মেধাবীরা অবহেলায়, মেধাহীনরা টেলিভিশনের পর্দায়!

লেখক: আমিনুল ইসলাম
লেখক: আমিনুল ইসলাম

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের এক ছাত্র আজ (সোমবার) আত্মহত্যা করেছে। বছরের পর বছর এই নিয়ে লিখে যাচ্ছি! তবে এইসব শুনার সময় কোথায় আমাদের নীতি-নির্ধারকদের! 

এই ছেলে আত্মহত্যা করার পর তার বড় বোন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) লিখেছে-" অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া ছেলেটাকে বিভিন্ন ইস্যু বানিয়ে মাস্টার্সে সুপারভাইজার দেয়া হয়নি। বিভিন্ন কোর্সে নম্বর কম দিয়েছে শিক্ষকরা। আমার ভাইটা শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। এটাই তার অপরাধ। ছয় মাস ধরে বিভাগের শিক্ষকরা তিলে তিলে মেরে ফেলছে আমার ভাইকে!" ছেলেটার বোন এরপর লিখেছে-"আমার ভাইটারে গত মাসেও আমি জিজ্ঞেস করেছি, আমি কী তোর বিভাগের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা করব? আমার ভাই বলেছিল, আপু আমি জিআরই দিয়েছি, আমি ইউকে চলে যাব, আমার তো রেফারেন্স লাগবে। শিক্ষকরা তাকে ভয় দেখিয়েছে, কিছু করলে রেফারেন্স লেটার দেবে না। আমার ভাইরে মেরে ফেলছে ওরা।" 

আমি নিজে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) পড়াশুনা করেছি। নিজ চোখে আমি দেখেছি শিক্ষকদের আচরণ! আমি নিজে দেখেছি শিক্ষকরা কিভাবে নিজেদের পছন্দের ছেলে কিংবা মেয়েকে নাম্বার বেশি দিয়ে, নানান সুবিধা দিয়ে প্রথম, দ্বিতীয় বানায়! এরপর সেই প্রথম এবং দ্বিতীয় ছেলেটা কিংবা মেয়েটা হয়ে যায় মেধাবী! 

যেহেতু তারা প্রথম কিংবা দ্বিতীয় হয়েছে, তাই শিক্ষক হওয়া তো তাদেরই মানায়! এরপর এরা শিক্ষকও হয়ে যায়! কারো আর জানা হয় না- এরা প্রথম হলো কিভাবে! এরপর এরাও শিক্ষক হয়ে সেই একই অবস্থা! নিজেদের পছন্দের ছাত্রদের সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে! এ এক অনন্ত চক্র (সাইকেল)! 

আর ডিপার্টমেন্টে আপনার রেজাল্ট যদি একটু খারাপ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। শিক্ষকরা আপনাকে মানুষই মনে করবে না। এই হচ্ছে অবস্থা! 

এই যে ছেলেটা আত্মহত্যা করেছে; সে হয়ত এতসব অনিয়ম সহ্য করতে না পেরেই আত্মহত্যা করেছে। অনার্সে ফার্স্ট হয়েও ছেলেটা সুপারভাইজার পায়নি মাস্টার্সের থিসিসের জন্য। চিন্তা করা যায়! 

তবে আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়! শিক্ষকই হতে হবে কেন? জগতে কি অন্য কোন পেশা নেই? শিক্ষক হতে পারবে না, কারন স্যাররা ইচ্ছে করে রেজাল্ট খারাপ দিচ্ছে। সবই মানলাম। কিন্তু তাই বলে আত্মহত্যা করতে হবে কেন? আর শিক্ষক যদি হতেও হয়, তাহলে অন্য আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়তো আছে। 

এই আমি নিজেই তো এখন ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। তাও একটা না, দুই দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি তো ঠিকই এইসব বাঁধা জয় করেছি। নিজেকে স্রেফ সেইভাবে তৈরি করতে হবে।

পৃথিবী এখন সবার জন্য উম্মুক্ত। তুমি যদি নিজেকে সেভাবে তৈরি করো, তাহলে তুমি তোমার যোগ্যতা অনুযায়ী একদিন না একদিন কোথাও না কোথাও জায়গা পাবে। এইসব দেশে রেজাল্ট দেখে না, দেখে তুমি কতটুকু জানো ও বুঝো এবং সেটা ছাত্রদের জানাতে পারবে কিনা! তারা তোমাকে যাচাই করছে। শুধু তোমার রেজাল্টকে না। রেজাল্ট দিয়ে এরা ধুয়ে মুছে পানি খায় না। সেটা কেবল আমাদের শিক্ষকরাই খায়! 

পৃথিবীর নানা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর শিক্ষকরা তাদের ছাত্রদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়। আর আমাদের বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েদের স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ভেঙে যায়! কেউ কেউ ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে আত্মহত্যাও করে। 

এতে অবশ্য আমাদের শিক্ষকদের কিছু যায় আসে না। দিন শেষে টেলিভিশনের টকশোতে এসে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করে এরা। কারন এরা হচ্ছে দেশের মেধাবী সন্তান! দেশের ভবিষ্যৎ নিয়েতো এরাই আলোচনা করবে! 

কারো আর জানাই হয়ে উঠে না- এই দেশে মেধাবীরা অবহেলায় আত্মহত্যা করে আর মেধাহীনরা টেলিভিশনে গিয়ে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে বেড়ায়!

লেখক: শাবিপ্রবির প্রাক্তন ছাত্র। বর্তমানে ইউরোপের দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। 


সর্বশেষ সংবাদ