পথ হারিয়ে ধুঁকছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
- সাইফুল ইসলাম
- প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১২:১২ PM , আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১২:৪৪ PM
উন্মুক্ত চিন্তা-চেতনার উন্মেষ, মেধাবিকাশ ও বুদ্বিভিত্তিক চর্চা প্রয়োগের উৎকৃষ্ট কেন্দ্র হলো বিশ্ববিদ্যালয়। নতুন নতুন জ্ঞান ও ধারণা বিতরণ, গবেষণা ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের করা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। বিশ্ববিদ্যালয় একটি দেশের দিক নির্দেশক হিসেবে ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বাংলাদেশ সৃষ্টি ইতিহাস অন্তত তাই বলে। ১৯৪৭ এ ভারত বিভক্তি, ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬৬ এর ছয়দফা, ৭০ এর সাধারণ নির্বাচন, ৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ৯০ এর দশকে স্বৈরাচার বিরোধি আন্দোলনে বাংলাদেশকে পথ দেখিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪৫ টি। বেসরকারী বিশ্ববদ্যিালয় শতাধিক। দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ক্রমেই বাড়লেও শিক্ষার মানে তেমন পরিবর্তন আসেনি। চাকরী কেন্দ্রিক পড়াশুনা আর দলাদলিতে মূল জায়গা থেকে সরে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। নামে বিশ্ববিদ্যালয় হলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হতে ব্যর্থ হয়েছে। নব্বইয়ের দশকের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হতে শুরু করে। যা বর্তমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে যেসব তথ্য উঠে আসছে তার সিংহভাগই নেতিবাচক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলাদলি, নিয়োগ বাণিজ্য, তোষামোদী, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দলীয়করণসহ বিভিন্ন গর্হিত কর্মকান্ড নিত্যসঙ্গী হয়েছে। গবেষণার পরিবর্তে শিক্ষকরা ব্যস্ত দলাদলিতে। যার প্রভাব পড়েছে শিক্ষার্থীদের উপর। সৃজনশীলকর্মে শিক্ষার্থীদের পদচারণা সন্তোষজনক নয়। ভর্তি হয়েই ছাত্ররা রাজনৈতিক পরিমন্ডলে ঝুঁকে পড়ছে। ফলে, রাজনীতির চেয়ে ক্যাম্পাসগুলোতে অপরাজনীতির চর্চায় বেশি হচ্ছে। ছাত্র নেতারা পদবি বলে অর্থ উপার্জনে মনোনিবেশ করছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সিট বাণিজ্য, প্রশ্ন ফাঁস ও মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নেই বললেই চলে। এই পরিস্থিতি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। সর্বদিক থেকে দলীয়করণ নামক ভূত যেদিন থেকে রাজনৈতিক দলগুলোতে চেপে বসেছে সেদিনই এ সংকটের শুরু হয়েছে। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করা হতো ব্যক্তির পান্ডিত্য, দক্ষতা, নৈতিকতা ও সততা বিবেচনায়। অনেকের উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার ইতিহাসও এদেশে বিরল নয়। এখন আর সে অবস্থা নেই। কোনোভাবেই অধ্যাপক হতে পারলেই ভিসি হওয়ার স্বপ্ন বুনতে থাকেন অনেকেই। ইউজিসি, শিক্ষামন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে নিজেদের সিভি দিয়ে রাখেন তারা। এজন্য, নিজের রাজনৈতিক ও দর্শনগত চিন্তা-চেতনাকে বলি দিতে কাউকে সামান্য ইতস্ততবোধ করতেও দেখা যায় না। এখন ভিসি পদটা অর্থ উপার্জনের বড় মাধ্যমে পরিণত হয়েছে! সরকারও তাকেই নিয়োগ দিচ্ছে যাকে দিয়ে উদ্দেশ্য পূরুণ হবে। এক্ষেত্রে ব্যক্তির যোগ্যতা, দক্ষতা বা সততা মাপকাঠির পর্যায় হিসেবে বিবেচিত না হয়ে দলীয় পরিচয়ই বড় হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। এর ফলাফল নগদে পাচ্ছে জাতি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ, আত্মীকরণ, দলীয়করণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে অনিয়মের মতো তথ্য উঠে আসছে নিত্যই।
উপাচার্যদের এই ধাক্কা এসে ঠেকেছে শিক্ষকদের উপর। শিক্ষকরা ক্লাসে যতটুকু সময় দেন তার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন উপাচার্য ও রাজনৈতিক মহলকে সন্তুষ্ট করার ক্ষেত্রে। তাদেরও লক্ষ্য কিভাবে অধিক অর্থ উপার্জন করা যায়! অনেকে আবার শিক্ষকতার পাশাপাশি এনজিওতেও চাকরি করছেন। উপাচার্য-শিক্ষক এমন হলে শিক্ষার্থীরা কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়। যার উদাহরণ সবচেয়ে বৃহদাকারে চিত্রিত হয়েছে বিগত দুই মাসে।
সম্প্রতি বিভিন্ন অনৈতিক অভিযোগের কারনে পদচ্যুত হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা। তাদের বিরুদ্ধে কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ। আওয়ামীলীগের সভাপতি শেখ হাসিনা তাদেরকে এ দুই পদে আসীন করেছিলেন। অল্প দিনের ব্যবধানে তিনিই তাদেরকে দ্বৈত্য হিসেবে অবহিত করেছেন। সারাদেশব্যাপী ছাত্রলীগ নেতারা কি করছেন তা কারোই অজানা নয়। ছাত্রলীগের সাথে পাল্লা দিয়ে আলোচনায় রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর মো. আখতারুজ্জামান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ফারজানা ইসলাম এবং বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর খোন্দকার নাসির উদ্দীন।
ডাকসুর কলুষিত নির্বাচন, চিরকুটে ভর্তির সুপারিশ করাসহ বিভিন্ন কারনে বিতর্কিত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। সম্প্রতী শিক্ষার্থীরা তার পদত্যাগের দাবিতে ঝাড়ূ মিছিল করেছেন, চিরকুট ভিসি হিসেবে নামকরণ করেছেন। অন্যদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেংকারীর খবর পরিবেশিত হয়েছে। এ সংক্রান্ত একাধিক ফোনকলের অডিও ভাইরালও হয়েছে। যেখান থেকে উপাচার্যকে নিষ্পাপ ভাবার কোনো উপায় নেই। একজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে ছাত্রনেতাদের কোটি টাকা প্রদানের অভিযোগ! ভাবতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কি হচ্ছে? অন্যদিকে, এক ছাত্রীকে সাময়িক বহিস্কার করে গত এক সপ্তাহ থেকে আলোচনায় রয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর নাসিরউদ্দিন। গণমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য হলো:‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাজ কি’ এই বাক্যটি ফেসবুকে লিখেছিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী ও একটি দৈনিকের ক্যাম্পাস প্রতিনিধি ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া। এই বাক্যটি লিখে বিশাল অপরাধ করেছেন ওই ছাত্রী-যার শাস্তি স্বরুপ তাকে সাময়িক বহিস্কার করেছেন উপাচার্য।
বিশ্ববিদ্যালয় হলো মুক্ত চিন্তা ও মতামত প্রকাশের শ্রেষ্ঠ ক্ষেত্র। সেখানে একটি বাক্য লিখেই বহিস্কার! এটা কিন্তু প্রফেসর নাসিরউদ্দিনের প্রথম সিদ্ধান্ত নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করায় কয়েকদিন আগেও পাঁচ শিক্ষার্থীকে বহিস্কার করেছিলেন তিনি। উপরোক্ত তিন ভিসির বিভিন্ন অসংলগ্ন কর্মকান্ড দেশীয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে এসেছে। তাতে কিন্তু কারো কোনো মাথাব্যাথা নেই!
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্চাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। তাদের অপসারণের জন্য আন্দোলন হয়েছে, মাসের পর মাস ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির থেকেছে। এরপরও বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দৃশ্যত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কোনো ভিসিকে অপসারণ করা বা কারো বিরুদ্ধে শাসস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। উপরন্তু কাউকে আবার দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ দিয়ে তাকে আরও অনিয়ম করার সুযোগ দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান কেমন তা নিয়ে রয়েছে নানান প্রশ্ন। দেশে প্রায় অর্ধশত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে স্থান পায়নি একটিও। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যে নতুন জ্ঞান ও ধারণা সৃষ্টি এবং বিতরণের কথা তা আজ বহুলাংশে অকার্যকর। ক্যাম্পাসগুলো ক্রমেই অস্থির হচ্ছে, সহিংসতা বাড়ছে। সেখানে সহনশীলতার লেশ মাত্র নেই। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। এতে, হয়তো কোনো পক্ষ ক্ষণিকের জন্য উপকৃত হচ্ছে। এর ফল কিন্তু বইতে হবে গোটা জাতিকে। আজ যারা এই পরিস্থিতি থেকে সুবিধা পাচ্ছেন একদিন তাদেরকেও মাশুল দিতে হবে। তাই, সময় থাকতে বৃহত্তর স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে নজর দেয়া দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গতিশীল থাকলে দেশ গতিশীল থাকবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমৃদ্ধ হলে দেশ সমৃদ্ধ হবে। পন্ডিত নেহেরু যথার্থই তাই বলেছিলেন, ‘দেশ ভালো হয়, যদি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হয়।’
লেখক: সাংবাদিক