দুঃখ-সুখের দোলায় দোলে ভব নদীর পানি

ড. মো. এরশাদ হালিম
ড. মো. এরশাদ হালিম  © টিডিসি সম্পাদিত

কোন মানুষই জীবনে নিরবচ্ছিন্ন সুখ বা শান্তি ভোগ করতে পারে না। সুখ-দুঃখ জীবনে পালাক্রমে আসে। সংসার সাগরে সুখ আর দুঃখ মূলতঃ দুটি তরঙ্গের খেলা, যেখানে আশাই তার একমাত্র ভেলা। একজন মুমিনের নিকট এই আশার অবয়ব হচ্ছে কোন বিষয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টার পাশাপাশি ধৈর্য্য সহকারে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর বিশেষ রহমত বা করুণার মুখাপেক্ষী থাকা। 

মূলতঃ দুঃখ-যন্ত্রণা আল্লাহ তা'য়ালার তরফ থেকে আগত এবং বান্দার উপর আরোপিত এক পরীক্ষা মাত্র। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহর বাণী, "আমি অবশ্যই তোমাদের কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবই। মাঝে মধ্যে তোমাদের বিপদের আতঙ্ক, ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে, সম্পদ, জীবন, পণ্য, ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। আর যারা কষ্টের মধ্যেও ধৈর্য্য-নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা করে, তাদের সুখবর দাও" (সূরাঃ আল-বাক্বারাহ, আয়াতঃ ১৫৫)।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের এই বাণীকে মনে-প্রাণে ধারণ করলে বালা-মুসিবত দেখে ভেঙে পড়ার কোন সুযোগই নেই। বরং এটাকে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এক নিয়ামত মনে করে শোকরিয়া আদায় করা উচিত। এতে করে একজন মুমিনের পক্ষে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি  লাভের সুযোগ তৈরি হয়। ওজনে ভারী হয় ডান হাতের আমলনামা। অনুকূলে আসে পাপ-পূণ্যের মীযানের পাল্লা। 

মানব জীবন কুসুমাস্তীর্ন কোন ফুলশয্যা নয়। এখানে চড়াই-উতরাই থাকবেই। প্রতিটি মানুষ এভাবেই জীবন যুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। তদুপরি, দুঃখ-কষ্টকে কেউই হাসিমুখে বরণ করতে চায় না। অন্যদিকে প্রকৃতির এই চিরাচরিত নিয়মকে আমরা কোনভাবে উপেক্ষাও করতে পারি না। মূলতঃ দুঃখের পরেই সুখ নামক সোনার হরিণ ধরা দেয় যেভাবে রাতের আঁধার পেরোলে সূর্যের আলো হাতছানি দেয়। সুখ-দুঃখ এভাবেই একে অন্যের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির অস্তিত্ব কোনভাবেই কল্পনা করা যায় না। 

মূলত দুঃখ আছে বলেই সুখের এত কদর। বিষাদ আছে বলেই মানুষ হরষের পূজারি যেভাবে রাতের অন্ধকার না থাকলে দিনের আলোর প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হত না। একের পর অন্যটা আসবে-এটাই প্রকৃতির চিরাচরিত রীতি। এভাবেই একদিকে ভৌগোলিক কারণে আহ্নিক গতির মাধ্যমে পৃথিবীতে দিন-রাতের পালাবদল ঘটে মহান আল্লাহর ইশারাতে। অন্যদিকে বার্ষিক গতির কারণে হয় ষড়ঋতুর পরবর্তন এবং সৃষ্টিকূল আস্বাদন করে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের হরেক রকম স্বাদ। এটাই সৃষ্টিকর্তার আজ্ঞাবহ ভৌগলিক নিয়ম যা পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে মহান আল্লাহর ইশারাতেই সংঘটিত হয়ে আসছে।

দিনের আলো শেষ হলেই সমগ্র পৃথিবী অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। আবার রাতের অন্ধকারের যবনিকাপাত হলে ধরণীর বুকে নেমে আসে আলোর ঝলকানি। মনে হয় "আলো আমার, আলো ওগো, আলোয় ভুবন ভরা"। মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে মানবকূল পৃথিবীর বুকে পায় পথ চলার নতুন দিশা। পুলকিত হয় সর্বসস্তরের প্রাণীকূল। আলোর স্রোতে ভেসে বেড়ায় হাজারো প্রজাপতি, আলোর ঢেউয়ে মেতে ওঠে মল্লি কামালতি। 

ঠিক এভাবেই দুঃখের অমানিশা কেটে গেলে মানুষ পায় সেই সুখ নামক সোনার হরিণের আগমনী বার্তা যেভাবে বসন্তের আগমণে শীতের জরাজীর্ণতার পর প্রকৃতি পায় নতুন প্রানের ছোঁয়া। নববধূর ন্যায় ধরিত্রী সজ্জিত হয় সম্পূর্ন নতুন আঙ্গিকে যা জগতের স্বাভাবিক নিয়ম। একইভাবে দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত হওয়ার পরে যখন সুখের পরশ লাভ করে তখন আল্লাহর প্রিয় বান্দারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাদের রবের প্রদত্ত এই বিশেষ নিয়ামত ও করুণার প্রতি যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে মনের হরষে রাতের আঁধারে জায়নামাযে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে থাকার মাধ্যমে। একজন মুমিন বান্দা এভাবেই দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে। তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে বলেন, "আল্লাহ কষ্টের পর সুখ দেবেন" (সুরাঃ আত-তালাক, আয়াতঃ ৭), এবং  "নিশ্চয়ই কষ্টের পর স্বস্তি রয়েছে।" (সুরাঃ ইনশিরাহ, আয়াতঃ ৫]। 

অতএব দুঃখ-কষ্টকে হাসিমুখে বরণ করতে হবে মহান আল্লাহ প্রদত্ত এক পরীক্ষা ও নিয়ামত হিসাবে। এটাতে দুই দিকেই লাভ। এক দিকে কষ্ট-যন্ত্রণা ভোগের মধ্য দিয়ে মানুষের পাপে জর্জরিত জীবন দুঃখের আগুনে পুড়ে সোনা হয়, আত্মা হয় পরিশুদ্ধ ও প্রশান্ত। অন্যদিকে বাস্তবতার কশাঘাতে অপরিপক্ক মানুষ হয় পরিপক্ক। মূলত আসমানী ও জমিনী বালা-মুসিবত ভোগের মধ্য দিয়েই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সংঘটিত ছগীরা গুনাহগুলো মাফ হয়ে যায়। দুঃখ-কষ্ট জর্জরিত অবস্থায় আমরা সাধারণত মহান আল্লাহর দিকে অনেক বেশী ধাবিত হই। বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফারে মশগুল থাকি। এতে করে সর্বদা সংঘটিত কবিরা গুনাহগুলো থেকেও আমাদের পরিত্রাণ লাভের একাধিক সুযোগ তৈরি হয়। তাই দুঃখ-কষ্ট একজন মুমিনের জীবনে আশীর্বাদ স্বরূপ। 

বস্তুত মুমিনগণ জীবনের যেকোন অবস্থাতেই মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে। পরিহার করবে সব ধরনের নাফরমানি। এটাই একজন ঈমানদারদের চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য। এই পথে চলেই সাফল্যমণ্ডিত হয় একজন মুমিন বান্দার সমগ্র জীবনের পথচলা। সার্থক হয় সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি হিসাবে ধরণীর বুকে আশরাফুল মাখলুকাতের আগমনী ধারা। দুনিয়াতে আসে মনুষ্য জীবনের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ ও কামিয়াবী এবং আখেরাতে অর্জিত হয় কাঙ্খিত মুক্তি। দ্বীন-ইসলাম আমাদেরকে এই শিক্ষাই দেয়।

লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক, সিন্থেটিক অর্গানিক কেমিস্ট্রি এ্যান্ড কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালস. রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১০০০


সর্বশেষ সংবাদ