করোনার বিস্তার রোধে কার্যকর ড্রাগের অনুসন্ধানে মরিয়া বিশ্ব

  © টিডিসি ফটো

চীনের উহানে প্রথমে শনাক্ত হওয়া নভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের প্রায় সব দেশ ও অঞ্চলে। এতে প্রতিনিয়ত মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যাও। ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর এখানেও বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা।

জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সিস্টেমস সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসএসই) প্রদত্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে কোভিট-১৯ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ১৯ লাখ ২১ হাজার ৩৬৯ জন ও মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ১৯ হাজার ৭৩০ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০ মার্চ, ২০২০ তারিখে নতুন করোনাভাইরাস দ্বারা শ্বসনতন্ত্রের মারাত্মক রোগের চিকিৎসা খুঁজতে মানবদেহে ব্যাপক বিশ্বব্যাপী পরীক্ষার (large global trial) ঘোষণা দিয়েছে, যাকে ‘SOLIDARITY’ বলা হচ্ছে।

কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্তের প্রায় ১৫ শতাংশ মারাত্মকভাবে ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হয়েছে। নতুন মেডিসিন আবিস্কারে বছরের পর বছর সময় লেগে যেতে পারে বিবেচনায়, বর্তমানে বিশ্বের গবেষকগণ ও পাবলিক হেলথ এজেন্সিগুলো অন্য রোগের জন্য ইতোপূর্বে অনুমোদনকৃত ব্যাপক নিরাপদ ড্রাগগুলোর পুনঃপরীক্ষণ করছেন। তাঁরা অনুমোদিত ড্রাগগুলোর দিকেও দৃষ্টিপাত করছেন যা ইতোপূর্বে প্রাণীদেহে স্ট্যাডিজতে অন্য দুইটি মারণ করোনাভাইরাস, SARS-CoV (severe acute respiratory syndrome-CoV) ও MERS-CoV (Middle East respiratory syndrome-CoV) রোধে ভালো ফল দিয়েছিল (সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সায়েন্স’)।

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক দৈনিক পত্রিকা গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক বছর ধরেই বিভিন্ন করোনাভাইরাস মানুষের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করেছে। সার্স-কোভ ও মার্স-কোভ—এ দুটি ভাইরাসের সঙ্গে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত ও একই গোত্রের। ল্যানসেট জার্নাল এবং দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন নামক দুইটি জার্নালের প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, SARS-CoV ভাইরাস ২০০২-২০০৩ সালে চীনের গুয়াংডং প্রদেশে ও MERS-CoV ভাইরাস ২০১২ সালে মধ্যেপ্রাচ্যে মহামারি সৃষ্টি করেছিল।

ওষুধগুলো যদি কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস সার্স-কোভ-২ কে নির্মুল বা বিস্তার ধীর করতে পারে, মারাত্মক অসুস্থ ব্যক্তির জীবনাশঙ্কা কেটে যাবে, এমনকি সংক্রমণের বড় ঝুঁকিতে থাকা স্বাস্থ্যকর্মীদের রক্ষার জন্য prophylactically (রোগ আক্রমণ এড়াইবার জন্য চিকিৎসা হিসেবে) কাজ করবে। বিজ্ঞানীরা বিদ্যমান প্রায় এক ডজন ওষুধ পরীক্ষার জন্য সুপারিশ করেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সায়েন্স’ প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিদ্যমান চারটি সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ওষুধ পরীক্ষার জন্য গুরুত্ব দিচ্ছেন। সেগুলো হলো-১) এন্টিভাইরাল কমপাউন্ড রেমডেসিভির (Remdesivir); ২) ম্যালেরিয়ার ওষুধ ক্লোরোকুইনিন ও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনিন (Chloroquine and Hydroxychloroquine); ৩) অ্যান্টি-এইচআইভি (Anti-HIV) কমবিনেশন ড্রাগ লোপিনাভির (Lopinavir) ও রিটোনাভির (Ritonavir); এবং ৪) অ্যান্টি-এইচআইভি কমবিনেশন ড্রাগ লোপিনাভির ( Lopinavir) ও রিটোনাভির (Ritonavir) প্লাস ইন্টারফেরন-বেটা (Interferon-beta)।

এইচআইভি কম্বো (HIV combo) ইতোমধ্যে চীনের একটি ছোট গবেষণায় মারণ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সফলতা না দেখালেও, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করছে, অধিকতর বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যাপক মানুষের মধ্যে পরীক্ষা করলে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

রেমডেসিভির (GS-5734)
রেমডেসিভির ড্রাগ (রাসায়নিক নাম GS-5734) মূলত ইবোলা ও সংশ্লিষ্ট ভাইরাসগুলোকে প্রতিহত করতে আমেরিকার জিলেড সায়েন্সেস কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়েছিল। রেমডেসিভির ড্রাগ ভাইরাসের রেপ্লিকেশনের (অনুলিপন) প্রধান এনজাইম RNA-dependent RNA polymerase কে বাধাগ্রস্থ করে ভাইরাসের বংশ বিস্তার বন্ধ করে। কিন্তু গবেষকগণ ২০১৯ সালে কঙ্গোতে ইবোলা প্রাদুর্ভাবের সময় রেমডেসিভির ড্রাগের প্রভাব খুঁজে পাননি (সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সায়েন্স’)। অন্যদিকে, সায়েন্স ট্রান্সলেশনাল মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় গবেষকগণেরা দেখিয়েছেন, টেস্ট টিউবে সেল কালচার ও ইদুরের দেহে পরীক্ষায় GS-5734 (রেমডেসিভির ড্রাগ) সার্স ভাইরাসের রেপ্লিকেশন এনজাইমকে বাধাগ্রস্থ করে ভাইরাসের বংশবিস্তার ব্যহত করতে সক্ষম হয়েছিল। সম্প্রতি সেল রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় পেট্রি ডিশে (in vitro) রেমডেসিভির প্রবলভাবে SARS-COV-2 ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিহত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউ সি ডেভিস মেডিক্যাল সেন্টারের রোগ সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ জর্জ থমসন কোভিড-১৯ এ মারাত্মক আক্রান্ত একজন রোগীকে রেমডেসিভির ড্রাগ দিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করেছেন। রোগ সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ জর্জ থমসন প্রথমে ভেবেছিলেন, রোগীটি মারা যাবে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মেডিক্যাল নিউজ সাইট ‘স্টাট’ সম্প্রতি রিপোর্ট করেছে, রেমডেসিভির কোভিড-১৯ রোগের সংক্রমণ হ্রাস করতে পারে কিনা- এ বিষয়ে বর্তমানে যুক্তরাস্ট্র ও চীনে পাঁচটি ক্লিনিকাল পরীক্ষা (ক্লিনিকাল ট্র্যায়াল) চলছে। বিশ্বের অনেক ডাক্তার কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় রেমডেসিভির সম্ভাবনায় উদ্দীপিত, যদিও এখনও গবেষণার স্তরেই রাখা হয়েছে রেমডেসিভিরকে।

ক্লোরোকুইনিন ও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনিন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৩ মার্চ, ২০২০ তারিখে কোভিড-১৯ বিস্তার রোধে অনেক দেশে্র ক্লোরোকুইনিনের প্রতি আগ্রহ ও মনোযোগ বিবেচনা করে অধিকতর পরীক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দেন। এই দুইটি ড্রাগস কিছু ভাইরাসের মানুষের কোষে প্রবেশ পথে বাধার সৃষ্টি করে (সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সায়েন্স’)। কিন্তু কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী সার্স-কোভ-২ ভাইরাস ভিন্নভাবে তার বাহিরের আবরণের স্পাইক প্রোটিনের সাহায্যে মানুষের শ্বসনতন্ত্রের এপিথেলিয়াল কোষের রিসেপটরের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে বংশ বিস্তার করে (সূত্রঃ ৩০ মার্চ, ২০২০ তারিখের বিশ্বখ্যাত ‘ন্যাচার’ জার্নাল)। তবে, ২০০২-২০০৩ সালের মহামারির জন্য দায়ী SARS-CoV ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার রোধে ক্লোরোকুইনিন কার্যকর হয়েছিল (সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক চিকিৎসা সাময়িকী ‘লাইভসায়েন্স’)। ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০২-২০০৩ সালের মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-CoV ও ২০১৯-২০২০ সালের মহামারি কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস SARS-COV-2 এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ জেনেটিক ও গাঠনিক সম্পর্ক আছে। ল্যাবরেটরিতে সেল কালচার স্ট্যাডিজ অনুযায়ী, ক্লোরোকুইনিনের সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কিছু সক্রিয়তা আছে কিন্তু তা উচ্চ মাত্রা প্রয়োগে দেহে মারাত্মক বিষক্রিয়ার (serious toxicities) কারণ হতে পারে (সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সায়েন্স’)। ল্যাবরেটরিতে সেল কালচার স্ট্যাডিজ ব্যক্ত করেছে, ক্লোরোকুইনিন ও তার ডেরিভেটিভ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনিন সার্স-কোভ-২ নভেল ভাইরাসের রেপ্লিকেশন ধ্বংসের মাধ্যমে এর বংশ বিস্তার রোধ করতে সক্ষম (সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক চিকিৎসা সাময়িকী ‘লাইভসায়েন্স’)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উল্লেখ করেছে, চীনে ক্লোরোকুইনিন ও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনিন ড্রাগস ব্যবহার করে কোভিড-১৯ সম্পর্কে ২০টির বেশি ট্র্যায়াল/পরীক্ষা হয়েছে কিন্তু চীন উক্ত গবেষণাগুলোর ফলাফল প্রকাশ করে নাই। এ বিষয়ে চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে ভবিষ্যতে অধিকতর সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইউ এস সোসাইটি অফ ক্রিটিক্যাল কেয়ার প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, মারাত্মক অসুস্থ কোভিড-১৯ রোগীদের ক্লোরোকুইনিন ও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনিন ব্যবহারের উপকারের বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রমাণ নাই। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের ডাক্তারেরা সুফলের প্রত্যাশ্যায় কিছু কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসায় ক্লোরোকুইনিন ব্যবহার করছেন (সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক চিকিৎসা সাময়িকী ‘লাইভসায়েন্স’)। বিশ্বের ওষুধ অনুমোদনকারী সংস্থা এফডিএ (ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন) আনুষ্ঠানিকভাবে ক্লোরোকুইনিন ও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনিনের ক্লিনিক্যাল ট্র্যায়াল/পরীক্ষার উদ্দ্যেগ নিয়েছে্ন। ইউনিভার্সিটি অফ কালিফোর্নিয়ার রোগ সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ ডেভিড স্মিথ বলেন, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনিনের অনেক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সহ কিছু ক্ষেত্রে হৃদরোগে ক্ষতিকর প্রভাব আছে। যেহেতু হৃদরোগ থাকলে কোভিড-১৯ মারাত্মক হতে পারে, সেকারণে হৃদরোগীদের জন্য হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনিনের ব্যবহারে সতর্কতা প্রয়োজন। রোগ সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ ডেভিড স্মিথ আরোও গবেষণার বিষয়ে গুরুত্ব দেন।

রিটোনাভির ও লোপিনাভির কমবিনেশন
Anti-HIV (Anti-human immunodeficiency virus) কমবিনেশন ড্রাগ রিটোনাভির ও লোপিনাভির ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে HIV সংক্রমণ চিকিৎসায় অনুমোদিত হয়েছিল। ভাইরাস বংশবিস্তারের সময় HIV এর প্রোটিয়েজ নামক গুরুত্বপূর্ন এনজাইমকে বাধাগ্রস্থ করে প্রোটিন ভাঙাকে বন্ধ করতে এই কমবিনেশন ড্রাগ খুবই কার্যকর। এই কমবিনেশন ড্রাগ অন্যান্ন ভাইরাসের বিশেষভাবে করোনাভাইরাসের প্রোটিয়েজ এনজাইমকেও বাধাগ্রস্থ করতে পারে। দ্য জার্নাল অফ ইনফেকশাস ডিজিজেসের প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধে জানা গেছে, রিটোনাভির /লোপিনাভির কমবিনেশন ড্রাগ MERS করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে কার্যকর ছিল। তবে চীনে উহান শহরে প্রথম ট্রায়ালে কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে এই কমবিনেশন ড্রাগের কার্যকারিতা আশাপ্রদ ছিল না। দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন এ প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধে জানা গেছে, হাসপাতালে মারাত্মক কোভিড-১৯ আক্রান্ত ১৯৯ জন রোগীকে রিটোনাভির /লোপিনাভির কমবিনেশন ড্রাগ দিয়ে চিকিৎসায় কোন সুফল পাওয়া যায় নাই। উহানের উক্ত গবেষণায় গবেষকগণ অনুমান করছেন, এই কমবিনেশন ড্রাগের চিকিৎসা অনেক দেরীতে রোগীদের মারাত্মক ক্রিটিকাল অবস্থায় আরম্ভ হওয়ায় সুফল আসে নাই। গবেষকগণ ভবিষ্যতে এ সংক্রান্ত আরোও গবেষণার সুপারিশ করেছেন। কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে এই ড্রাগ কমবিনেশনের কার্যকারিতা সংক্রান্ত গবেষণা অব্যাহত আছে। ধারণা করা হচ্ছে, রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে এটি ভালো কাজ করবে (সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক চিকিৎসা সাময়িকী ‘লাইভসায়েন্স’)।

রিটোনাভির /লোপিনাভির এবং ইন্টারফেরন-বেটা কমবিনেশন
দ্য জার্নাল অফ ইনফেকশাস ডিজিজেসের প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধে জানা গেছে, রিটোনাভির/লোপিনাভির এবং ইন্টারফেরন-বেটা কমবিনেশন ড্রাগ MERS করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে কার্যকর ছিল। ইন্টারফেরন-বেটা রোগ প্রতিরোধে মেসন্জর (বার্তাবাহক) হিসেবে কাজ করে যা ভাইরাসকে বিকল করতে সহযোগিতা করতে পারে। তবে ইন্টারফেরন-বেটা কমবিনেশন মারাত্মক আক্রান্তদের দেহে প্রয়োগে উপকারে পরিবর্তে দেহের কোষের ড্যামেজ ঘটতে পারে। সম্প্রতি ‘ট্রায়ালস’ জার্নালের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সৌদি আরবে এই তিনটি ড্রাগের (রিটোনাভির /লোপিনাভির এবং ইন্টারফেরন-বেটা) সমন্বয়ে প্রথম মার্স-কোভ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা (কন্ট্রোল ট্রায়াল) চলছে।

অন্যান্য সম্ভাব্য ড্রাগ
জাপানী কোম্পানি ফুজি ফিল্মের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান তোয়ামা কেমিক্যাল ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসার জন্য তৈরি করেছিল ‘ফ্যাভিপিরাভির’। এই ওষুধটির ব্র্যান্ড নাম অ্যাভিগান। ফার্মাসিউটিক্যাল টেকনোলজি নিউজ সাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ঝাং শিনমিন বলেছেন, জাপানের এন্টি-ফ্লু ড্রাগ ফ্যাভিপিরাভির কোভিড-১৯ নিরাময়ে কার্যকর হবে। চীনের উহান ও শেনজেন শহরে করোনায় সংক্রমিত ৩৪০ জন রোগীর ওপর প্রয়োগ করে আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া গেছে। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চীনের কর্মকর্তা ঝাং শিনমিন বলেন, ‘ওষুধটি যথেষ্ট নিরাপদ এবং রোগ সারাতে নিশ্চিতভাবে এটি কার্যকর।’ এই ড্রাগটি ভাইরাসের রেপ্লিকেশন বাধাগ্রস্থ করে বংশ বিস্তার ব্যহত করে এবং আক্রান্ত মানুষের ফুসফুসের উন্নতি ঘটায়। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক চিকিৎসা সাময়িকী ‘লাইভসায়েন্স’ জানিয়েছে, ফ্যাভিপিরাভির অন্তত মৃদু থেকে মাঝারি কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসায় সম্ভাবনাময় ড্রাগ। জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, যেসব রোগীর অবস্থা জটিল, তাঁদের জন্য এ ওষুধটি কার্যকর নয়।

কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস সার্স-কোভ-২ মানুষের কোষের এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং-এনজাইম-২ (এসিই-২) রিসেপটরের সাথে যুক্ত হয়ে সংক্রমিত করে। উচ্চ রক্তচাপ নিরোধক ওষুধ ‘লোসারটান’ একই রিসেপটর ব্লক করে বিধায়, তা (লোসারটান) মানবদেহ কোষে করোনাভাইরাস সংক্রমণে বাধাগ্রস্থ করার সম্ভাবনা আছে। (সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক চিকিৎসা সাময়িকী ‘লাইভসায়েন্স’)। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের উপর এই উচ্চ রক্তচাপ নিরোধক ওষুধের প্রভাব জানতে দুইটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালু করেছে।

অতি সম্প্রতি ৬ এপ্রিল ২০২০ তারিখের সায়েন্স ট্রান্সলেশনাল মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধে জানা গেছে, বিস্তীর্ণ স্পেক্ট্রমের এন্টি-ভাইরাল ড্রাগ ‘EIDD-2801’ এর কোভিট-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাসসহ অন্যান্য করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সক্ষমতা আছে। মার্চ, ২০২০ মাসে অনুষ্ঠিত ক্লিনিক্যাল ট্র্যায়ালে দেখা গেছে, ‘EIDD-2801’ ড্রাগটি SARS-CoV-2 ভাইরাসকে রোধ করতে ‘রেমডেসিভির’ ড্রাগের চেয়ে অধিকতর কার্যকর।

বর্তমানে বিশ্বে কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসা অনুসন্ধানে দুই শতাধিক ক্লিনিক্যাল ট্র্যায়াল চলছে। ফলপ্রসূ দ্রুত চিকিৎসার স্বার্থে ক্লিনিক্যাল ট্র্যায়ালে হাজার হাজার রোগীকে অন্তর্ভূক্ত করাসহ সম্ভাবনায় ড্রাগগুলোকে বিবেচনায় নেওয়া হবে বলে জানা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দুইটি সাময়িকী ‘সায়েন্স’ ও ‘লাইভসায়েন্স’ জানিয়েছে, নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার মন্থরের ও কার্যকর চিকিৎসার উপায়গুলো খুঁজতে বিশ্বের গবেষকগণ মরিয়া হয়ে উঠেছেন।

লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মেইল: drmaasgar@gmail.com 


সর্বশেষ সংবাদ