জুলাই গণহত্যার বিচারকার্য কোথায়?
এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মোট ১৫৮১ জন শহীদ হয়েছেন আর আহত ২২ হাজারেরও বেশি। আমি কয়েকজন আহতের সাথে দেখা করেছি, হাসপাতালে গিয়েছি। হাসপাতালে গিয়ে মানুষগুলোর যে পরিস্থিতি দেখেছি, সে সময়ে ওই জায়গায় নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিলো আমার। গুলিতে মুখ নেই, কিন্তু এখনও বেঁচে আছে। কারো হাত নেই, পায়ে রিং পরানো, শরীরে অনেকে এখনও গুলি নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় ছটফট করছে। আরও কত কি!
মানুষগুলোর বড় একটা চাওয়া হচ্ছে তাদের এই অবস্থার জন্য যারা দায়ী, তাদের যেন বিচার করা হয়। শহীদদের পরিবারগুলোরও এই একই চাওয়া আমাদের কাছে। কিন্তু তাদের এই চাওয়া, তাদের এই আশা কি পূরণ হচ্ছে? হচ্ছে না। শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলো প্রায় ২ মাস হতে চললো। তিনি পালানোর পরে আওয়ামী লীগের অনেক বড় বড় সন্ত্রাসী নেতা-কর্মী পালালো। কেন? কীভাবে পালালো তারা? প্রশাসন কী করছে? গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কী করছে?
আরও পড়ুন: কবর থেকে তোলা হচ্ছে আন্দোলনে নিহত ৯ জনের লাশ
বিভিন্ন জায়গায় খবর পাচ্ছি ছাত্রলীগ পুনর্বাসিত হচ্ছে। এলাকায় এলাকায় ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগের লোকজনের বিচরণ শুরু হয়েছে। অথচ এখনও এদের বিরুদ্ধে বিচারকার্য শুরু হয়নি। যেখানে সারা বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে যে, অরাজনৈতিক কোটা আন্দোলনকে পরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনের ট্যাগ দিয়ে, শিক্ষার্থীদের রাজাকার, শিবির ট্যাগ দিয়ে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালিয়েছিল। হল ছাড়া করেছিল, ক্যাম্পাস ছাড়া করেছিল, মেরে মেরে ছেলে-মেয়েগুলোকে হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। এক পর্যায়ে তারা এই নৃশংসতা সাধারণ জনগণের উপরেও চালায়।
ছাত্রলীগ-যুবলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দাদের সাথে একত্রিত হয়ে নিরস্ত্র মানুষগুলোকে গুলি করে আহত করেছিল, হত্যা করেছিল। অনেক জায়গায় দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কুপিয়েও হত্যা করেছিল। আহতদের হাসপাতালে সামান্য চিকিৎসাও নিতে দেয়নি তারা। মানুষগুলো তখন পালিয়ে পালিয়ে চিকিৎসা নিয়েছিল। অনেকে বিনা চিকিৎসায় মারাও গিয়েছিল।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামে অনেক ভিডিও ফুটেজ এখনও আছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও অনেক ভিডিও ফুটেজ আছে। তার ওপর দিন দিন শহীদের তালিকা বাড়ছে। কিন্তু বিচারকার্য কোথায়? অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের হাল ধরার আজ প্রায় ২ মাস হয়ে যাচ্ছে। কেন সরকার এই গণহত্যার বিচারকার্য এখনও শুরু করেনি? উপদেষ্টারা কী করছেন? বিশেষ করে আইন উপদেষ্টা এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কী করছেন?
আরও পড়ুন: কাউকে ক্ষমতায় নেওয়া বা নামাতে ক্যাডার হওয়াকে ছাত্র রাজনীতি বলে না
উপদেষ্টারা হয়ত ভুলে যাচ্ছেন যে, তারা কোনো রাজনৈতিক দল না, কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থনে তারা আজ উপদেষ্টা হননি। তারা উপদেষ্টা হয়েছেন ছাত্র-জনতার সমর্থনে। ছাত্র-জনতার সমর্থনে তারা আজ দেশের সর্বোচ্চ জায়গায় বসেছেন। তাদের মধ্যে আদৌও কি জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট আছে? আমার তো মনে হয় নেই। থাকলে বিচারকার্যে এতটা আলসেমি করতে পারতো না।
যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা আজ বেঁচে আছি, তাদেরকেই আমরা এখনও ন্যায় বিচার দিতে পারছি না। দিন দিন লাশের সংখ্যা বাড়ছে। অথচ সবাই নিজের মতো চুপচাপ বসে আছি। আমরা কি তাহলে আহত আর শহীদদের রক্তের সাথে গাদ্দারি করছি? বর্তমান সরকারও কি চেয়ার পাওয়ার পরে আহতদের সাথে, শহীদদের সাথে গাদ্দারি করা শুরু করেছে?
আরও পড়ুন: ঢাবিতে ৬ বছর ‘শিবির ট্যাগের ট্রমা’ নিয়ে বেঁচেছি, তখন আপনি কোথায় ছিলেন?
প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এবং উপদেষ্টাদের উদ্দেশ্যে আমি শুধু একটা কথা বলতে চাই, ❝বিপ্লব কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। শুধু নামটা পাল্টেছে। ৫ই আগস্টের আগে নাম ছিল স্বাধীনতা অর্জনের বিপ্লব। ৫ই আগস্টের পরে নাম হয়েছে অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষার বিপ্লব।❞ যদি আপনাদের মধ্যে জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট না থাকে, যদি আপনারা আপনাদের দায়িত্বের জায়গা থেকে ছাত্র-জনতার স্বার্থ, চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে না পারেন, নিজ থেকে ঐ চেয়ারটা ছেড়ে দিন। আর নাহয় ছাত্র-জনতার স্বার্থ রক্ষা করুন, তাদের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করুন।
ছাত্র-জনতার স্বার্থ পূরণের প্রশ্নে কোনো অলসতা, কোনো ধীর গতি সহ্য করা হবে না। ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে আপনারা ক্ষমতা পেয়েছেন, দেশের সর্বোচ্চ জায়গায় বসতে পেরেছেন। সুতরাং, ছাত্র-জনতার স্বার্থ, তাদের চাওয়া-পাওয়া আগে পূরণ করতে হবে। তারপরে বাকি সব। অনতিবিলম্বে জুলাই গণহত্যার সাথে জড়িত আওয়ামী সন্ত্রাসীদের কঠোর থেকে কঠোরতর শাস্তি প্রদান এবং তা বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি।
ইনকিলাব জিন্দাবাদ।
লেখক: সহ-সমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।