অভিজ্ঞতায় ঈদ আনন্দ: অতীত-বর্তমান

  © টিডিসি ফটো

নজরুলের “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ”—গানটি শোনার সাথে সাথেই কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনটা উদ্বেলিত হয়ে যায়। মনে করিয়ে দেয় পুরনো সেই ঈদের স্মৃতিগুলো। মফস্বলে শৈশব কৈশোরের দুরন্তপনায় ঈদ উদযাপনে যে আনন্দ ছিল হাল আমলে সেটি দায়িত্ব ছাড়া অতিরিক্ত কোন অনুভূতি হৃদয় বহন করে না।

একটা সময় ছিল রমজান মাসের শুরু থেকেই ঈদ উদযাপনের আমেজ শুরু হতো। প্রতি রাতে তারাবি নামাজ পড়ার অজুহাতে বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় ঘুরে বেড়ানো, আড্ডা মারা ইত্যাদি ছিল নিয়মিত ব্যাপার। চাঁদ রাতে হৈ-হুল্লোড় এর মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে এটি চলতো ঈদের পরে আরও সপ্তাহ খানেক। নব্বইয়ের দশকে ঈদ বিনোদনের প্রধান মাধ্যমই ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন। সেই যুগে বিটিভিতে প্রচারিত হওয়া হানিফ সংকেতের উপস্থাপনায় ‘ইত্যাদি’ ও সৈয়দ হাসান ইমামের উপস্থাপনায় ‘আনন্দমেলা’ অনুষ্ঠান দুটির জন্য বছর ঘুরে ঈদের জন্য অপেক্ষা করতাম। তখনকার সময়ে ক্যাবল নেটওয়ার্ক নামক কোন উপাদানের অস্তিত্ব জানা ছিল না। তাছাড়া বিটিভির ঈদের অন্যান্য নাটকও ছিল আমাদের ঈদ বিনোদনের বিশেষ আকর্ষণ। আরেকটা রেওয়াজ ছিল, ঈদের আগের দিন থেকে ঈদ উপলক্ষ্যে মুক্তি পাওয়া নতুন নতুন গানের এলবাম পাড়া-মহল্লায় ক্যাসেট প্লেয়ার কিংবা সাউন্ড বক্সে উচ্চস্বরে বাজানো। আরও কত কি !

শিশু-কিশোর বয়সে প্রায় সময়ই ঈদ করতে সপরিবারে গ্রামে দাদা-নানার বাড়ি যেতাম। মনে পড়ে আত্মীয়-স্বজনের সাথে অনেক দূর হেঁটে ঈদের জামাতে অংশ নিতাম। উল্লেখ্য, সেসময় গ্রামে গ্রামে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হতো না, কয়েকটি গ্রাম মিলে একটি মাত্র বড় জামাত অনুষ্ঠিত হতো। এতে বিভিন্ন গ্রামের লোকজন যেমন একত্রিত হওয়ার সুযোগ পেত তদ্রূপ তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতির বিনিময় ঘটতো খুব সহজেই। আর বর্তমান ডিজিটাল যুগে গ্রামে গ্রামে প্রতিযোগিতা দিয়ে একাধিক জামাত অনুষ্ঠিত হয় বটে কিন্তু সেই সম্প্রীতি বিনিময় আর হয় না। তরুণ বয়সে আমার ঈদ উদযাপন নিয়মিতভাবেই মফস্বল শহরে হতো। সেসময় বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য বাহারি ঈদ কার্ড প্রেরণ করতাম। ঈদের দিন নতুন জামা-কাপড় পরে সুগন্ধি মাখিয়ে সেমাই মুখে দিয়ে বাবার সাথে তিন ভাই একত্রে নামাজ আদায় ছিল এক প্রকার পারিবারিক প্রথা। বলা যায় নামাজ আদায় করে সালামি গ্রহণ পর্যন্তই কেবল পরিবারের সাথে থাকা হতো। তারপর বন্ধুদের সাথে অজানা উদ্দেশ্যে হারিয়ে যাওয়া। আর বড়বেলায় যখন নিজের আলাদা একটি পরিবার হলো তখন স্ত্রী-সন্তানদেরকে আনন্দ দেয়ার মাঝেই অনেকটা নিজের আনন্দ খুঁজে নিতে হয়। তাই এটা অনস্বীকার্য যে, শৈশব-কৈশোরের ঈদ আনন্দের স্মৃতিই সবার মনে চিরঅম্লান রয়ে যায়।

মনে পড়ে ১৯৯৪ সালে মাত্র ১৩ টাকায় অসাধারণ একটি ঈদ উদযাপনের কথা। সবে ক্লাস ফোরে পড়ি। এক টাকা এক টাকা করে মায়ের কাছে জমানো ৬ টাকাসহ তাঁর কাছ থেকে ঈদ বোনাস বাবদ প্রাপ্ত আরও ৭ টাকা, সব মিলিয়ে ১৩ টাকায় ঈদ করতে বের হই। কিন্ত কী না করেছিলাম সে সময়ে! দুই টাকায় সাইকেল ভাড়া করে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ানো এবং এক টাকায় চানাচুর, তিন টাকায় রিং চিপস, ছয় টাকায় আইসক্রিম খাওয়ার পরেও এক টাকা পকেটে নিয়ে বাড়ি ফিরি। আর এখন এসি গাড়িতে চড়ে পকেটে হাজার টাকা নিয়েও কি সেই আনন্দ পাই!

সময়ের সাথে সাথে যেমন ঈদের রং বদলায় তেমনি বয়সের সাথে সাথে উদযাপনের ধরণেও আসে পরিবর্তন। বর্তমানে কেউ আর নির্দিষ্ট কোন অনুষ্ঠান দেখার জন্য অপেক্ষা করে না। টিভিতে ইউটিউব, নেটফ্লিক্স সেই জায়গাটি দখল করে নিয়েছে। একটু অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তি আর গ্রামে যান না, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পটে ঘুরে বেড়ান। আর ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ের ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ভার্চুয়াল পদ্ধতিই সহজ ও একমাত্র মাধ্যম। সবকিছু ছাড়িয়ে আমার  ঈদ আনন্দটা একটু ভিন্নভাবে জায়গা দখল করে আছে। কেউ বিপদগ্রস্ত হলে তার জন্য কিছু করতে পারা কিংবা ঈদে কাওকে দান বা উপহার দেয়ার মাঝে একরকম আনন্দ ধরা দেয়। একটি বিষয় না বললেই নয়, এই প্রজন্মের তরুণদের আড্ডাখানার অন্যতম আলোচ্য বিষয়—এখনকার ঈদ বেশি আনন্দের নাকি সেকালেই বেশি ছিল!

এই যুগে যেমন সালামি বেড়েছে তেমনি সালাম করার ধরণেও এসেছে পরিবর্তন। সালাম না করেও সালামি গ্রহণ একটি স্বাভাবিক রীতিতে পরিণত হচ্ছে। পরিশেষে বলতে চাই, আমি ঐ ১৩ টাকায় ঈদ উদযাপনে যে আনন্দ পেয়েছি, বর্তমানে হাজার টাকা খরচ করে সেই আনন্দ আর পাই না। হয়তো আর পাবও না!

লেখক: সিনিয়র সহকারি সচিব, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ