পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপনিবেশবাদ আর কত?

মাহবুবুল হক ভূঁইয়া
মাহবুবুল হক ভূঁইয়া  © টিডিসি ফটো

একটি বিষয় শুরুতেই পরিষ্কার করে নেওয়া যাক। যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তুলনামূলক নতুন এবং বাইরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়, এই লেখায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলতে সেগুলোকে বোঝানো হয়েছে।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) ওয়েবসাইটে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিষ্ঠার বছর অনুযায়ী তালিকাবদ্ধ করা হয়েছে। কোন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য রয়েছে, সেটি খোঁজার জন্য বেশিদূর আগাতে হয় না। তালিকার ছয় নম্বরে থাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নিজেদের শিক্ষকদের মধ্যে থেকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার রীতি রয়েছে। এই তালিকায় নয়ে থাকা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন অধ্যাপক। তবে এটিকে ব্যতিক্রম ধরা যেতে পারে, কারণ উনার পূর্ববর্তী উপাচার্যই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ছিলেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন শিক্ষক।

আরও পড়ুন: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার সিঁড়ি ঢাবি শিক্ষক সমিতি

মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আলোচনার বাইরে রাখলে ইউজিসির তালিকা অনুযায়ী দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০টি। উপরের হিসাব অনুযায়ী আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের শিক্ষক উপাচার্য, বাকি ৪২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে  বাইরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এমনকি তুলনামূলক পুরোনো হিসেবে পরিচিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭৯ সাল) এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (১৯৮৬ সাল) উপাচার্যও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন অধ্যাপক।

চলুন দুইটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কী? এক, যখন একটি বিশ্ববিদ্যালয় নতুন প্রতিষ্ঠা করা হয় সেখানে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার মতো শিক্ষক না থাকায় সেটির প্রয়োজন হয়। কিন্তু ২০-৩০ বছর অতিক্রম করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সে প্রয়োজনীয়তা নেই। তাহলে সেগুলোতে কেনো বাইরে থেকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়? একটি কারণ হতে পারে যে, দক্ষ ও পন্ডিত কোনো অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুণগত পরিবর্তনে কাজ করতে পারবেন, সে বিবেচনায় নিয়োগ হতে পারে। যেমন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ভিনসেন্ট চ্যাংকে তাদের উপাচার্য হিসেব নিয়োগ দিয়েছিল।

এই আলাপের দ্বিতীয় ধাপে আরও একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কি গুণগত অবদানের জন্য দক্ষ ও পণ্ডিত অধ্যাপকদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়? খুবই সীমিত কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এই প্রশ্নের উত্তর হলো, না। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগের যে ধারা সেখানে দুটি ধারা দেখা যায়। এক, বড় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষক রাজনীতিতে অবদানের পুরস্কার হিসেবে তারা নিয়োগ পান। দুই, ব্যক্তিগত সম্পর্কের বদৌলতে পদটি বাগিয়ে নেওয়া; সরকারের প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলে তার একক সুপারিশে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে।

এই দুই ধাপের প্রশ্ন খোঁজা শেষে প্রথম প্রশ্নটির উপসংহার টানা যেতে পারে। প্রশ্নটি ছিল, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপচার্য নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে কি না? উত্তর হলো, নেই। কারণ, প্রথমত, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যেহেতু ২৫-৩০ বছর বয়স হয়েছে, সেখানে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার মতো অধ্যাপক রয়েছেন। দ্বিতীয়ত, যেহেতু গুণগত কোনো অবদান রাখতে পারবেন, এ বিবেচনায় তাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হয় না, সেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা দক্ষ বা পণ্ডিত নন। ফলে ইতিবচাক কোনো অবদান রাখতে পারেন না।

চলুন দেখি এই আলোচনার শেষ ধাপে সর্বশেষ প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। প্রশ্নটি হলো, পাবলিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগে এই প্রবণতার প্রভাব কী? এই প্রশ্নটির উত্তর  তুলনামূলকভাবে বড়। কারণ, এর প্রভাব অনেক বেশি। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে ফেলা সম্ভব। মোটাদাগে কিছু বিষয় আলোচনা করা যায়। 

এই উপাচার্যরা যেহেতু বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে আসেন, সেহেতু তারা নিয়োগ পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। ফলে বোঝাপড়াতেই তাদের বেশ সময় চলে যায়। কারও পক্ষে আসলে এই দায়িত্বের চার বছরেও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি বোঝার জন্য যথেষ্ট নয়। এ বোঝাপড়ার জন্য তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে  বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় এবং নেতৃত্বস্থানীয় লোকজনের উপর নির্ভর করেন। এদের বেশিরভাগই আবার দলীয়, গ্রুপ আর ব্যক্তিস্বার্থে দুষ্ট। ফলে তারা উপাচার্যদের সে পথেই পথ দেখান। ফলে এ সময়ের মধ্যে উপাচার্যরা এমন অনেক কিছুতে জড়িয়ে পড়েন, যার মাশুল শেষের বছরগুলোতে দিতে হয়। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেয়াদের শেষ সময়ে এসে উপাচার্যরা আন্দোলনের মুখে পড়েন। এর কারণ হলো দুই-তিন বছরে তারা নিয়োগ, পদোন্নতি, টেন্ডার, পদ বণ্টনসংক্রান্ত নানা ধরনের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। যেহেতু উপাচার্যরা  দলীয়, গ্রুপ আর ব্যক্তিস্বার্থে দুষ্ট শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন; তাদের পক্ষে সবাইকে খুশি রাখা সম্ভব হয় না। মেয়াদের শেষের দিকে এসে বঞ্চিত, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়।কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া তাদের অসম্মানজনক বিদায়ের খবর গণমাধ্যমে হরহামেশাই দেখতে পাবেন।

উপরের আলোচনা দেখে মনে হতে পারে, সব অনিয়ম-দুর্নীতি উপাচার্যরা অন্যের প্ররোচনায় পড়ে করেন। না। আগেই বলা হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা উপাচার্য হয়ে আসেন, তাদের নির্বাচনের মানদণ্ড পাণ্ডিত্য বা দক্ষতা নয়, বরং দলীয় ও ব্যক্তি আনুগত্য। ফলে নৈতিকতার ঘাটতি উপাচার্যদের মহোদয়দের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। যে দল বা ব্যক্তির সুপারিশে তারা এই পদটি বাগিয়ে নেন, তাদের সকল সুপারিশ, অন্যায় আবদার বিনা বাক্য ব্যয়ে পালন করেন। এটি করতে গিয়ে যোগ্যতাহীন লোক নিয়োগ দেন। অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে টেন্ডার দেন। কেউ কেউ সরাসরি নিয়োগ, টেন্ডার থেকে অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আত্মীয়স্বজন, বাসার কাজের মানুষ, গ্রামের-থানার-জেলার-বিভাগের মানুষ দেখে নিয়োগ দেওয়ার খবরতো প্রায়ই গণমাধ্যমে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অংশীদার এসব কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ করলে তাদের আর রক্ষা হয় না। উপাচার্যের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার শিকার হয়ে তাদেরকে নানা ধরনের হয়রানির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বকে এক ধরনের রাজত্ব বলা যেতে পারে। পদাধিকার বলে তারা বিভিন্ন সভা থেকে অর্থ উপার্জনতো করেনই। কেউ কেউ অর্থের লোভে বিভিন্ন অনুষদের ডিনের দায়িত্ব নিয়ে নেন, সান্ধ্য কোর্স থেকে উপদেষ্টা ভাতা নেন। কারও আবার এইটুকুতে পোষায় না বলে তারা সান্ধ্য কোর্সে ক্লাস নিতে শুরু করেন। বাইরে থেকে উপাচার্য নিয়োগের প্রভাবের প্রবণতা বোঝাতে কিছু উদাহরণ এখানে দেওয়া হলো। আসলে এই তালিকা অনেক লম্বা করা সম্ভব।

বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে শিক্ষকদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তারা দায়িত্ব পালন শেষে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান। দায়িত্ব পালনকালে তাদের অপকর্মের জবাবদিহিতা শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ইউজিসিতে করতে হয়ে বলে উদাহরণ দেখি না। ফলে তারা স্বেচ্ছাচারী হওয়ার অবাধ ক্ষমতা ও স্বাধীনতা উপভোগ করেন। অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য নিয়োগের পরিবর্তে যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব শিক্ষকদের মধ্যে থেকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়, যেহেতু দায়িত্ব পালন শেষে তাদের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতে হবে, সেটি ভেবে তারা হয়তো এক ধরনের পরোক্ষ জবাবদিহিতা অনুভব করতেন। আর যেহেতু তারা লম্বা একটি সময় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছেন, সেহেতু তাদের পক্ষে হালহকিকত বুঝে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনা করা সম্ভব। যদি বাইরে থেকে উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজেদের শিক্ষকদের থেকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে সেখান থেকেই নিয়োগ দেওয়া উচিত। ব্যক্তিগতভাবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বভাবে বিশ্বাস করি, ২৫-৩০ বছর অতিক্রান্ত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই দায়িত্ব পালন করার মতো যথেষ্ট দক্ষ অধ্যাপক রয়েছেন। 

দুইটি প্রশ্ন দিয়ে শেষ করি। যারা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়ে আসেন, তারা এখানে স্থায়ী চাকুরি নিয়ে অধ্যাপনা করতে আসবেন? যদি না আসেন, তাহলে উপাচার্যের দায়িত্ব পেলে কেনো আসেন? উত্তর কমবেশি আমাদের সবার জানা। সেটি বিবেচনায় নিয়ে এই উপনিবেশবাদের অবসান করা উচিত।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ