১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৬:২৯

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা কেন জরুরি

লেখক  © টিডিসি ফটো

শিক্ষা একটি জাতির ভবিষ্যৎ গঠনে মূল ভূমিকা পালন করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনেকাংশে এই প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে রয়েছেন। তবে, তবে সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থা যোগ্য প্রার্থীদের আকর্ষণ এবং বাছাই করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের নিয়োগ প্রক্রিয়ার মতো কঠোরভাবে যাচাই না হওয়ায় বাংলাদেশের নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রায়ই গভীরতা, স্বচ্ছতা এবং শিক্ষাগত মান বজায় রাখটে পারছে না। এই প্রক্রিয়াটির উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সরাসরি শিক্ষার গুণমান এবং গবেষণায় প্রভাব ফেলে থাকে।

বাংলাদেশে নিয়োগ প্রক্রিয়া এই গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়নের পর্যায়গুলির মধ্যে কিছু বাদ দিয়ে দেয়, যেখানে অনেক ক্ষেত্রে একটি সাধারণ লিখিত পরীক্ষার উপর নির্ভর করে যার মাধ্যমে শিক্ষাগত দক্ষতা সঠিকভাবে মাপা যায় না।  এর বাইরে অনেক ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে থাকে।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার গুণমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, গবেষণার উৎকর্ষ এবং সামগ্রিক খ্যাতি নির্ধারণ করে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং অন্যান্য উন্নত দেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাব্যবস্থায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াটি যোগ্য এবং সর্বোত্তম প্রার্থী খুঁজে বের করার জন্য অনেকগুলো ধাপে সাজানো হয়। নিয়োগ প্রক্রিয়াটি প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, গবেষণার দক্ষতা এবং শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা সুনির্দিষ্টভাবে যাচাই করার মাধ্যমে শুরু হয়। প্রার্থীরা সাধারণত সাক্ষাৎকারের একাধিক রাউন্ড, উপস্থাপনা এবং কখনও কখনও একটি পিয়ার-পর্যালোচনা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যান যেখানে অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ তাদের কাজ মূল্যায়ন করেন। যদিও এই প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ, এটি নিশ্চিত করে যে শুধুমাত্র সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিরাই নির্বাচিত হন। অন্যদিকে, বাংলাদেশে নিয়োগ প্রক্রিয়া এই গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়নের পর্যায়গুলির মধ্যে কিছু বাদ দিয়ে দেয়, যেখানে অনেক ক্ষেত্রে একটি সাধারণ লিখিত পরীক্ষার উপর নির্ভর করে যার মাধ্যমে শিক্ষাগত দক্ষতা সঠিকভাবে মাপা যায় না।  এর বাইরে অনেক ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে থাকে।    

আরও পড়ুন: শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের করণীয়

ইতঃপূর্বে শুধুমাত্র মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ হলেও ইদানিং প্রায়শই লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়ে থাকে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই লিখিত পরীক্ষা অংশটি নিয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে, এই পরীক্ষাগুলি প্রার্থীর বিষয়ে বা তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতার সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত করে না। রাজনৈতিক এবং সাম্প্রতিক সময়ের বিষয়গুলির সাধারণ জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা প্রার্থীদের প্রকৃত দক্ষতা পরিমাপ করা কঠিন করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিক বেশ কিছু বিজ্ঞান বিভাগের নিয়োগ পরীক্ষায় রাজনৈতিক ইতিহাস এবং সাধারণ জ্ঞান সম্পর্কে প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত থাকার তথ্য পাওয়া যায়, যা বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনও উপযুক্ত প্রয়োজনীয়তার সাথে সম্পর্কিত নয় বরং অনেকাংশে রাজনৈতিক। বলে অভিযোগ আছে। নিয়োগ পরীক্ষার বিষয়গুলোকে প্রার্থীদের নির্দিষ্ট জ্ঞান, গবেষণার অভিজ্ঞতা এবং পঠন ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে সংস্কার করলে এটি নিশ্চিত করবে যে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞ এবং নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতে প্রস্তুত। 

শুধুমাত্র সিজিপিএ, গবেষণাপত্র, লেকচার ডেলিভারি বা সাংগঠনিক দক্ষতা এককভাবে না দেখে প্রার্থীর সামগ্রিক মূল্যায়ন এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে কেননা বাংলাদেশে এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই ত্রুটিপূর্ণ।  

এখানে তুলনা হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্রের নিয়োগের মানদণ্ডের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে একজন পাবলিক রিসার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদের জন্য একটি পিএইচডি ডিগ্রি, বেশ কিছু গবেষণাপত্র, শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা এবং গবেষণার জন্য তহবিল সংগ্রহের প্রমাণিত রেকর্ড থাকা প্রয়োজন। ইউরোপেও অনুরূপ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় যেখানে সহকর্মীদের মূল্যায়ন, আন্তঃশৃঙ্খলা সহযোগিতা দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া হয়। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শিক্ষাগত উৎকর্ষের প্রতি প্রতিশ্রুতি দৃশ্যমান। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি সমান পদ্ধতি প্রণয়ন করা উচিত, যাতে বিষয় বিশেষজ্ঞ, গবেষণা সম্ভাবনা এবং শিক্ষাদানের যোগ্যতা উচ্চতর হয়। শুধুমাত্র সিজিপিএ, গবেষণাপত্র, লেকচার ডেলিভারি বা সাংগঠনিক দক্ষতা এককভাবে না দেখে প্রার্থীর সামগ্রিক মূল্যায়ন এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে কেননা বাংলাদেশে এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই ত্রুটিপূর্ণ।  

আরও পড়ুন: নির্যাতিতের গল্প: নিঃশব্দের আওয়াজ

তবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সংস্কারের পাশাপাশি বেতন কাঠামোও উন্নত করার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের বর্তমান বেতন কাঠামো আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে খুবই পিছিয়ে। উদাহরণস্বরূপ, একজন সহকারী অধ্যাপক বাংলাদেশে মাসিক গড় বেতন প্রায় ৫০,০০০ থেকে ৬০,০০০ টাকা পেয়ে থাকেন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে একজন সহকারী অধ্যাপকের গড় বেতন প্রতি মাসে প্রায় ৬,০০০ থেকে ১০,০০০ ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতের সহকারী অধ্যাপকদের গড় মাসিক বেতন প্রায় ১,২০০ থেকে ১,৫০০ ডলার। আমি অস্ট্রেলিয়াতে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই সেখানেও শিক্ষকদের বেতন অন্যান্য সাধারণ প্রফেশনের তুলনায় দ্বিগুণ। বেতনের এই অসামঞ্জস্যের কারণে যোগ্য শিক্ষকগণ শিক্ষার পেশা গ্রহণ করতে আগ্রহ হারান, বিশেষ করে যারা দেশের বাইরে তাদের শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন। বাংলাদেশে বেতনকাঠামো উন্নত করলে দেশের মেধাবী প্রার্থীদের আকর্ষণ এবং মেধা ধরে রাখতে এটি আরও সহায়ক হবে।

একটি স্বচ্ছ, মেধাভিত্তিক এবং কঠোর নিয়োগ প্রক্রিয়া বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করতে পারে। শিক্ষাগত উৎকর্ষ, গবেষণার যোগ্যতা এবং শিক্ষাদানের ক্ষমতা মূল্যায়নে একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করবে যে কেবল যোগ্য শিক্ষক নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। একই সাথে, বেতন কাঠামোও মানানসই করতে হবে, যাতে এটি আকর্ষণীয় হয় এবং যোগ্য শিক্ষাবিদদের আকৃষ্ট করতে সহায়ক হয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন এবং শিক্ষার মান বজায় রাখতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমরা একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি, তবে শিক্ষার মান বজায় রাখা এবং শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থার মানোন্নয়ন আমাদের জাতীয় এজেন্ডার শীর্ষে থাকা উচিত।  

লেখক: গবেষক ও একাডেমিক, ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও সহযোগী অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।