বেতন ছাড়াই ক্লাস নিচ্ছেন ২৪ হাজার শিক্ষক

‘আমি এমন শিক্ষক, ঈদে বাড়ি ফিরতে গাড়ি ভাড়াও বাবার কাছে চাইতে হবে’

ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক
ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক  © ফাইল ফটো

‘আর কিছুদিন পরই ঈদ। ঈদের বাড়ি যাবো। কিন্তু ৪ মাস চাকরি করে পরিবারের জন্য কি নিয়ে যাবো? সব চাকরিজীবীরা ঈদের বেতন-বোনাস পেয়ে পরিবারের জন্য ঈদের কেনাকাটা করবে। আর আমাকে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হবে। এমনকি বাড়ি যাবার সময় গাড়ি ভাড়াও নিতে হবে বাবার কাছ থেকে। এই যন্ত্রণা কতটা তীব্র কেবলমাত্র ভুক্তভোগীরাই অনুধাবন করতে পারে।’

কথাগুলো বলছিলেন তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে সুপারিশ পেয়ে যোগদান করা পিরোজপুরের মুক্তার আলী। কথা বলার সময় তার চোখগুলো ছলছল করছিল। যা ফোনের অপরপ্রাপ্ত থেকেও অনুভব করা যাচ্ছিল।

শুধু মুক্তার আলীই নন; গত কয়েকদিনে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের অফিসে এমন অসংখ্য ভুক্তভোগী শিক্ষক ফোন করেছেন। জানতে চেয়েছেন ঈদের আগে তাদের বেতন হবে কিনা। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এবং মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো পক্ষই আশার আলো দেখাতে পারেনি। ফলে প্রায় ২৪ হাজার শিক্ষক আসন্ন ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবেন। যদিও ঈদ সবার জন্য আনন্দের বার্তা বয়ে আনে; তবে এই শিক্ষকদের জন্য যেন তা অভিশাপে পরিণত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংকট দূর করতে তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৩৪ হাজারের বেশি শিক্ষককে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এদের মধ্যে ৩০ হাজার ৯০৪ জন প্রার্থীকে এমপিও পদে সুপারিশ করে এনটিআরসিএ। যোগদানকৃতদের মধ্যে গত জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ৬ হাজার ৭০০ জন শিক্ষকক এমপিও পেয়েছেন। মাদ্রাসা ও কারিগরিতে কতজন এমপিও পেয়েছেন সেই তথ্য সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর জানাতে পারেনি। এমপিও পদে সুপারিশপ্রাপ্তদের সিংহভাগই এমপিওভুক্ত হতে পারেননি। ফলে গত ৪ মাস ধরে বেতন ছাড়াই পাঠদান দিয়ে যাচ্ছেন তারা।

আরও পড়ুন: শিক্ষামন্ত্রীর সাথে এনটিআরসিএ’র সভা আজ, আলোচায় থাকছে যেসব বিষয়

শিক্ষকদের এমপিও না হওয়ার বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেশ কয়েকটি কারণ সামনে এসেছে। এগুলোর মধ্যে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নন এমপিও পদকে এমপিও দেখানো, প্যাটার্ণ অতিরিক্ত চাহিদা দেয়া, বয়স পয়ত্রিশ অতিক্রম করা অন্যতম। যদিও পয়ত্রিশোর্ধ শিক্ষকের এমপিওভুক্তির বিষয়ে উচ্চ আদালত থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। তবে এমপিও নীতিমালার দোহাই দিয়ে আদালতের নির্দেশনা মানছে না অধিদপ্তরগুলো।

শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির বিষয়ে সম্প্রতি সচিবালয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, গত বছর সভা করে এর আগ পর্যন্ত এনটিআরসিএ’র সব সমস্যা সমাধান করা হয়েছিল। এখন আবার নতুন করে কিছু বিষয় সামনে এসেছে। আমরা সেগুলো দেখছি। আমাদের এমপিও নীতিমালায় বয়সের যে কাঠামো দেওয়া আছে, সেটার সঙ্গে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী যারা চাকরি পেয়েছেন, তা মিলছে না। তবে যেহেতু আদালতের নির্দেশনা আছে, আমরা সেই নির্দেশনার মধ্যে তাদের নিয়ে আসব।

তিনি আরও বলেন, আমরা বিষয়গুলোর সমাধান করব। নীতিমালাসহ সরকারের যে রিকোয়ারমেন্ট আছে, সেগুলো তো পূরণ করতেই হবে। অনেকের আবার কাগজপত্রেও সমস্যা থাকে। কাজেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে তো এমপিও দেওয়া সম্ভব না।

এদিকে নতুন যোগদানকৃত শিক্ষকরা বলছেন, অধিদপ্তরের চাহিদা মোতাবেক কাগজ জোগাড় করে এমপিও আবেদন করতে হয়। আর তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে বারবার সেই আবেদন রিজেক্ট করা হয়। অথচ এমন অনেকেই আছেন যাদের কাগজপত্র ঠিক না থাকলেও তাদের এমপিও হয়েছে। যোগদানের দিন থেকে বেতন দেওয়ার কথা বলা হলেও গত চার মাস ধরে বেতন ছাড়াই চাকরি করছেন তারা। এই অবস্থায় ঈদের আগে বেতন না হলে তারা কি করবেন সেটি ভেবে পাচ্ছেন না।

আরও পড়ুন: এমিপও‘র দাবিতে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব শিক্ষকদের মানববন্ধন

আব্দুল্লাহ নয়ন নামে সুপারিশপ্রাপ্ত এক শিক্ষক জানান, কার কাছে বলবো আমাদের কষ্টের কথা? কে শুনবে আমাদের আর্তনাদ? যোগদানের আগে এনটিআরসিএ আমাদের সমস্ত কাগজ নিয়েছে ৫ সেট। পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় আরেক দফায় কাগজ নিলো। যাচাই বাছাই শেষে যোগদানের অনুমতি হলো। কথা ছিলো যোগদানের সাথে সাথেই শুধু যোগদানপত্র ও ব্যাংক একাউন্ট নম্বর দিয়েই বেতন নিশ্চিত করা। কিন্তু তা না একের পর এক হয়রানি হয়েই চলেছি।

তিনি আরও বলেন, বাবা-মা, বউ-সন্তান সবাই চেয়ে আছে তাদের জন্য ঈদের কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরব। অথচ গত চার মাস ধরে বেতন নেই। ঈদে বাড়ি যাবো কীভাবে সেটিও ভেবে পাচ্ছি না। ‘আমি এমনি এক শিক্ষক ঈদে বাড়ি ফিরতে গাড়ি ভাড়াও বাবার কাছে চাইতে হবে’। এ লজ্জা কোথায় রাখবো?

হালিমা খাতুন রত্মা নামে আরেক শিক্ষক জানান, জমি লিখে নেবার মত করে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে অঙ্গীকার নামা দিয়েছি। তাহলে এত কাগজ লাগবে কেন? ঐ অঙ্গীকার নামায় পরিষ্কার করে লেখা আছে কোন দুর্নীতি হলে দেশের আইন মোতাবেক আমরা শাস্তি পাব এবং সরকারের অর্থও ফেরত দেবো। সেখানে প্রার্থী, প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সভাপতি সই করেছে। তবে কেন এই কাগজ সেই কাগজের জন্য আমাদের ফাইল রিজেক্ট হবে? এক অঙ্গীকার নামাই তো সমস্ত কাগজের দায়ভার গ্রহণ করে। এই হয়রানি আর ভালো লাগে না। আমরা সমস্ত হয়রানি থেকে মুক্তি চাই। যোগদান থেকে বেতন চাই! যোগদান হতে বেতন আমাদের ন্যায্য অধিকার। এক অভাগা শিক্ষকের ওয়াল থেকে।

এদিকে এমপিওভুক্তিসহ বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) বিদ্যমান কয়েকটি সমস্যা নিয়ে নিয়ে আলোচনা করতে বৈঠক ডেকেছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। রোববার (১৭ এপ্রিল) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এই সভা অনুষ্ঠিত হবে।

আরও পড়ুন: যোগদানের দিন থেকেই বেতন কার্যকর চান শিক্ষকরা

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এনটিআরসিএ কর্তৃক এমপিও পদে সুপারিশপ্রাপ্ত ৩০ হাজারের অধিক শিক্ষকের বড় একটি অংশ এমপিওভুক্ত হতে পারেননি। এদের মধ্যে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের ভুল চাহিদা দেওয়া, প্রার্থীদের বয়স ৩৫ বছর অতিক্রম করা অন্যতম। আপিল বিভাগ পয়ত্রিশোর্ধ শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির নির্দেশ দিলেও এমপিও নীতিমালার অজুহাতে সেগুলো রিজেক্ট করা হচ্ছে। এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী যোগদানের দিন থেকে বেতন কার্যকরের কথা বলা হলেও সেটিও বাস্তবায়ন হয়নি। আজকের সভায় এসব বিষয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তুলে ধরা হবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনটিআরসিএ সচিব মো. ওবায়দুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এনটিআরসিএর বিদ্যমান বেশ কিছু বিষয়ে আলোচনা করতে আজকের এই সভা অনুষ্ঠিত হবে। এখানে সমসাময়িক যে বিষয়গুলো আছে সেগুলো আমরা মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে উপস্থাপন করব।

কোন কোন বিষয় আলোচনায় প্রধান্য পাবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, আমাদের আলোচনায় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির বিষয়টি আসতে পারে। যদিও এটি আমাদের বিষয় না। তবুও এটা নিয়ে আলোচনা করা হবে। এছাড়া বিশেষ গণবিজ্ঞপ্তির বিষয়টিও আলোচনা হবে।


সর্বশেষ সংবাদ