ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার

‘ডিজিটাল প্রিজারভেশনে’ স্মার্ট তথ্যসেবা নিশ্চয়তার চ্যালেঞ্জ

এম রাশিদুজ্জামান
এম রাশিদুজ্জামান  © ফাইল ফটো

বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার একটি একাডেমিক গ্রন্থাগার হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে; যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সৃষ্টির মূল চেতনা সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ছাত্র-শিক্ষক ও গবেষকদের একাডেমিক প্রয়োজনীয়তা সরবরাহ করার পাশাপাশি বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের দলিল প্রমাণাদি সংরক্ষণ করে আসছে।

সাড়ে সাত লক্ষ একাডেমিক বই সংরক্ষণের পাশাপাশি পুরাতন পত্রিকা, হাতে লেখা, গাছের বাকলের উপর বা পাতার উপর বা হাতের তৈরি বিশেষ কাগজের উপর লেখা বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি, দুষ্প্রাপ্য বই ও দলিলাদি গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। এই সমস্ত বই ও অন্যান্য দলিলাদি শত বছর বা তার অধিক সময়কালের হওয়ায় একেবারেই ভঙ্গুর অবস্থায় উপনীত হয় যা প্রাচীন পদ্ধতিতে টিকিয়ে রাখা অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়ায় পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছিল না। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করার পর থেকেই ক্রমশ গ্রন্থাগারের দুষ্প্রাপ্য ডকুমেন্টসমূহকে ডিজিটাইজেশন করার এবং ডিজিটাল প্রিজার্ভ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব হতে থাকে এবং ডিজিটাল করণের উপকরণসমূহও হাতে নাগালে চলে আসে।

২০১৩ সাল থেকে গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত জীর্ণ-শীর্ণ পাণ্ডুলিপি, পুরাতন পত্রিকা ও অন্যান্য দুষ্প্রাপ্য বইসমূহ ডিজিটাইজেশন করে ডিজিটাল প্রিজারভেশন করার চিন্তা ক্রমশ ব্যাপ্তি লাভ করতে থাকে। ২০১৫ সাল থেকে প্রথমত হেক-আপ এর অধীনে একটি প্রকল্প হিসেবে পাঠ্যোপ-করণসমূহ ডিজিটাইজেশনের কাজ শুরু হলেও গ্রন্থাগার সম্পদের বিশালতা ও কাজের ব্যাপ্তি দেখে নিজস্ব লোকবলের মাধ্যমে দীর্ঘ সময়ব্যাপী ডিজিটাইজেশনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে গ্রন্থাগারের ডিজিটাইজেশন ও রিপ্রোগ্রাফি শাখায় দুটি ফ্লাটবেড স্ক্যানার, একটি ওভারহেড, একটি বুকড্রাইভ ও একটি মার্ক টু স্ক্যানারের মাধ্যমে ডকুমেন্ট স্ক্যান করে ডিজিটাইজ করা হচ্ছে এবং ম্যানুস্ক্রিপ্ট শাখায় দুটি ওভারহেড ও একটি ফ্লাটবেড স্ক্যানার ব্যবহার করা হচ্ছে। স্ক্যানকৃত ডকুমেন্টগুলোকে এরিফাইন রিডার প্রফেশনাল ভার্সনের একটি সফটওয়ার ব্যবহার করে পিডিএফ আকারে সেভ করে ডকুডেক্স সফটওয়ারে ডিজিটাল প্রিজার্ভ করা হয়।

ডিজিটাইজেশনের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো কপিরাইট আইনের অনুগত থাকা। আইন অনুযায়ী চাইলেই যেকোনো বই অথবা ডকুমেন্ট ডিজিটাইজ করে প্রকাশ করা যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সেইসব বই বা ডকুমেন্টগুলোই ডিজিটালাইজ করা হয় যেগুলোর হয়ত কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে অথবা গ্রন্থাগারে শুধু একটি কপিই আছে এবং বাজারে অন্যকোন নতুন কপি পাওয়া যাচ্ছে না, তবে বইটির আবেদন এখনও আছে অথবা যেসব বিষয়াবলী পাবলিক ডোমেইনে প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকা বা সাময়িকী পাবলিক ডোমেইন বলেই এর কন্টেন্টগুলো ডিজিটাইজ করে গ্রন্থাগারে সংরক্ষণ করা যাচ্ছে।

প্রতিদিন প্রকাশিত জাতীয় দৈনিকের মধ্যে মোট দশটি পত্রিকা ডিজিটাল প্রিজার্ভ করা হচ্ছে। পত্রিকাগুলো হলো প্রথম আলো, সমকাল, ইত্তেফাক, জনকণ্ঠ, সংবাদ, কালেরকণ্ঠ, ইনকিলাব, যুগান্তর, ডেইলি স্টার ও বাংলাদেশ অবজারভার। প্রতিষ্ঠানটি একটি একাডেমিক গ্রন্থাগার হওয়ায় গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ দৈনিক পত্রিকা সংরক্ষণের উপর এই সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছেন। পুরনো পত্রিকার মধ্যে ১৮৬৩ সালে ঢাকা থেকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা 'ঢাকা প্রকাশ' থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত অন্তত একশতটি শিরোনামের পত্রিকা ডিজিটাল প্রিজার্ভ করা হয়েছে-যা উল্লেখযোগ্য। কয়েকটি হলো: দৈনিক আজাদ, পূর্বদেশ, সংবাদ, বামাবোধিনী, মাসিক মোহাম্মদী, মাসিক ও সাপ্তাহিক সওগাত, মুসলিম ক্রনিকল, বেঙ্গল হরকরা, সত্যাগ্রহী, সাধনা, শিখা, অমৃত বাজার, দূরবীন ইত্যাদি।

১৯৭০ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দৈনিক পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে একটা বৃহৎ সংগ্রহ থাকলেও অত্যন্ত ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া এবং একদল তথ্য দুর্বৃত্তের দ্বারা পত্রিকার কাগজ হারিয়ে যাবার ভয়ে সংগ্রহশালাটির ব্যবহার সীমিতকরণ করা হয়। ডিজিটাইজেশনের সুযোগ সেই বন্ধ দরজা খুলে দিয়েছে। ডিজিটাল প্রিজারভেশনের ফলে পাঠকদের জন্য এখন উন্মুক্ত রয়েছে ইত্তেফাক, পূর্বদেশ, সংবাদ, দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ অবজারভার, ডেইলি পিপলসহ আরও বেশকিছু প্রভাবশালী দৈনিক।

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে যতগুলো এম. ফিল বা পিএইচডি ডিগ্রী এওয়ার্ড দিয়েছে, সেইসকল ডিগ্রীর থিসিসগুলো গ্রন্থাগারের রেয়ার শাখায় সংরক্ষিত ছিল। কপি সংখ্যা সীমিত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের জন্য সহজলভ্য করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাছাড়া দীর্ঘসময় অতিবাহিত হওয়ার ফলে সেগুলো সংরক্ষণ করাও বড় একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেবার লক্ষ্যে শতবর্ষের সকল থিসিস ডিজিটাইজ করা হয়েছে এবং ডি- স্পেস সফটওয়ারের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইন্সটিটিউশনাল রিপোজিটরিতে পর্যায়ক্রমে প্রিজার্ভ করা হচ্ছে যা সকলের জন্য উন্মুক্ত। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকেই এই সকল থিসিস পড়া যায়, যা শিক্ষার্থীদের জন্য অবারিত সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এছাড়াও দুষ্প্রাপ্য বইগুলো ডিজিটাল প্রিজার্ভ করা হয়েছে যা গবেষণার নতুন দুয়ার উন্মোচন করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে আরও অনেক দুষ্প্রাপ্য বই ও ডকুমেন্টসমূহ মাইক্রো ফিল্মিং করে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। মাইক্রোফিল্ম রিডার মেশিনের মাধ্যমে পাঠকদের সেবা প্রদান করা হতো। কিন্তু এই প্রযুক্তি অত্যন্ত পুরাতন হওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে পাঠকদের যথাযথ সেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছিল না কেননা, এই পদ্ধতিতে সেবা প্রদানের বেলায় সঠিক তথ্য খুঁজে পাওয়া অনেক কষ্টসাধ্য ছিল যেহেতু সার্চিং সুবিধা মাইক্রোফিল্ম মেশিনগুলোতে নেই এবং পাঠকদেরকে প্রয়োজনীয় তথ্যসমূহের কপি সরবরাহ করাও দুরূহ ছিল। ডিজিটাইজেশনের প্রযুক্তি এই সকল সমস্যার সমাধান বের করে দিয়েছে।

গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত দুই হাজার পাঁচশত মাইক্রোফিল্ম রিল এবং এক হাজার বক্স মাইক্রোফিস অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিজিটাইজ করা হয়েছে যেখানে পৃষ্ঠা সংখ্যা পনের লক্ষেরও অধিক। এছাড়াও গ্রন্থাগারে ত্রিশ হাজারেরও অধিক সংখ্যক পান্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। স্বভাবতই এই শাখা বিশেষভাবে সংরক্ষিত থাকে। বর্তমানে পাণ্ডুলিপিকে ডিজিটাইজেশনের আওতায় এনে ৫৬% বছর পুরনো 'সারদা তিলক'সহ আরবি, উর্দু, ফারসি, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার বিভিন্ন লেখক ও বিষয়ের প্রায় পনের শতাংশ পান্ডুলিপি ডিজিটাল প্রিজার্ভ করা হয়েছে।

গ্রন্থাগার একটি ক্রমবর্ধমান প্রতিষ্ঠান। প্রতিনিয়ত গ্রন্থাগারের সংগ্রহ বাড়ছে এবং ডিজিটাইজেশনের কাজও চলমান রয়েছে। সিস্টেম উন্নয়নের মাধ্যমে সমস্ত তথ্যসেবা পাঠকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়াই লক্ষ্য। প্রতিনিয়ত গবেষণার মাধ্যমে উন্নত বাংলাদেশ গড়তে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রন্থাগারই কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা রাখছি।


লেখক: সহকারী গ্রন্থাগারিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence