রাজস্ব আর উন্নয়ন ব্যয় পৃথক করলে শিক্ষার্থী-পিছু ব্যয়ে সমাঞ্জস্য আসবে

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-পিছু ব্যয়ে বিস্তর ফারাকের ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন মোশাররফ হোসেন
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-পিছু ব্যয়ে বিস্তর ফারাকের ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন মোশাররফ হোসেন  © ফাইল ছবি

সম্প্রতি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু ব্যয়ের একটা তুলনামূলক পরিসংখ্যান সকলের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এই তথ্যগুলো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সর্বশেষ বার্ষিক রিপোর্টের ভিত্তিতে মিডিয়ায় স্থান পেয়েছে। এই পরিসংখ্যানটি ২০১৮ সালের। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে শুধু বরাদ্দ দেয়া নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় ব্যয়, নিয়ম-নীতির দিকেও তারা নজর রাখে।

প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তাদের নিজস্ব কাজের বিবরণের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাজের ফিরিস্তি এবং এই কাজ-কর্ম সম্পর্কে কমিশনের মতামত ও নির্দেশনা তুলে ধরে তাদের বার্ষিক রিপোর্টে। বার্ষিক রিপোর্টটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়। এই রিপোর্টের একটি অংশে শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু ব্যয় দেখানো হয়, যা শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারী ব্যয়ের হিসাব। শিক্ষার্থীর নিজস্ব ব্যয়ের হিসাব এর অন্তর্ভুক্ত নয়। কোনভাবেই যে কোন দু'টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-পিছু ব্যয় এক হওয়ার সুযোগ নেই।

ইতোমধ্যেই এবারের রিপোর্টে উঠে আসা ব্যয়ের মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-পিছু ব্যয়ের বিশাল পার্থক্য দেশবাসী জেনেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যসহ অনেকেই এই ব্যয়-পার্থক্যকে বৈষম্য হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসসহ অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে এই ধরনের পার্থক্যের কিছুটা কারণ বিশ্লেষণ দেখা গেলেও সমাধান নির্দেশনা দেখা যায়নি। আর মাথাপিছু ব্যয় কম বলে শিক্ষার মান খারাপ এই ধারণাও ব্যক্ত করা হয়েছে। এই হিসাব দেখে যেকোনো অভিভাবক তাঁর সন্তানের জন্য শিক্ষার ব্যয় নিয়ে এই নেতিবাচক খবরে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যাবেন এবং সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খাবেন। কিন্তু প্রকৃত তথ্য জানলে এই বিভ্রান্তি থাকবে না। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার্থী-পিছু ব্যয়ের হিসাব অন্যরকম।

আমরা সবাই জানি যে প্রায় সকল বাজেটে প্রধানত দু'টি খাত থাকে। উন্নয়ন ও রাজস্ব খাত। স্বাভাবিকভাবে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কম হয় এবং উন্নয়ন ব্যয় বেশী হয়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় শুধু নয়, সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সকল ব্যয়ের লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া। এই বিবেচনায়  প্রতিষ্ঠানের সকল ব্যয় তথা পুরো বাজেট বরাদ্দকেই শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপিয়ে শিক্ষার্থী ব্যয় দেখানো হয়।

আরও পড়ুন: শিক্ষার্থীপ্রতি ঢাবি-বুয়েট থেকে বেশি ব্যয় বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ে

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় একেবারে নতুন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী উন্নয়ন ব্যয় অনেক বেশী, অপরদিকে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থী সংখ্যা কম। সেই তুলনায় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত ব্যয় নেই বললেই চলে। নিজস্ব ভবন অনেক আগেই নির্মাণ শেষ হয়েছে। শিক্ষা সরঞ্জামাদি ব্যতীত তাদের কোন উন্নয়ন ব্যয় নেই। এই দু'টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম মূলত সারা দেশজুড়ে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন ব্যয় ছাড়া অন্যান্য ব্যয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন দায় নেই। সরকার রাজস্বখাতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে কোন বরাদ্দ দেয় না (পত্রিকায় প্রকাশিত খবর)। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব অর্থে তাদের রাজস্ব ব্যয় নির্বাহ করে। পাশাপাশি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠদান, পরীক্ষা গ্রহণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন-ব্যয় বিশ্ববিদ্যালয় বহন করে। যেসব স্কুল কলেজ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউটোরিয়াল কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে, তাদের রাজস্ব উন্নয়ন কোন ব্যয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ভূমিকা নেই। এই বিশ্ববিদ্যালয় দু'টির ছাত্র সংখ্যাও অনেক বেশী। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯ লাখ ৭৫ হাজার, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ লাখ ৬৬ হাজার।

সঙ্গত কারণেই তাদের শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু ব্যয় যৎসামান্য। কারণ বর্তমান হিসাব পদ্ধতি অনুসারে শিক্ষার্থী যত বেশী হবে, শিক্ষার্থী-পিছু ব্যয় তত কম হবে। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় বলতে ধর্তব্য তেমন কিছু নেই। শিক্ষার্থীদের বেতন খুবই কম। উপরন্তু শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসাবে শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতা ছাড়াও শিক্ষার্থীদের আবাসিক সুযোগ সুবিধা ও যানবাহন ব্যয়ে ভর্তুকি দিতে হয় অনেক। এসবই রাজস্ব ব্যয়ের অংশ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ব্যয়টাই বহন করে সরকার।

অনেক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে এই বার্ষিক রিপোর্ট তৈরির সাথে সংশ্লিষ্ট কাজগুলোই এই প্রতিবেদককে করতে হয়েছিলো। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৬টি। অন্যান্য দেশের কথা বলতে পারবো না, তবে শুরু থেকেই বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক ব্যয় ধরেই মাথাপিছু শিক্ষার্থী ব্যয় হিসাব করা হতো। এখনও তাই হয়। এতে শিক্ষার্থীর প্রকৃত ব্যয় আড়ালে থেকে যায়।

প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গড়পড়তা শিক্ষাব্যয় বেশী নয়। তবে হিসাব প্রক্রিয়ার এই পদ্ধতি বহাল রেখে বৈষম্য নিরোধের চেষ্টা হলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ব্যহত হবে, এটা নিশ্চিত। যদি রাজস্ব ব্যয়ের সাথে উন্নয়ন ব্যয় একীভূত না করা হয়, শুধুমাত্র রাজস্ব ব্যয় ধরে মাথাপিছু ব্যয় নির্ধারণের ব্যবস্থা হয়, তাহলে শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় একইরকম হবে। পার্থক্য হলেও তা হবে খুবই সামান্য। তখন আর এই বৈষম্য এতটা দৃশ্যমান হবে না। উপরন্তু যেসব ক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা যাবে, তার কারণ নির্ণয় করা ও সমাধান নির্দেশ করা সহজ হবে। তখন শিক্ষার্থী ব্যয় কম বলে শিক্ষার মান খারাপ, এই ধারণাও পাল্টে যাবে।

লেখক: গ্রন্থাগারিক  (অবসরপ্রাপ্ত)


সর্বশেষ সংবাদ