জরুরি আইনে কি শুধু করোনা সংক্রমণের হার কমানো সম্ভব?
- মোঃ হাসান তারেক
- প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২০, ১২:২৫ PM , আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২০, ১২:২৫ PM
সারাবিশ্বের এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় করোনাভাইরাস। সকলে এখন সদাব্যস্ত এই কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধের উপায় অনুসন্ধান নিয়ে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার কমানোর এখন পর্যন্ত কার্যকর পন্থা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিতকরণ। সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিতকরণের জন্য সারাবিশ্বে এখন লকডাউন অবস্হা বিরাজ করছে। তবে, এই লকডাউনকে কার্যকর করতে কমবেশি সবদেশই বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে। সাধারণ জনগণকে ঘরে রাখতে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন নীতির অনুসরণ করছে।
বিশ্বের ৮৪টির মত দেশ লকডাউন অবস্থাকে কার্যকর করার জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেছে। হয়ত বা করোনার মত বৈশ্বিক মহামারি প্রতিরোধের জন্য এটি এখন কার্যকর হয়েছে। তবে, অনেক ক্ষেত্রে জরুরি অবস্হা এবং জরুরি আইন হিতে-বিপরীত হয়ে যেতে পারে। যেসকল দেশে গণতন্ত্রের ভিত নড়বড়ে সেসকল দেশে জরুরি আইন আত্নঘাতী হয়ে উঠতে পারে।
উদাহারণ হিসাবে, হাঙ্গেরীর কথায় বলা যেতে পারে। হাঙ্গেরীর প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান ক্ষমতার ভারসাম্য নসাৎ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন অনেক সময় ধরে। এক্ষেত্রে, নতুন জরুরী আইন তার একটি সুন্দর সুযোগ করে দিয়েছে। এই বির্তকিত আইনে বলা হয়েছে, কোয়ারেন্টিন কেউ না মানলে ৮ বছর এবং কেউ গুজব ছড়ালে ৫ বছর পর্যন্ত কারাগারে থাকতে হবে। এই কারণে, হাঙ্গেরীতে স্বাধীন মতামত প্রকাশ ও সাংবাদিকতা হুমকির মুখে পড়বে। পার্লামেন্ট অনুমোদিত এই জরুরি আইনটি অনিদিষ্টকালের জন্য করা হয়েছে। এই আইনের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচ্চ গণতন্ত্রের ক্লাব সদস্য হাঙ্গেরী এখন টেগো বা সার্বিয়ার মত অনগ্রসর ভূমিকায় অবর্তীণ হলো।
সারাবিশ্বের মানুষ এখন ভীত। সকলেই চাইছে এখন নিরাপত্তা। জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষার নামে দমনমূলক আইন জারি করে সকলেই তার শক্তি বৃদ্ধি করতে চাইছে। বড় জনসমাগম হতে পারে করোনা সংক্রমণের কারণ, এজন্য উদারদেশগুলো এগুলো এড়িয়ে চলছে। এই মহামারির কারণে, বলিভিয়ার নিবার্চন স্থগিত করা হয়েছে। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট বিরোধীদলকে দমনের জন্য ব্যবহার করছে এই জরুরি আইনকে। টেগোতে রিলিফ দেওয়া হচ্ছে শুধুমাত্র সরকারের অনুসারিদের। অনেক দেশে সংখ্যালঘুদের দমনের অস্ত্র হিসাবেও ব্যবহার করা হচ্ছে এই মহামারির জরুরি আইনকে। এই রোগের জন্য গুজব হতে পারে আরো বেশি ক্ষতিকর। এজন্য, অনেক দেশ গুজব প্রতিরোধের নামে গঠনমূলক সমালোচনা প্রতিরোধ করছে।
জিম্বাবুয়েতে মিথ্যা রটানোর অপরাধে ২০ বছরের কারাদণ্ডের আইন করা হয়েছে। লিবিয়ার যুদ্ধবাজ শাসক খলিফা হাফতার ঘোষণা করেছেন যারা সরকারের সমালোচনা করবেন, তারা দেশদ্রোহী হিসাবে বিবেচিত হবে। জর্ডান, ইয়েমেন, ওমান ভাইরাস বিস্তারের মাধ্যম হিসাবে পত্রিকাকে বিবেচিত করে, পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ করেছে । ক্ষমতালোভী শাসকগণ এই জরুরি আইনকে ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে। কিন্তু, জরুরি আইন জারি সত্ত্বেও এসকল দেশ করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সক্ষম হয়নি।
পক্ষান্তরে, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সফলতা দেখিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, তাইওয়ান। করোনার প্রথম সংক্রমণস্থল চীনের নিকটবর্তী হওয়া সত্ত্বেও তারা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম রাখতে পেরেছে। কেন পেরেছে জানেন কি? প্রথমত, চীনে যখন সংক্রমণ ঘটেছিল তারা তখন এটিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। দ্বিতীয়ত, তারা জনগণকে আতঙ্কিত হতে না দিয়ে আশ্বস্ত করেছিল। তৃতীয়ত, এসকল দেশে জনগণ ও সরকারের মধ্য স্বচ্ছতার সর্ম্পক বিরাজমান। জরুরি অবস্থা বা আইনের চেয়ে কার্যকরী হতে পারে জনগণ ও সরকারের সদিচ্ছা। নতুবা, কোন জরুরি আইনেই পারবে না প্রতিরোধ করতে এই কোভিড-১৯ কে।
উন্নয়নশীল দেশগুলো সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিতে হিমশিম অবস্থার সম্মুখীন। এই দেশগুলোর উচিত হবে, সকল দরিদ্রের জন্য বিশ্বাসযোগ্য পন্থার মাধ্যমে খাদ্য ও প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রদান নিশ্চিতকরণ। কেননা, লকডাউন ভেঙ্গে যারা বের হচ্ছেন তারা খাদ্য ও জীবিকার চিন্তায় বের হচ্ছেন। এ কারণে, এই দেশগুলোর উচিত হবে, জনগণকে এসকল বিষয়ে আশ্বস্ত করা। পাশাপাশি, জনগণের উচিত হবে দেশকে ভালোবেসে ব্যক্তি পর্যায় থেকে প্রত্যেকেই সচেতন হয়ে এই ভাইরাস প্রতিরোধ যুদ্ধে এগিয়ে আসা। জনগণকে বুঝতে হবে, এই যুদ্ধ আমার, আপনার,সবার। নতুবা, জরুরী অবস্থা কেন কোন ধরনের টোটকায় কাজে আসবে না। কেননা, লাঠির ভয় দেখিয়ে মানুষকে বেশিদিন যে ঘরে আটকে রাখা যায় না তা প্রমাণিত সত্য। ভালোবাসা, সচেতনতা, আস্হার সর্ম্পক হতে পারে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের পন্থগুলোকে কার্যকর করার শক্তিশালী অস্ত্র।
লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা