১৫ রোজায় কী হবে
প্রিয় দেশবাসী, আপনাদের একটি ভয়াবহ এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সতর্ক করতে চাই। আর তা হলো, হাদিসে এসেছে, যে বছর রমজান শুরু হবে শুক্রবারে এবং মধ্য রমজান অর্থাৎ ১৫ রমজান হবে শুক্রবার; সেই বছর ওই শুক্রবারে আকাশে একটি বিকট আওয়াজ হবে। যেই আওয়াজের মাধ্যমে ৭০ হাজার মানুষ অন্ধ হয়ে যাবে, ৭০ হাজার মানুষ বোবা হয়ে যাবে এবং আরও ৭০ হাজার মানুষ বেহুশ হয়ে যাবে। এদিন আরও ভয়াবহ অনেক ঘটনা ঘটবে।
সেসময় যে সকল লোকেরা ঘরের মধ্যে ঢুকে যাবে, কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকবে, লোকেরা যদি সেজদায় লুটিয়ে পড়ে তাকবীর বলতে থাকে, তাদের ঘরের দরজা জানালা যদি বন্ধ করে দিয়ে রাখে—তাহলে তারা বাঁচতে পারবে। অন্যথায় সকলে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। এ বছরের ১৫ রমজান কিন্তু শুক্রবার। অর্থাৎ হাদিসের সাথে অনেকটা মিলে যাচ্ছে।
এই বিষয় নিয়ে অনেকে আমাদের কাছে জানতে চেয়েছেন। তারা মূলত এমন পরিস্থিতিতে তাদের করণীয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। এ বিষয়ে আজকে বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
আমরা জানতে পারি, হাদিসটি ফাইরুজ আল দাইলামি বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সা.) বলেছেন বলে তিনি দাবি করছেন। এটি ইমাম তাবারানী (র.) তার সংকলিত ‘আল মুজামুল কাবীরে উল্লেখ করেছেন। হাদিসটি হচ্ছে এরকম যে ‘‘রমজানে একটি বিকট আওয়াজ হবে। সাহাবী (রা.) বলেন ইয়া রাসুলুল্লাহ এটা কি রমজানের শুরুতে হবে নাকি মধ্যখানে হবে নাকি শেষে হবে? তখন রাসূল (সা.) বললেন এটি মধ্য রমজানে হবে। অর্থাৎ ১৫ রমজানে এটি ঘটবে; যদি তা শুক্রবার হয়।
তখন সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন তাহলে উম্মত থেকে কারা বেঁচে থাকবে রাসূলুল্লাহ (সা.)? তখন উত্তরে তিনি বলেন সেই সময় যে সকল লোকেরা ঘরের মধ্যে ঢুকে যাবে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকবে এবং লোকেরা যদি সেজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং তাকবীর বলতে থাকবে এবং তাদের ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে রাখবে; তাহলে তারা বাঁচতে পারবে।’’
হাদিসে উল্লেখিত ১৫ রমজানে দুইটি আওয়াজ হবে। প্রথম আওয়াজটি হবে জিব্রাইল (আ.) এবং দ্বিতীয় আওয়াজটি হবে শয়তানের। রমজান মাসের পরে শাওয়াল মাসে সারা পৃথিবীতে যুদ্ধ-বিগ্রহ ছড়িয়ে পড়বে।এরপর জ্বিলকদ মাসে লোকেরা দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়বে। এতে তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হবে।
আরও পড়ুন: রমজান কেন্দ্রিক সমাজে প্রচলিত ভুল-ভ্রান্তি
এরপর জিলহজ্জ মাসে হাজীদের ওপরে আক্রমণ করা হবে এবং তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করা হবে। এরপর মহরম মাসের প্রথম অংশে আমার উম্মাদের জন্য অনেক কঠিন একটা সময় যাবে। তবে পরের অংশে আমার উম্মাদের জন্য অনেক আনন্দকর কিছু থাকবে।
এ বিষয়ে ঠিক আমরা আরেকটি হাদিস দেখতে পাই। যে হাদিসটি ইবনে মাসুদ (রা.) বর্ণনা করেছেন। ‘‘এ সময় বিকট আওয়াজ হবে। তখন শাওয়াল মাসে বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ ছড়িয়ে পড়বে। জ্বিলকদ মাসে তখন বিভিন্ন যে গোত্রগুলো আছে সেগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। মহরম এবং জিলহজ্জ মাসে তখন রক্ত প্রবাহিত হবে অর্থাৎ মারামারি ইত্যাদি সংঘটিত হবে।’’
তিনি মুহররম মাসের কথা তিনবার বলে আফসোস করে বলেন ‘‘লোকদেরকে সেখানে অকাতরে হত্যা করা হবে। তখন সাহাবীরা রাসূলকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘সইহা’ মানে কি? তিনি বলেন এটি হচ্ছে মধ্য রমাজানের জুমার রাতে একটি বিকট আওয়াজের নাম। এতে একটি বিকট আওয়াজ হবে। এ আওয়াজে ঘুমন্ত ব্যক্তিরা জেগে উঠবে। যারা দাড়িয়েছিল তারা বসে পড়বে। আর নারীরা এ জুমার রাতে তাদের ঘর-বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে।’’
তিনি আরো উল্লেখ করেন ‘‘এটা সেই বছরে হবে, যে বছর চারিদিকে অনেক বেশি ভূমিকম্প হবে শৈতপ্রবাহ হবে। আর এই রমজান মাসটি শুরু হবে বৃহস্পতিবার রাতে। সেই রজমানে এ ঘটনাটি ঘটবে।’’
তিনি বলেন ‘‘এই ১৫ রমজানে তোমরা ফজরের নামাজ পড়ার পরে ঘরে ঢুকে যাবে এবং নিজেদেরকে কম্বলে আবৃত করে নেবে, জানালা বন্ধ করে দিবে। কান বন্ধ করে রাখবে, যখন তোমরা আওয়াজ শুনতে তখন তোমরা সিজদায় লুটিয়ে পড়বে এবং বলতে থাকবে সুবহানাল্লাহ কুদ্দুস, রব্বুনাল কুদ্দুস। কেউ যদি এটি বলে তবে সে মুক্তি পাবে। যে এই কাজটি করবে না সে ধ্বংস হয়ে যাবে।’’
আরও পড়ুন: রমজানে হলে কেমন সময় কাটে রাজশাহী কলেজ শিক্ষার্থীদের
এবার যদি আমরা হাদিসের বিশ্লেষণে যাই, তবে প্রথম যে হাদিসটি ইমাম তাবারানী উল্লেখ করেছেন সে হাদিসটির ব্যাপারে শেখ আলবানী বলেছেন হাদিসটি মাওজু, অর্থাৎ বানোয়াট। দ্বিতীয়তঃ ইবনুল জাওযী বলেছেন হাদীসটি সহিও নয়। ওকাইলী বলেছেন এ হাদিসটির বর্ণনাকারী আবদুল ওয়াহহাব। তিনি কোনো মানুষই নন। তার কোনো ব্যক্তিত্ব নেই। তার হাদিস বর্ণনার করার মতোও কোনো যোগ্যতা নেই।
ইবনে হিব্বান বলেছেন যে আবদুল ওয়াহহাব হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, তিনি আসলে হাদিস চুরি করতেন। তিনি বানিয়ে বানিয়ে এসব হাদিস বর্ণনা করতেন। তার মাধ্যমে হাদিসের দলিল নেওয়া জায়েজ নেই। এ ব্যক্তির হাদিস প্রত্যাখ্যত।
ইমাম জাহাবী বলেছেন এ ব্যক্তির কথাও বাতিল, এই হাদিসটিও বাতিল। ইবনুল কাইয়ুম (র.) বলেছেন ভবিষ্যৎ বর্ণনাকারী যে ধরনের হাদিসগুলোতে দিন-তারিখ-খনের উল্লেখ করা আছে, সেগুলো গ্রহণ করা যাবে না। এগুলোর অধিকাংশই দুর্বল।
আমরা দ্বিতীয় যে হাদিসটি বর্ণনা করেছি তার ব্যাপারে শেখ বিন বাজ বলেছেন আমার কাছে এমন সংবাদ এসেছে কিছু জাহেল রাসূল (সা.)-এর নাম ব্যবহার করে এমন কিছু হাদিস চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে যা রাসূল (সা.) কখনোই বর্ণনা করেননি।
ইবনে মাসুদ বলেছেন এই হাদিসের কোনো ভিত্তি নেই। এটি একটি মিথ্যা এবং বানোয়াট বক্তব্য। এভাবে শুক্রবারে রজমানের শুরু এবং মধ্য রজমানের শুক্রবার হওয়ার ঘটনায় মুসলমানদের জীবনে এটাই প্রথম নয়। এমন ঘটনা বহুবার হয়েছে। অতএব রমজানের এমন বার/তারিখ নিয়ে প্রকট শব্দ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
শেখ বিন বাসেত বলেছেন যাদের সামান্য জ্ঞান আছে, তারা যেন বুঝে—এ জাতীয় কথাগুলোর প্রচার করা জায়েজ নেই। এ হাদিসকে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলা দরকার। এটাকে ধ্বংস করে দেয়া দরকার। কারণ এটা হাদিস নয়, মিথ্যা বক্তব্য। একইসঙ্গে এ হাদিস যে সত্য নয়, এ সংবাদটি মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া।
এরপর তিনি বলেন মানুষের উচিৎ আল্লাহকে ভয় করা। তাদের মৃত্যু আসার আগ পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদত করা। কেয়ামত সত্যিকার অর্থেই সংঘঠিত হবে। কিন্তু কেয়ামত সংঘঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে আমরা যেন কোনো বানোয়াট বক্তব্য প্রচার না করি। বরং আমাদের আল্লাহকে ভয় করা দরকার। তার ইবাদত করা দরকার। তার আনুগত্যে আমাদের লুটিয়ে দেয়া দরকার।
প্রিয় পাঠক, হাদিসের ব্যাখ্যায় আমরা যে কথাটি বলতে চাই, হাদিসটি বানোয়াট। এখানে হাদিসের বর্ণনায় যে শুক্রবার এবং মধ্য রজমানের কথা বলা হয়েছে—সেটি আসলে কোন দেশের কথা বলা হয়েছে? আমরা তো জানি, আরব বিশ্বে রমজান শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার। অর্থাৎ তারা বুধবার রাতে সাহরি খেয়েছেন। তারাবি আদায় করেছেন এবং বৃহস্পতিবার থেকে রোজা রাখা শুরু করেছেন।
আমরা ভারতীয় উপমহাদেশে বৃহস্পতিবার রাতে সাহরি খেয়ে শুক্রবার থেকে রোজা রাখা শুরু করেছি। তাহলে হাদিসে কোন সময়ের কথা বলা হচ্ছে? সমগ্র বিশ্বে রোজা শুরু করেছে আরও আগে। সমগ্র বিশ্বে তো আসলে ১৫ রমাজান শুক্রবার নয়, বরং ১৬ রমজান শুক্রবার। আমাদের এখানে ১৫ রমজান শুক্রবার। তাহলে বিষয়টি তো মিলছে না।
আমাদের মনে রাখতে হবে রাসূল (সা.) বলেছেন, আমার এ উম্মাহ রহমতপ্রাপ্ত উম্মাহ। অন্যান্য জাতিগুলোকে আল্লাহ যেভাবে বিকট আওয়াজের মাধ্যমে, ভূমিকম্পের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছেন—এ উম্মাহকে তিনি সেভাবে ধ্বংস করে দেবেন না। কিন্তু এ জাতির উপর এসব বিপদগুলো আসবে। এখানে যে হাদিসের মাধ্যমে সবকিছু ধ্বংস করে দেওয়ার কথা শুনছি, এর মাধ্যমে কিন্তু আল্লাহ তায়ালা পূর্ববর্তী জাতিগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
কিন্তু মুসলিম উম্মাহের ব্যাপারে অর্থাৎ রাসূল (সা.) আগনের পরে এ জাতীয় ঘটনাগুলো ঘটবে না বলে সহীহ হাদিসের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি। অতএব এ বক্তব্যগুলো পরিপূর্ণভাবে মিথ্য এবং বানোয়াট। এগুলোর উপর আমাদের কোনোভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা যাবে না। [শায়খ মোখতার আহমাদের ভিডিও অবলম্বনে লেখাটি সম্পাদনা করেছেন তাওফিকুল ইসলাম হিমেল]
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম