১৫ অক্টোবর ২০২৩, ১১:০৯

স্নাতকের চার বছরে কোন বর্ষে কী করবে?

প্রভাষক মো. নাসির উদ্দিন মিঞা  © ফাইল ছবি

বিশ্ববিদ্যালয় একটা নতুন জগৎ। এ জগতে পা রেখে কেউ নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন, আবার কেউ হারিয়ে যান ভিন্ন জগতে। পড়ালেখার চাপ, নতুন পৃথিবীতে পা রাখার রোমাঞ্চ সামলে স্নাতকের চার বছরে কীভাবে নিজেকে তৈরি করবে? পরামর্শ দিয়েছেন বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক মো. নাসির উদ্দিন মিঞা। 

আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত কোথাও না কোথাও ছাড় দিয়ে চলতে হয়। কখনো সুযোগের সঙ্গে, আবার কখনো বা আমাদের বাবা-মায়ের স্বপ্নের সঙ্গে নিজের স্বপ্নকে সমন্বয় করতে হয়। এর ফলে অনেক সময় কাঙিক্ষত বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে আমাদের পড়ালেখার  সুযোগ হয়ে ওঠে না। তবে যেখানেই ভর্তি হই না কেন, নিজের পথটা নিজেকেই তৈরি করে নিতে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জীবন গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়কাল। সুতরাং এ সময়ের সঠিক ব্যবহার একজন শিক্ষার্থীর জীবনে যেমন সফলতা বয়ে আনতে পারে, তেমনি কোন ভুল পদক্ষেপ জীবনে ডেকে আনতে পারে কঠিন পরিণতি। সুন্দর ভবিষ্যত বিনির্মাণের লক্ষ্যে যে সব শিক্ষার্থী এ বছর অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছো, তাদের উদ্দেশ্যে কিছু পরামর্শ থাকবে।

প্রথমেই বলব, যে ক্যাম্পাসেই ভর্তি হওনা কেন, সবার আগে সে ক্যাম্পাসটাকে চেনো। এক্ষেত্রে ক্যাম্পাসটাকে ভালো করে চেনার জন্য ১৫ দিন বা এক মাস সময় নিতে পারো। ক্যাম্পাসে কি কি সংগঠন আছে, সে সম্পর্কে জানো। তুমি কোন সংগঠনে যুক্ত হতে চাও এবং ক্যাম্পাসে কি কি সুযোগ-সুবিধা আছে, এগুলো সম্পর্কে জানো। ক্যাম্পাসকে  তোমার দেয়ার কি  আছে, সবকিছুই জেনে নাও। ক্যাম্পাস চেনার জন্য এক মাসের বেশি সময় নেওয়া ঠিক হবে বলে আমি মনে করি না।

এরপর তুমি তোমার সিলেবাস ভালো করে দেখো। সিলেবাস ভালো করে বোঝো। সিলেবাসের কোন কোন বিষয়গুলো অধ্যয়ন করতে হবে (Outline) এবং অধ্যয়ন করতে হলে কোন কোন বইয়ের সহায়তা নিতে হবে (Reading List), এ সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকা প্রয়োজন।

প্রত্যেকটি ক্লাসের পূর্বে শিক্ষার্থীদের আলোচ্য বিষয়ে একটি ধারণা নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। তাতে ক্লাসের বিষয়গুলো খুব সুন্দরভাবে বুঝতে সহায়তা করবে। এরপর কর্তব্যরত শিক্ষক তার ওই বিষয়টিতে পাঠদান করবেন এবং বিভিন্ন বিষয়ের উপর দিকনির্দেশনা দেবেন। যদি শিক্ষার্থী বাসায় এসে ওই বিষয়ের প্রতি আরেকটু সময় দেয়, তাহলে ওই বিষয়ের ওপর তার সুন্দর ধারণা চলে আসবে। এভাবে যদি একজন শিক্ষার্থী এগোতে পারে তাহলে আশা করা যায়, তার পাঠ্য বিষয়ের ওপর আর কোনো সমস্যা থাকবে না।

সাধারণভাবে প্রযোজ্য কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, একজন শিক্ষার্থীর ভাষাগত দক্ষতা তৈরি করা। আমরা বাংলা মাতৃভাষা হিসেবে শিখে থাকি, তবে এর পাশাপাশি কমপক্ষে আরেকটি ভাষায় খুব ভালোভাবে নিজেকে দক্ষ করতে হবে, সেটা  ইংরেজিও হতে পারে। যদি কেউ বাংলা এবং ইংরেজিতে ভালোভাবে দক্ষতা অর্জন করতে পারে তাহলে এর পাশাপাশি তিনি আরও কিছু ভাষা অর্জন করতে পারেন।

তবে একজন শিক্ষার্থী এ সময়ের মধ্যে যে শুধু সিলেবাসভিত্তিক পাঠ্য বিষয়ের ওপরেই গুরুত্ব দেবে এমনটা ভাবা যাবে না। কেননা আমাদের দেশে বিষয়ভিত্তিক কাজের যে ক্ষেত্র এটা খুবই কম। এক্ষেত্রে আমাদের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। যুগের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার্থীকে পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি আরো বিভিন্ন বিষয়ের দক্ষতা অর্জন করতে হবে।

একটি সাধারণভাবে প্রযোজ্য কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, একজন শিক্ষার্থীর ভাষাগত দক্ষতা তৈরি করা। আমরা বাংলা মাতৃভাষা হিসেবে শিখে থাকি, তবে এর পাশাপাশি কমপক্ষে আরেকটি ভাষায় খুব ভালোভাবে নিজেকে দক্ষ করতে হবে, সেটা  ইংরেজিও হতে পারে। যদি কেউ বাংলা এবং ইংরেজিতে ভালোভাবে দক্ষতা অর্জন করতে পারে তাহলে এর পাশাপাশি তিনি আরও কিছু ভাষা অর্জন করতে পারেন।

যেমন- স্প্যানিশ, জার্মান, রুশ এসব ভাষায় সে দক্ষতা অর্জন করতে পারে। তবে বর্তমান সময়ে চাইনিজ এবং জাপানিজ ভাষার খুব কদর রয়েছে। এসব ভাষা শিখে একজন শিক্ষার্থী তার ক্যারিয়ার গড়তে পারে। সুতরাং কেউ যদি বাংলা এবং ইংরেজির পাশাপাশি অন্য কোনো ভাষা শিখতে চাই, সে ক্ষেত্রে আমি স্প্যানিশ, চাইনিজ, জার্মান, জাপানি ও রুশ ভাষাকে এগিয়ে রাখব।

ভাষায় অর্জনের দক্ষতার পাশাপাশি শিক্ষার্থী নিজের ভালোলাগার কিছু জায়গা খুঁজে নিতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে তার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করতে পারে। যদি কারো ফটোগ্রাফি ভালো লাগে সেক্ষেত্রে সে ফটোগ্রাফির দিকে ঝুঁকতে পারে। সে খুঁজবে তার ক্যাম্পাসে ফটোগ্রাফির কোনো কার্যক্রম আছে কিনা বা কোনো অ্যাসোসিয়েশন আছে কিনা। কেউ চাইলে ডিবিটিংয়ের দিকে মনোযোগ দিতে পারে, যদি সে ডিবেটিং পছন্দ করে।

এছাড়াও ভালো লাগলে কেউ ভ্রমণ গাইড হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন গবেষণা কোর্স থাকে সেক্ষেত্রে চাইলে কেউ গবেষণা কোর্সেও ভর্তি হতে পারে। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হয় শিক্ষার্থীরা সেখানে অংশগ্রহণ করবে। এছাড়াও বর্তমানে দেশ যেহেতু প্রযুক্তি নির্ভর, সেহেতু প্রযুক্তি নির্ভর যে কোনো বিষয়ে সে দক্ষতা অর্জন করতে পারে। দক্ষতা অর্জনে গুরুত্ব দেয়াটা একজন শিক্ষার্থীর প্রথম বর্ষ থেকেই শুরু হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

প্রথম বর্ষে একজন শিক্ষার্থী তার ভালো লাগার জায়গাগুলো খুঁজে নেবে এবং সিলেবাসের পাশাপাশি এসব বিষয়ে সে তার দক্ষতা অর্জন করবে। একজন শিক্ষার্থী যখন দ্বিতীয় বর্ষে যাবে, সে শিক্ষার্থীদের প্রথম বর্ষে যে বিষয়গুলোতে দক্ষতা অর্জন করেছিল, সে বিষয়গুলোকে ধরে রাখবে এবং সিলেবাসের যে পাঠ্যক্রম সেটার পাশাপাশি পূর্ব উল্লিখিত বিষয় ভালোভাবে একটা দক্ষতা অর্জন করতে পারবে। প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় বর্ষ এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে তার শিক্ষাবর্ষ শেষ করতে পারে।

একজন শিক্ষার্থী তৃতীয় বর্ষে উঠবে, তখন সে নিজেই বুঝতে পারবে তার ক্যারিয়ার কোন দিকে গঠন করতে হবে। আমি সব সময় বলব যদি কোনো বিষয়ে ভালো না লাগে সেদিকে ক্যারিয়ার গঠন করলে তুমি ভালো ফল পাবে না এবং নিজের মেধা মননের সম্পূর্ণটা তুমি দিতে পারবে না। সেজন্য নিজের ভালোলাগার বিষয়টা অবশ্যই সিলেক্ট করতে হবে।

যখন একজন শিক্ষার্থী তৃতীয় বর্ষে উঠবে, তখন সে নিজেই বুঝতে পারবে তার ক্যারিয়ার কোন দিকে গঠন করতে হবে। আমি সব সময় বলব যদি কোনো বিষয়ে ভালো না লাগে সেদিকে ক্যারিয়ার গঠন করলে তুমি ভালো ফল পাবে না এবং নিজের মেধা মননের সম্পূর্ণটা তুমি দিতে পারবে না। সেজন্য নিজের ভালোলাগার বিষয়টা অবশ্যই সিলেক্ট করতে হবে। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে তৃতীয় বর্ষ থেকেই ওই বিষয়ে গুরুত্ব অনুযায়ী অতিরিক্ত সময় দেয়া যেতে পারে।

যেমন- আমি আগেই বলেছি কারো যদি ফটোগ্রাফি ভালো লাগে তাহলে সে ফটোগ্রাফিতে সময় দিতে পারে। এ প্রক্রিয়া তার একাডেমিক রেজাল্টের পাশাপাশি ফটোগ্রাফি সাইটে একটা দক্ষতা বৃদ্ধি করবে এবং ফটোগ্রাফি দিয়ে সে তার নিজের ক্যারিয়ার গড়তে পারবে। কারো যদি প্রযুক্তি ভালো লাগে তাহলে সে প্রযুক্তিভিত্তিক যেকোনো বিষয়ে তার ক্যারিয়ার গড়তে পারে। একজন শিক্ষার্থী প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে যে প্রাথমিক জ্ঞানগুলো অর্জন করেছিল, তৃতীয় বর্ষে এসে সে তার এ জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে উচ্চতর দক্ষতা অর্জনের জন্য মনোনিবেশ  করতে পারে।

একজন শিক্ষার্থী যখন চতুর্থ বর্ষে ওঠে তখন সম্পূর্ণভাবে নিজেকে তার ক্যারিয়ারের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। সে যে পেশায় তার ক্যারিয়ার গঠন করবে, সেজন্য চতুর্থ বর্ষ থেকেই সম্পূর্ণভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে তুলতে হবে। কেউ যদি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতে চায় সেক্ষেত্রে চতুর্থ বর্ষ থেকেই তাকে চাকরির জন্য মনোনিবেশ করতে হবে। এখানেও একাডেমিক পড়ার পাশাপাশি চাকরির জন্য তাকে প্রচুর পড়ালেখা করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের সব সময় মনে রাখতে হবে ‘ছাত্র নং অধ্যায় নং তপঃ’। অর্থাৎ ছাত্রদের একমাত্র তপস্যা হচ্ছে, পড়ালেখা করা বা জ্ঞানার্জন করা। এক্ষেত্রে আমি একজন শিক্ষার্থীকে বলব, পড়ো , পড়ো এবং পড়ো। একজন শিক্ষার্থীর তার সিলেবাসের বাইরে সপ্তাহে কমপক্ষে একটি বই পড়া উচিৎ। যদি সম্ভব না হয় তাহলে মাসে অন্তত দুটি বই পড়া উচিৎ। বই পড়া থেকে সে যেন নিজেকে কখনো বিরত না রাখে।

আরো পড়ুন: ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আজই শেষ সুযোগ

এ বিষয়ে একটি কথা বলতে চাই যে, রুশরা পৃথিবীর সব থেকে বেশি পড়ুয়া জাতি। রুশ, জার্মানরা এত ওপরে পৌঁছেছে শুধুমাত্র পাঠাভ্যাসের কারণে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, একজন মুসলিম গড়ে সারা জীবনে মাত্র ছয় মিনিট তার ক্লাসের বাইরের পড়া পড়ে। এজন্য আমরা দেখছি, একটা সময়ের গৌরবোজ্জ্বল মুসলিম জাতি এখন কতটা নিচে অবস্থান করছে। সুতরাং আমি বলব পড়ো এবং পড়ো। প্রচুর পড়ালেখা করতে হবে। তাহলে দেখবে, তুমি তোমার ভেতরের জগৎটাকে চিনতে পারছো, যা তোমার মেধা মননের পথ উন্মোচিত করবে।

আশা করি, প্রথম বর্ষ থেকে তোমরা বিষয়টি যদি ফলো করো তাহলে ভালো ফল পাবে। এক্ষেত্রে একটি রুটিন করে নাও। সে রুটিনে যেন তোমার ক্লাসের পড়ালেখা অন্ততপক্ষে চার ঘণ্টা থাকে। যদি ব্যস্ততার কারণে, অসুস্থতার কারণে বা পার্ট টাইম জবের কারণে চার ঘণ্টা পড়তে না পারো, তাহলে প্রতিটা কোর্সের জন্য সে এক ঘণ্টা করে পড়ার  সুযোগ পায়, তাহলে সেটুকুই কাজে লাগাবে। এতটুকু অন্তত নতুন বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য আমার অনুরোধ থাকবে ।

সর্বশেষ একটি কথা দিয়ে শেষ করব। একটি অপরিপক্ক আম যখন পচে যায়, তখন সেটাকে আমরা খেতে পারিনা। বরং সেটা ফেলে দিতে হয়। কিন্তু একটি আম যখন পরিপক্ক হওয়ার পরে পচে যায়, তখন সেটাকে আমরা খেতে না পারলেও সেই আঁটি থেকে একটি গাছ হয়। সে গাছে বা বৃক্ষে প্রচুর ফল ধরে ওই ফল অন্যরা ভোগ করতে পারে। সুতরাং বলব যে, পরিপক্ক হওয়ার আগে পচে যেও না। যদি পচতেই হয় সেক্ষেত্রের পরিপক্ক হওয়ার পরে পচো।

তবে আমি কখনোই চাই না, একজন শিক্ষার্থী নষ্ট হয়ে যাক বা ধ্বংস হয়ে যাক। আমি চাই সে যেন, সবসময় ভালো থাকে এবং সুন্দর একটি ক্যারিয়ার গঠন করতে পারে। তোমাদের জন্য শুভকামনা।

লেখক: ৩৫তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার।