচ্ছে বিশ্বজুড়ে। কিন্তু বিশেষজ্ঞ গ্র্যাজুয়েট ক্লিনিক্যাল বা হসপিটাল ফার্মাসিস্ট ছাড়া বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর মতো জটিল রোগ চিকিৎসায়, নতুন ওষুধের পরীক্ষামূলক ব্যবহারে ওষুধের ব্যবহারবিধি, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার কিভাবে নিশ্চিত হবে মেডিসিন শাস্ত্রের ছাত্র হিসাবে আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।

আমেরিকার সেন্টারস্ ফর ডিজিস কন্ট্রোল ও প্রিভেনশন (সিডিসি) নিদের্শনাতেও উল্লেখ রয়েছে কার্যকর ও নিরাপদ ওষুধ ব্যবহারে ফার্মাসিস্টদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা। এমনকি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেল্থ (NIH) এর প্রকাশিত কোভিড-১৯ চিকিৎসার গাইডলাইনেও সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে ফার্মাসিস্টসহ বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞদের প্যানেল যার মাধ্যমে নিশ্চিত হবে রোগীদের সুচিকিৎসা।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশের মানুষের সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে দায়বদ্ধ, তাই তাদের উচিত সকল বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি পরামর্শক কমিটি তৈরী করে দেশে মানুষের স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়নে নতুন নতুন কর্মপরিকল্পনা তৈরী করা। এই দুর্যোগকালীন সময়ে সরকার জরুরী ভিত্তিতে দুই হাজার ডাক্তার ও ছয় হাজার নার্স নিয়োগের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাকে সাধুবাদ জানাই। সেই সাথে সরকারে কাছে আবেদন জানাই রোগীদের যথার্থ ও পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার স্বার্থে জরুরী ভিত্তিতে সরকারী হাসপালগুলোতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ করে নতুন নতুন ওষুধের যৌক্তিক ও নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করা।

ইতিমধ্যে সরকার ২০১৮ সালের মার্চ মাসে একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রত্যেক হাসপাতালে গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগের (গ্রেড-৯) যোগ্যতা কি হবে তা নির্ধারণ করে দেয় এবং সে অনুযায়ী সরকার থেকে হাসপাতালগুলোতে কতজন গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট প্রয়োজন তার একটি তালিকা চাওয়া হয় কিন্তু তার পরবর্তীতে এ বিষয়ে কোন অগ্রগতি আর চোখে পড়েনি। তাই এ সংকটময় মুহূর্তে প্রয়োজন স্বাস্থ্যসেবায় মানুষের আস্থা তৈরী করতে গ্র্যাজুয়েট হসপিটাল বা ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্টসহ প্রয়োজনীয় জনবল নিশ্চিত করে দেশের সাধারন মানুষের কার্যকর, নিরাপদ ও পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সেবা প্রদান করা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ফার্মেসী বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: nk.kundubd@yahoo.com


সর্বশেষ সংবাদ