১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫:১৮

‘নবাব স্যার সলিমুল্লাহ থেকে শহীদ শরিফ ওসমান হাদি’

শরিফ ওসমান হাদি ও অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিলাল হোসাই  © টিডিসি সম্পাদিত

(১৯০৫–২০২৫): মুসলিম জাতীয়তাবাদ বনাম বাঙালি জাতীয়তাবাদ-বাংলার মুসলমানদের রাজনীতির একশ বিশ বছরের পাঠ। ১৯০৫ সাল থেকে ২০২৫ সাল, এই দীর্ঘ একশ বিশ বছরে বাংলার মুসলমানদের রাজনীতি বুঝতে হলে একে মুসলিম জাতীয়তাবাদ বনাম বাঙালি জাতীয়তাবাদ- এই দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়েই বিশ্লেষণ করতে হবে। এই দ্বন্দ্ব কেবল রাজনৈতিক নয়; এটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও আদর্শিক।

নবাব স্যার সলিমুল্লাহ যখন রাজনীতিতে সক্রিয় হন, তখন তিনি খুব স্পষ্টভাবে দেখেছিলেন- হিন্দু প্রধান পশ্চিম বাংলা, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার ভদ্রলোক শ্রেণি, ব্রিটিশদের গোলামীকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করেছে এবং সেই গোলামির কাঠামোর ভেতর থেকেই ইসলাম ও মুসলমানদের দমন-পীড়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। পূর্ব বাংলার মুসলমানদের উপর জুলুম চালিয়ে তারা পশ্চিম বাংলায় আমোদ-ফূর্তির জীবন যাপন করছিল।

এই বাস্তবতা অনুধাবন করেই নবাব স্যার সলিমুল্লাহ পূর্ব বাংলার বাঙালিদের মুসলমান পরিচয়কে সামনে আনার জন্য কাজ শুরু করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল- অবহেলিত পূর্ব বাংলাকে শুধু ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ভেতরে নয়, বরং বিশ্বের মুসলিম সমাজের সাথে সংযুক্ত করা।

তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় (আইসিএস) পাশ করে ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছেন; তিনি সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে পারিবারিক ব্যবসা ও সমাজ সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। প্রাথমিকভাবে তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলার মুসলমানদের সন্তানদের শিক্ষিত করে তোলা। নিজ খরচে অসংখ্য ছাত্রকে কলকাতায় পড়াশোনার জন্য পাঠিয়েছেন, স্থানীয়ভাবে শিক্ষার আগ্রহ সৃষ্টি করেছেন এবং মুসলমান সমাজকে শিক্ষার দিকে ধাবিত করার চেষ্টা করেছেন।

আরও পড়ুন : হাদির জন্য প্রস্তুত তার আকাঙ্খার ‘খুবই সাধারণ একটা কফিন’

কিন্তু তিনি খুব দ্রুত বুঝতে পারেন- শুধু শিক্ষা যথেষ্ট নয়। এমন একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে, যার মাধ্যমে মুসলিম পরিচয়ের সাথে জড়িয়ে থাকা হীনমন্যতা থেকে মুসলমানদের সন্তানরা বেরিয়ে আসতে পারে। কারণ ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় স্বজাতির মানুষের হাতে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত ছিল বাঙালি মুসলমানরাই। এমনকি তথাকথিত “ভদ্রলোকদের” ছায়ায় থেকে কিছু মুসলমানও এই নিপীড়নে শরিক হয়েছিল।

এই অবস্থা থেকে মুক্তির পথ হিসেবে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ নিজ খরচে ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মোহাম্মেদান এ্যাসোসিয়েশনের কনফারেন্স আয়োজন করেন এবং পরবর্তীতে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলেন। এখানে অনেক ঘটনা সংক্ষেপে বলা হলো- বাস্তবে এই সংগ্রাম ছিল দীর্ঘ ও বহুমাত্রিক।

এই মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতার মৃত্যু ঘটে মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে। ১৯০৫ সালে তাঁর সহযোগিতা ও প্রচেষ্টায় বঙ্গভঙ্গ সফল হওয়ার পর থেকেই তিনি টার্গেটে পরিণত হন। চতুর্মুখী চাপের মাধ্যমে তাঁকে একঘরে করা হয়, পুরো নবাব পরিবারকে পরিকল্পিতভাবে অর্থনৈতিক সংকটে ফেলা হয়। এর ফলাফল ছিল তাঁর সামগ্রিক শারীরিক ও মানসিক ভেঙে পড়া এবং শেষ পর্যন্ত অকাল মৃত্যু।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুর বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়- কীভাবে একজন মুসলিম জাতীয়তাবাদী কবিকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেওয়া হয়েছিল। গত একশ বিশ বছরে মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক, কবি, সাহিত্যিক ও বিশিষ্টজনদের কখনো সরাসরি হত্যা করা হয়েছে, কখনো ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে, কখনো স্লো পয়জনিংয়ের মাধ্যমে নিঃশেষ করা হয়েছে, কখনো জেলে আটকিয়ে রেখে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, আবার কখনো নানাভাবে সামাজিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা হয়েছে। এই কাজগুলো করেছে আধিপত্যবাদী শক্তি; ব্রিটিশদের পরে এই ল্যাগাসি ভারতীয় আধিপত্যবাদীরা গ্রহণ করেছে।

আরও পড়ুন : হাদির মৃত্যুতে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের শোক 

মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র দিতে বাধ্য হয়। ১৯৪৭ সালের পর শুরু হয় মুসলমানদের সাথে ভারতীয় আধিপত্যাবাদের লড়াই। প্রথম টার্গেট পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ভেঙে দেয়া। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য- যে ইসলাম ধর্মকে ভিত্তি ধরে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরি হলো সে রাষ্ট্রের শাসক ও শাসিতরা ১৯৪৭ এর পর ইসলামের মৌলিক স্পিরিট থেকে দূরে সরে গেল। দুই পাকিস্তান এক থাকার মৌলিক শক্তির হারিয়ে গেল। জোর জুলুম এখানে স্থান করে নিলো। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ মুক্তি সংগ্রাম শুরু করলো। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয়মাসের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন হলাম। 

ভারত তার শত্রুকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে আমাদেরকে ১৯৭১ সালে সহযোগিতা করেছে। বিগত ৫৫ বছরে ভারতের রাষ্ট্র প্রধানদের স্টেটমেন্ট এবং তাদের জাতীয় চিন্তা দেখেও যদি আমরা সেটি আমরা বুঝতে না পারি তাহলে এটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য দুর্ভাগ্য। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে ভারতীয় জালে আটকে পড়ে। 

১৯৭১ সালের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠার নামে ভারতীয় আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশের বহু রাজনীতিবিদকে নানান কৌশলে নির্মূল করা হয়েছে। 

এই তালিকায় রয়েছেন : শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান; শহীদ মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী; শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম; শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী; শহীদ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী; শহীদ আবরার ফাহাদ, হাজার হাজার গুম খুন-এবং এই সারি আরও দীর্ঘ। সর্বশেষ এই কাতারে যুক্ত হলেন শহীদ শরীফ ওসমান হাদি।

বেগম খালেদা জিয়াকে কীভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে- তা আজ আর কারও অজানা নয়। এখনো আমরা দোয়া করছি, আল্লাহ যেন বেগম খালেদা জিয়াকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেন। 

প্রশ্ন হলো: শহীদ ওসমান হাদীকে কেন হত্যা করা হলো? তিনি কী বলেছেন, কী করেছেন? তিনি ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি ন্যায় ও ইনসাফের কথা বলেছেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষের সুখ-সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন।

এই কারণেই নানান মিডিয়ার মাধ্যমে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে- যারা শহীদ ওসমান হাদীর পথে হাঁটবে, তাদেরকেও হত্যা করা হবে। জুলাই বিপ্লবের নেতাদের হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অথচ গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়- জুলাই বিপ্লবীদের চাওয়ার সাথে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর চাওয়ার মৌলিক কোনো অমিল নেই; পার্থক্য ছিল কেবল টার্মিনোলজিতে। যেমন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, শহীদ মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী ও শহীদ ওসমান হাদীর চাওয়ার মধ্যেও মৌলিক কোনো তফাৎ ছিল না। 

বাংলাদেশের মুসলমানরা যতদিন এই “হত্যাযোগ্য হয়ে ওঠার ডাইনামিকস” বুঝতে না পারবে, ততদিন তারা সাবেক ব্রিটিশ কলোনিয়াল এবং বর্তমান ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও জায়নবাদের টার্গেট হওয়া থেকে রক্ষা পাবে না। ইতিহাস বলে- এই রকম কাছাকাছি ডাইনামিকসের মধ্য দিয়েই বাঙালি ও বাঙালি মুসলমানরা বিগত দেড় হাজার বছর এ অঞ্চলে টিকে আছে। ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও থাকবে।

আমরা যদি বোঝাপড়ায় পরিশুদ্ধ হতে পারি, তবে দেখব- ভারতীয় হেজিমনিক টেন্ডেন্সি বাংলাদেশে পরিপূর্ণভাবে পরাজিত হবে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার সব রাষ্ট্রে হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে, কিন্তু সব জায়গায় ব্যর্থ হয়েছে। বিগত পনেরো বছরে তাদের মদদপুষ্ট বাংলাদেশ সরকার এই হেজিমনিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল বলেই ভারতীয় আধিপত্যবাদ আমাদের ভাইবোনদের গুম-খুন করতে পেরেছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য- মুসলমানদের একটি অংশকে রাজনৈতিকভাবে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের অনুসারীতে পরিণত করা হয়েছে, যারা ক্রীড়ানক হিসেবে কাজ করছে। মনে রাখতে হবে- হিন্দুরা আমাদের ভাই। আমাদের শত্রুতা কোনো ধর্মের মানুষের সাথে নয়; আমাদের শত্রুতা তাদের সাথে, যারা সলিমুল্লাহ, জিয়াউর রহমান, নিজামী, সাঈদী, আবরার ফাহাদ ও হাদীদের হত্যা করেছে। আল্লাহ এই বঙ্গীয় বদ্বীপের মানুষকে শান্তিতে থাকার তাওফিক দিন।

লেখক : অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিলাল হোসাইন, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়