ডানপন্থীর বামে বামপন্থীর ডানে
- বেগম খালেদা জিয়া
- প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:২৫ PM , আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৪ PM
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জিয়াউর রহমান এসেছিলেন আকস্মিকভাবে। কিন্তু তাঁর আগমন ছিল অবশ্যম্ভাবী। নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ করতে সময়ের চাহিদা এবং দেশের দাবিতে তিনি রাজনীতিতে এসেছিলেন। কোনো চোরাগোপ্তা পথে নয়, রাতের অন্ধকারে ষড়যন্ত্র করে নয়, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর নতুন ভোরের আলোয় সর্বস্তরে লাখো কোটি মানুষ এবং দেশপ্রেমিক সৈনিকদের মুহুর্মুহু স্লোগান আর পুষ্পবর্ষণের মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতায় জিয়াউর রহমানের অভিষেক হয়েছিল।
যখন তিনি দেশের নেতৃত্বে এলেন তখন দেশে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাকশাল নামের একটি দল গঠন করে আর সব দল নিষিদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে দেশে এক দলের শাসন কায়েম করা হয়েছিল। গণতন্ত্র হরণ করা হয়েছিল। সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছিল। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোও খর্ব করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে বিনা ভোটে রাষ্ট্রপতি পদে উন্নীত করে তার হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল সর্বময় ক্ষমতা। ভোট ছাড়াই সরকারের মেয়াদ তিন বছরের জন্য বাড়িয়ে নেয়া হয়েছিল। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘদিন সংগ্রাম করা সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান আবির্ভূত হয়েছিলেন একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থার জনক হিসেবে। এসব তৎপরতা ছিল আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনার সম্পূর্ণ বিরোধী। সদ্য স্বাধীন দেশের জনগণ এতে প্রবলভাবে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
এ সুযোগে শেখ মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বীরা তারই একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমাদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি অনুগত অংশকে ব্যবহার করে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেয়। খন্দকার মোশতাক বাকশালও নিষিদ্ধ করে দেন। ফলে দেশ পুরোপুরি রাজনীতিহীন ও দলশূণ্য হয়ে পড়ে। তবে বাংলাদেশের তখনকার বিরাজমান পরিস্থিতিতে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে সংকট মোচন করা খন্দকার মোশতাকের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনিও পাল্টা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন এবং আরেকটি গ্রুপ ক্ষমতা দখলে নিয়ে দেশজুড়ে মার্শাল ল’ জারি করে। অভ্যুত্থানকারীরা তদানীন্তন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকেও বন্দী করে।
এসব চক্র-চক্রান্তের বিরুদ্ধেই ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার ঐতিহাসিক সংহতির মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সেই পরিবর্তন ছিল স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পক্ষে, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পক্ষে, মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকারের পক্ষে, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে, উন্নয়ন ও উৎপাদনের পক্ষে। সেই পরিবর্তন ছিল সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পক্ষে।
এই পরিবর্তনের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান দেশে রাজনীতি ফিরিয়ে আনেন, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন, রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ করে দেন। মানুষের মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। সেই পরিবর্তনের নেতৃত্বে ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষক ও বীর অধিনায়ক মুক্তিযাদ্ধা জিয়াউর রহমান। এ পরিবর্তনের জন্য তিনি নিজে গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মুসলিম লীগ নেতৃত্ব দিয়েছিল; কিন্তু পরে তারা যুগের চাহিদা মেটাতে পারেনি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পুরোভাগে আওয়ামী লীগ ছিল। কিন্তু পরে তারা স্বাধীন দেশের উপযোগী রাজনৈতিক দল হিসেবে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। সেই ব্যর্থতার পটভূমিতেই বিএনপির জন্ম। একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী রাজনীতি করার অঙ্গীকারে, সংকটে-শান্তিতে-সংগ্রামে এ দল গত বিগত কয়েক দশকে নতুন রাজনীতির ধারা তৈরি করেছে। অনেক অভিজ্ঞতায় এ দল শিক্ষিত। অনেক শহীদের রক্তে আমাদের প্রতিজ্ঞা অটল হয়েছে।
দ্বন্দ্ব-বিভাজন-সংঘাতের বিপরীতে আমরা বরাবরই জাতীয় ঐক্যের পতাকা উড্ডীন রেখে চলেছি। আমরা সব ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণী-পেশার মানুষকে সঙ্গী করে রুখে দাঁড়াবো সাম্প্রদায়িকতাকে। জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্রকে অগ্রাধিকার দিয়ে গড়ে তুলবো সামাজিক ইনসাফভিত্তিক সমাজ। আমরা এগিয়ে নেব উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতি। বিশ্ব পরিসরে সমমর্যাদার ভিত্তিতে সবার দিকে বাড়িয়ে দেব বন্ধুত্বের হাত। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে থাকব অনড়, অটল।
ডান কিংবা বামপন্থী আমরা নই। আমাদের ডানে যাদের অবস্থান তারা ডানপন্থী, আমাদের বামে যাদের অবস্থান তারা বামপন্থী। আমাদের অবস্থান ডানপন্থীর বামে এবং বামপন্থীর ডানে। আমাদের অবস্থান কেন্দ্রে এবং এদেশের রাজনীতির কেন্দ্র আমরাই। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলই এ দেশের মূলধারা, বিএনপিই বাংলাদেশের জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান|
নোট: সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ২০১৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এ কলামটি লিখেন। তখন দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় এটি প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক পথ ও মত নিয়ে আলোচনায় লেখাটির প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস পুনরায় প্রকাশ করলো। ২০২০ সালে খালেদা জিয়ার সাবেক প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান এই একই লেখা তার ফেসবুক ওয়ালে প্রকাশ করে মন্তব্য করেন, "বিএনপির ইতিবৃত্ত, লক্ষ্য, অবস্থান এবং পথচলার সার্বিক দিক মূল্যায়ন করে এই অসামান্য লেখাটি লিখেছিলেন ২০১৫ সালে দলটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে। সেদিন তা একযোগে প্রকাশিত হয়েছিল দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে। তিনি দলটির 'মধ্যপন্থী' পরিচিতির ওপরেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ৪২ বছর আগে রমনা গ্রিনে বিএনপি প্রতিষ্ঠার ঘোষণার সময়েও বলা হয়েছিল, এ-দেশের মানুষ মধ্যপন্থী। কোনো চরমপন্থাকে নয়, মধ্যপন্থাকেই তারা সমর্থন করেন। ডানপন্থীদের হাতকাটা রাজনীতি ও বামপন্থীদের গলাকাটা রাজনীতি এ দেশের জনগণ গ্রহণ করেনি। দল হিসেবে বিএনপি মধ্যপন্থাকেই বেছে নিয়েছে। প্রতিষ্ঠাকালীন সেই নীতিগত অবস্থানকে তুলে ধরে দেশনেত্রীর এ লেখাটির তাৎপর্য এবং বহমান প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় করেই আজ বিএনপি প্রতিষ্ঠার এ দিনে প্রকাশ করলাম।"