একাডেমিক পর্নোগ্রাফি ও পেটিকোট অথর

বাতেন মুহাম্মদ
বাতেন মুহাম্মদ  © সংগৃহীত

নিউইয়র্কের বাঙালী পাড়ায় গেলে একটু মনযোগ দিয়ে কান পাতলে দুইটা শব্দ শুনবেন, ‘পেটিকোট ভিসা’ নাকি ‘লুঙ্গি ভিসা’। খুবই অপমানজনক শব্দ। এটাকে নিউইয়র্কে বাঙালী অভিবাসীদের একধরনের কালচারাল ‘ক্যাভেট’ হিসাবে দেখা যেতে পারে।

এই ভিসার মানে হচ্ছে, নিউইয়র্কের কোন অভিবাসীর বিবাহ যোগ্য মেয়েকে যদি নিজের কালচার ধরে রাখার চেষ্টা হিসাবে বাংলাদেশ থেকে বিয়ে করিয়ে কোন সোকল্ড ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার কিংবা উচ্চশিক্ষিত কোন ছেলেকে আমেরিকায় নিয়ে আসে তখন তাকে বলে ‘পেটিকোট ভিসা’। মানে বউয়ের মাধ্যমে আমেরিকার গ্রীনকার্ড, নাগরিকত্ব এইসব পাওয়াকে ব্যাঙ্গ করে বুঝানো হয়।

আর যদি আমেরিকায় বড় হওয়া কোন বাঙালী ছেলে বাংলাদেশি মেয়েকে বিয়ে করে এখানে আনে তাহলে তাকে বলে লুঙ্গি ভিসা। এই দুই ভিসা ক্যাটাগরি মূলত একধরনের পরনির্ভরতা ও যোগ্যতাহীন কাপুরুষতা বুঝানো হয়। এই লেখায় কেনো এই গল্পের প্রাসঙ্গিকতা আরেকটু নীচে পড়লে বুঝা যাবে।

চটকদার সংবাদ শিরোনামের কারণে দেখলাম সারাদেশে রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে নিয়ে ব্যাপক হাসাহাসি হচ্ছে। ড. আবু রেজা তৌফিকুল ইসলাম নামের এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক বছরে ১০২টা গবেষণাপত্র তৈরির অভিযোগ উঠেছে।

যেহেতু শিক্ষকতা পেশায় আমিও যুক্ত তাই অনেকে আমাকে ইনবক্স করে জানতে চেয়েছে ঘটনা কি? আসলে আমি এই ঘটনা জানি না। আরেকটা কথা বলে রাখি এই আর্টিকেল আর্টিকেল খেলা আর সাইটেশন বাণিজ্য আমার বরাবরই ‘একাডেমিক পর্ণোগ্রাফি’ মনে হয়। তাই এটা নিয়ে আমার এমনিতেও আগ্রহ নাই।

বাংলাদেশে এক শ্রেণির একাডেমিশিয়ানদের মধ্যে এই পর্ণোগ্রাফিক প্রতিযোগিতা আছে। কে কয়টা আর্টিকেল ছাপাবে, কয়টা সাইটেশন হলো, কার আর্টিকেল কোথায় ছাপা হলো—এইসব নিয়ে। সায়েন্টিফিক আর্টিকেলের গুরুত্ব অবশ্যই আছে। কিন্তু সেটা কুমিরের সেই বানরের বাচ্চা দেখানোর মত হয়ে যাচ্ছে কিনা সেটা বুঝতে পারাই একজন গবেষকের জ্ঞান ও অনেস্টির পরিচায়ক।

তাই আপনার কত আর্টিকেল ও কত সাইটেশন এটা জ্ঞানরাজ্যে আপনাকে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখবে না। বরং আপনি মৌলিক কি জ্ঞান তৈরি করলেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আরো গুরুত্বপূর্ণ আপনার জ্ঞানটা নতুন কি জ্ঞান তৈরি করলো এবং সমাজের কি কাজে লাগলো। পর্নোগ্রাফি যেমন দেখেই সুখ, বাস্তবে ক্ষতিকর তাই এই ধরনের আর্টিকেলের দৌড়—যা শুধু সিভি আর ওয়েবসাইটের পৃষ্ঠা বাড়ায়... তাকে আমি ‘একাডেমিক পর্নোগ্রাফি’ বলি।

এই ধরনের ইঁদুর দৌড়ে দেখা গেল—একটা আর্টিকেলকেই ১০ ভাগে ভাগ করে ১০টা ছাপানো হলো। দেখা গেল একটা মডেলিং দিয়ে ১০ জায়গার ডাটা দিয়ে ১০টা ছাপানো হলো। কিন্তু এটা একটা স্টাডিতেও ছাপানো সম্ভব। এছাড়া কোলাবোরেটিভ সাইটেশন বাণিজ্য, কোয়ান্টেটিভ ডিসেনস্টি (মানে রুমে বসে কোয়ান্টিটেটিভ ডাটা জেনারেট করা। যেটা ভেরিফাই করা, রিভিউয়ারের পক্ষে সম্ভব না। যদি না রিসার্চার নিজে থেকে সৎ হয়)।

এছাড়াও আরো অনেক ইস্যু আছে। তবে এগুলো জালিয়াতি নাকি গবেষকের ‘ফিলোসফি অব সায়েন্স’ না বোঝার ইগ্নোরেন্স সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।

আমি বাংলাদেশের অনেক গবেষকের সাথে ১০ মিনিট কথা চালিয়ে যেতে পারিনি। যদিও তাদের অনেকের আর্টিকেল সংখ্যা ৪০-এর অধিক, সাইটেশন ৩-৪ হাজার। তারা জানেই না এখনো পজিটিভিজম, পোষ্ট পজিটিভিজম।

তারা ইন্ডাকটিভ ও ডিডাকটিভ নমোলজি সম্পর্ক ধারণাই নাই। মোট কথা রিসার্চটা কেন করছে এবং কীভাবে করছে এই প্রশ্ন সম্পর্কে ধারণা ছাড়াই কিছু ডাটা আর গ্রাফ জেনারেট করে একটা আর্টিকেল প্রকাশ করে ফেলছে। এদেরকে আমি ‘ডাটা শ্রমিক’ বলি।

আমি বলছি না, আমার এই ধারণা সঠিক। আমি ভুল হতে পারি। হয়তো তারা যে রিসার্চ করছে সেটা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমি বুঝতে অক্ষম, তাই তাদের ডাটা শ্রমিক হিসাবে দেখা আমার এক ধরনের চূড়ান্ত অক্ষমতা।

অবশ্য এই ডাটা শ্রমিক ও একাডেমিক পর্নোগ্রাফি এখন ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ছে চীন, ভারত ( ভারতের কিছু জায়গায় হয়, সবখানে না), পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশসহ এশিয়ার কিছু দেশে।
কিন্তু এই ধরনের ডাটা শ্রমিকের হয়তো প্রয়োজন আছে।

একাডেমিয়াতে সবাই মৌলিক জ্ঞান তৈরি করবে না। অনেকেই নাম্বার গেমের শ্রমিক হবে। তারপর টপ ২% সায়েন্টিস গ্রুপে ঢুকবে। এদের কাজ নলেজ রিপ্রডাকশন করা ও রেপ্লিকেট করা। ক্যাপিটালিজমের এই যুগে হাজার হাজার জার্নাল বাণিজ্য ও সাইটেশন বাণিজ্যের যুগে অনেকেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রডাকশন করবে- এটা স্বাভাবিক।

মৌলিক জ্ঞান তৈরির মত ক্যালিভার, ধৈর্য্য ও পরিবেশ না থাকলে, যৌগিক জ্ঞান মানে একই বানর ছানাকে দশবার দেখিয়ে আলাদা আলাদা আর্টিকেল প্রকাশ করুক, এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকুক- অন্তত কিছু প্রকাশ নাকরা থেকে প্রকাশ করাতো ভালো।

ধরে নিলাম অনেকেই ব্যাঙের বাচ্চার মত প্রসব করছে না, কিন্ত যদি এমন হতো ৫ বছর পর সে একটা বই লিখেছে কিংবা কোন মৌলিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে তাহলে ধরে নিলাম কিছু হলেও করছে। কিন্তু সেটাতো করছে না। করছে রাজনীতি ও দলীয় লেজুড়বৃত্তি।

সেই তুলনায় আর্টিকেল প্রসবে ব্যস্ত থাকুক, কি সমস্যা? এইসব আর্টিকেল বৈশ্বিক জ্ঞান ভান্ডারে কি কন্ট্রিবিউশন সেটা নিয়ে বিতর্ক হোক, তবুও রাজনৈতিক কুতর্ক থেকেত ভালো।

জনাব তৌফিক সাহেবের নিউজটা দেখার মত আমি ঘেটে দেখলাম। উনাকে যে এক বছরে ১০২টা আর্টিকেল তৈরির অভিযোগ করেছে, এটা আমার কাছে নিতান্তই বিদ্বেষ প্রসূত ও যে সাংবাদিক নিউজটা প্রকাশ করেছে তার অজ্ঞতা মনে হলো।

উনার গুগল স্কলার সাইট ঘুরে দেখলাম উনি অনেক আর্টিকেল নামকরা জার্নাল যেমন ‘সায়েন্স অব দি টোটাল এনভায়রনমেন্ট’, ‘জার্নাল অব ক্লিনার প্রডাকশন’, ‘জার্নাল অব পলুশন রিসার্চ’ এমন Q1 মানের জার্নালে ছাপিয়েছে।

তাছাড়া সাংবাদিক যে বললো ১০২টা এটা উনার  টোটাল আর্টিকেল, এক বছরে তৈরি আর্টিকেল সংখ্যা না। যেগুলো উনি ২০১৩ সাল থেকে ছাপাচ্ছেন তার মানে ১০ বছর ধরে ছাপানো আর্টিকেল। ১০ বছরে ১০২টা আর্টিকেল ছাপানো খুব সম্ভব। তাই অজ্ঞ সাংবাদিক না জেনেই কারো প্ররোচনায় চকটদার শিরোনাম করে একজন শিক্ষককে সবার সামনে হেয় প্রতিপন্ন করেছে।

জনাব তৌফিক সাহেবের সাইটেশন প্রায় ৮০০০-এর উপর। তাই উনি এই একজন বহুল সাইটেড গবেষক এটাও বলা যায়। উনাকে চৌর্য্যবৃত্তিতে অভিযুক্ত করা, বদনাম করা মানে হলো একাডেমিক জেলাসি থেকে কেউ করেছে। আর সাংবাদিককে লেলিয়ে দিয়েছে বুঝে না বুঝে এটাকে রিপোর্ট করতে।

তবে সমস্যাটা অন্য জায়গায়। উনার প্রোফাইল ঘেটে দেখলাম- ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যেই উনার ৮০% আর্টিকেল পাবলিশড হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই খুব ভালো জার্নালে। এটাকে সন্দেহ করা যায়, কিন্তু এটাও অবিশ্বাস্য না। কারণ অনেক সময় আগে সাবমিট করলেও কোন কোন জার্নাল আর্টিকেল পাবলিশড করতে কয়েক বছর লেগে যায়।

তাই ২০২৩ সালে একসাথে ১০টা আর্টিকেল পাবলিসড হলেই বলে দেয়া যায় না, সবগুলো উনি ২০২৩ সালেই লিখেছেন। এরমধ্যে কয়েকটা হয়তো ২০২০ সালে, ২০২১, কিংবা ২০২২ সালে সাবমিট করা।

আবার দেখলাম উনার ফার্স্ট অথর হিসাবে আর্টিকেল প্রায় ২৫ শতাংশ। মানে যেসব আর্টিকেল উনি মেইন লীড এমন আর্টিকেলের সংখ্যা ২৫-এর মত। নাউ ইট মেইক সেন্স। এর অর্থ এই আর্টিকেলগুলো উনি মুল এক্সপেরিমেন্ট রান করেছেন কিংবা গবেষণা করেছেন।

এছাড়া তার বাকি আর্টিকেলগুলো উনি কোলাবোরিটিভ কিংবা গ্রুপ অথর। মূলত ল্যাববেজড কাজে একই ল্যাবে যারা গবেষণা করেন তারা একে অন্যের নাম দিয়ে একধরনের একাডেমিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন ( ব্রুনো লাতুরের এক্টর নেটওয়ার্ক থিউরী সম্পর্কে জানলে এই গেমটা ভালো বুঝতে পারবেন)।

দেখা গেল একই ল্যাবে নানারকম এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে। তাই ল্যাবমেটদের সু-সম্পর্কের খাতিরে একজন নিজের কাজে আরেকজনের নাম দিয়ে দেয় অথর হিসাবে, আবার আরেকজন যখন পেপার পাবলিশ করবে তখন সেও প্রতিদান স্বরুপ নাম দিয়ে দেয়।

এটা একাডেমিয়াতে কমন চর্চা, কিন্তু নৈতিকতার মানদন্ডে প্রশ্নবিদ্ধ। এটাকে বেআইনী কিংবা জালিয়াতি বলার সুযোগ নাই। কিন্ত এরকম ‘পেটিকোট অথরশিপ’ সাইটেশন ক্যাপিটালিজমের যুগে একদম কমন। জনাব তৌফিকের এমন আর্টিকেলের সংখ্যাই বেশি।

এগুলোকে জালিয়াতি বলার সুযোগ নেই। তবে একজন শিক্ষক ও গবেষক কোন আর্টিকেলে কতটুকু কন্ট্রিবিউট করে অথরশিপ নেবে এই নৈতিক মানদন্ড নিজে ঠিক করতে না পারলে আইন দিয়ে এটাকে এড্রেস করা যাবে না।

আমি এক ডিনের অধীন কাজ করেছি। যার হাজার হাজার সাইটেশন এই ‘পেটিকোট অথর’ স্টাইলে। তার এক বন্ধু জাপান এটোমিক এনার্জি কমিশনে গবেষনা করে আর্টিকেল ছাপাতো। আর বাংলাদেশে থাকা বন্ধুর নাম দিয়ে দিতো। যাতে প্রমোশনে আর সিভিতে ব্যবহার করতে পারে।

দুঃখজনক হলেও সত্য কোয়ান্টেটিভ ও ল্যাববেজড সায়েন্স সাবজেক্টে এই ধরনের ‘পেটিকোট অথর’-এর সংখ্যা ভুরিভুরি। জনাব তৌফিক সেই অর্থে যদি অনৈতিক হন তাহলে বাংলাদেশের একাডেমিয়ায় ‘ঠগ বাঁচতে গা উজাড়’-এর মত অবস্থা হবে।

আমার পরিচিত সেই শিক্ষক অর্গানিক কেমেস্ট্রিতে পিএইচডি। কিন্তু ডিন হওয়ার সুবাদে ছাত্রদের বায়োডাইভারসিটি কনজারভেশন পেপারেও নাম যেত উনার। একই সমস্যা দেখলাম জনাব তৌফিকের। জনাব তৌফিকের চীন থেকে করা পিএইচডি গবেষণা মূলত গ্রাউন্ড ওয়াটার নিয়ে। কিন্ত ২০২১-২২-২৩ সালে উনার বেশিরভাগ পেপার কোভিড নিয়ে।

কোভিডের সময়ে এক্সিলারেটেড রিভিউ প্রসেসের এডভান্টেজ নিয়ে গণহারে অনেকেই পাবলিশ করেছে। কিন্তু উনি এই বিষয়ের এক্সপার্ট নন। তাহলে কীভাবে পাবলিশ করলো? গেমটা সেখান- ডাটা প্লে। জনাব তৌফিক এখানে ডাটা শ্রমিকের ভূমিকা নিয়েছেন।

উনি কিছু স্টাটিস্টিকাল টুল জানেন, এই যেমন মাল্টি ভেরিয়েট এনালাইসিস এবং দুএকটা মেশিন লার্নিং সফটওয়ার জানেন। ব্যস, গনহারে ডাটা জেনারেশন আর মাল্টি ভেরিয়েট কিংবা মেশিন লার্নিং এপ্লিকশেন। উনার গত তিন বছরের সব পেপার এইরকম।

দেখা গেল একটা পেপার একই টপিকের উপর নায়ারনগঞ্জের ডেটা দিয়ে, আবার আরেকটা পেপার সেইম টপিকের উপর গাইবান্ধায়, আবার আরেকটা জয়পুরহাটে। মানে একটা স্টাটিসটিকাল টুল ব্যবহার করে উনি হয়তো এট এ টাইম ১০টা আর্টিকেল প্রডিউস করলেন। এটা সম্ভব করা কিন্তু এতে নতুন তো কোন জ্ঞান নাই।

তাই করাটা কতটুকু নলেজ কন্ট্রিবিউশন প্রশ্নটা সেখানে। ড. তৌফিকের যে সমস্যা সেটা জালিয়াতি না। সেটা কেন গবেষণা, কি গবেষণা ও জ্ঞান কি- সেটা না জানাগত সমস্যা।

এই সমস্যা আমাদের দেশে শুধু ড. তৌফিকের না, হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের। তারা গবেষণা করে, গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। কিন্তু জানেন না, এই গবেষণা কেন করলো এবং কি কাজে লাগবে? মূলত ‘ফিলোসফি অব সায়েন্স’ না জানা।

এরা বেশিরভাগই কার্ল পপার পড়ে নাই কখনো। কিন্তু পিএইচডি করে ফেলছে। সমস্যা সেখানে। আমাদের আন্ডারগ্রেড কিংবা মাস্টার্সে রিসার্চ মেথোডলজি নামে যে কোর্স পড়ানো হয় সেখানে দুএকটা স্টাটিসটিকাল টুল শেখানো ছাড়া ‘ফিলোসফি অব রিসার্চ’ তো শেখানো হয় না।

তাই আমরা ডাটা জেনারেট করি, আর্টিকেল লিখি, আর্টিকেল ছাপাই। কিন্তু জানি না সেই আর্টিকেল কি ইন্ডাকটিভ নাকি ডিডাকটিভ। এপোস্টোমলজি আমাদের কাছে ক্লিয়ার না, অন্টোলজি বুঝি না। মানে কীভাবে জ্ঞানটা উৎপাদন করলাম (এপিস্টোমলজি), যে জ্ঞান উৎপাদন করলাম সেই জ্ঞান আসলে আমাদের নতুন কি আন্ডারস্টান্ডিং গ্রো করালো (অন্টোলজি)—এইগুলো না বুঝেই টপ ২% সায়েন্টিস হয়ে যাওয়াটা একাডেমিক পর্নোগ্রাফি। আর যারা এই দৌড়ে দৌড়ায় তারা পর্নোগ্রাফিক এক্টর।

জনাব তৌফিক জালিয়াতি করছে আমার মনে হয় নাই। বরং যে একাডেমিক সাইটেশন ক্যাপিটালিজম গ্রো করছে উনি সেটার এডভান্টেজ নিয়েছে। জনাব তৌফিককে দোষী সাব্যস্ত করলে দেশের এমন হাজার গবেষকও একই দোষে দোষী হওয়ার কথা।

এইরকম সেইম ল্যাব ‘পেটিকোট অথর’, প্রমোশনের জন্য নাম দিয়ে দেয়া ‘ভাইখেলা অথর’, একই স্টাটিসকাল টুল ও টপিক দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ১০টা ডাটা জেনারেট করে ১০টা আর্টিকেল লেখা ‘ডাটা শ্রমিক অথর’, আলু তরকারীর মত একটা স্টাটিসকাল টুল জানলে সেটা জানাজায় অংশগ্রহনকারীর সংখ্যা থেকে শুরু করে বাঘ গননা সবখানে ব্যবহার করে অথরশীপ ক্লেইম করা ‘খয়রাতি অথর’—এইগুলো নিয়েই আমাদের একাডেমিয়া।

এই ভিড়ের মধ্যে মৌলিক জ্ঞান উৎপাদন করা গবেষকও হয়তো আছেন। যারা আসলেই জানেন গবেষণাটা কেন করছে,  কি কাজে লাগবে। কিন্তু তারা হয়তো একাডেমিক পর্নোগ্রাফিক ওয়ার্ল্ডে জনপ্রিয় এক্টর না। তাই আমরা যারা সাইটেশন ও আর্টিকেল সংখ্যা দিয়ে সাময়িক সুখে নিমজ্জিত, তাদের চোখে পড়ছে না।

আর্টিকেল সংখ্যা ও সাইটেশন দিয়ে কারো জ্ঞান বুঝা যায় না। জ্ঞান বুঝতে হয় সেই আর্টিকেল সমাজ, জাতি,  রাষ্ট্র কিংবা পৃথিবীতে কি কাজে লাগলো, সেটা দিয়ে। আর্টিকেল নাম্বার আর সাইটেশন একটা বাণিজ্য। আর যারা না বুঝে এই নাম্বারের পেছনে দৌড়ায় তারা এই একাডেমিক ক্যাপিটালিজমের ‘ছোট ফেরিওয়ালা’। এদের জ্ঞানী ভেবে ধোকা খাওয়ার কিছু নাই।

ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেমে এমন ফেরিওয়ালা আসবে, যাবে। নতুন নতুন পন্য আসবে তখন সেটার বাজার তৈরি হবে। যেমন কোভিড নিয়ে লক্ষ আর্টিকেল পাবলিশড হলো, তার ১% যদি কাজে লাগে তাহলে তো পৃথিবীতে ইনফেকশাস ডিজিজ গবেষণাই চেঞ্জ হয়ে যাওয়ার কথা। মূল কথা একেকটা আর্টিকেল কয়েক ডলার দিয়ে ছাপাবে আর কিনতে হবে—এই বাণিজ্য না বুঝলে এই নাম্বার গেম বুঝবেন না।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক


সর্বশেষ সংবাদ