কালো, চিকন-হ্যাংলা হওয়ায় কেউ আপনাকে নেশাগ্রস্ত বলেনি?

দিবস
আমিনুল ইসলাম

গায়ের রঙ কালো নিয়ে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে হিরো আলমের ঘটনার পর। আচ্ছা, এমন কেউ কি আছেন, যার গায়ের রঙ কালো; কিন্তু শুনেননি- ‘তুই তো কালো, তোর বিয়ে হতে সমস্যা হবে’; ‘রঙ কালো হলেও দেখতে কিউট’ কিংবা এই টাইপ কথাবার্তা? 

অন্তত আমি শুনেছি। ছোট থেকে বড় হতে হতে কতো বার যে আমি এই কথা শুনেছি; আমার ঠিক জানা নেই! এ থেকেই বুঝা যায়, কোন মেয়ে যদি কালো হয় তাহলে তাকে না-জানি কি পরিমাণে এই কথা গুলো শুনতে হয়।

আপনারা কি চলতি পথে এমন কথা শুনেন'নি- "আমি কালো, তাই বউটা অবশ্যই ফর্সা হতে হবে!" কিংবা মেয়ে হলে- " জামাইটা অবশ্যই ফর্সা হতে হবে!" নইলে পরবর্তী প্রজন্ম কালো'ই থেকে যাবে! 

আমরা কেউ কি কখনো প্রশ্ন করেছি- এর মানেটা আসলে কি? এর মানে হচ্ছে আমরা নিজেরাই মনে করি - কালো মানে দেখতে খারাপ। তাই কোন ভাবেই কালো হওয়া যাবে না! আমি যখন স্কুল-কলেজে পড়তাম; তখন আমার মনে হতো স্যার'রা উঁচা-লম্বা আর স্বাস্থ্য ভালো কিংবা দেখতে সুন্দর ছেলে-মেয়েদের আলাদা মূল্য দিত। আমি জানি না, এটি কি স্রেফ আমার ধারণাই কিনা। তবে স্কুলে থাকতে আমার সব সময় এমনই মনে হতো। আমি ভুলও হতে পারি। আপনারা বরং আপনাদের ধারণাও জানাতে পারেন।

সেবার গ্রীষ্মের সময় ইউনিভার্সিটিতে ছাতা মাথায় হেঁটে যাচ্ছি; আমার এক ক্লাসমেট হেঁসে হেঁসে আমাকে প্রশ্ন করেছিল- "কিরে তুই তো এমনিতেই কালো। ছাতা মাথায় দিয়ে আর লাভ কি!" অথচ অ্যালার্জির কারণে আমি ছাতা মাথায় দিয়ে ছিলাম। কলেজে থাকতে আমাদের এক ক্লাসমেটের গলার আওয়াজ অন্য সবার চাইতে একটু অন্য রকম ছিল। ক্লাসের স্যার একদিন ক্লাস রুমে সবার সামনে ওকে বলেছিল- "তোর গলার আওয়াজ এমনিতেই কর্কশ।

তোর কথা বলার দরকার নেই।" গলার আওয়াজ কি ও নিজে নিজে এমন করেছে? অথচ স্যার দিব্যি সবার সামনে এই কথা বলে বসেছিলেন। ক্লাসের বাদ বাকী সবাই আমরা সেদিন এই নিয়ে খুব হেসেছিলাম। ছেলেটাকে অনেক আজে-বাজে কথাও বলেছিলাম। আজ এত বছর পর এসে মনে হয়- কতটা অসভ্য আচরণ ছিল এটা। কিন্তু আমরা তো এইসবই শিখেছি।

আমরা ছোট বেলা থেকেই এইসব দেখতে দেখতে বড় হই। যার কারণে আমাদের মানসিকতাও এভাবে গড়ে উঠে। আপনার হাজারটা গুণ থাকার পরও যদি আপনার গায়ের রঙ কালো হয়, আপনি যদি একটু রোগা-পাতলা হন; কোন কারণে যদি আপনার গলার আওয়াজ অন্যান্যদের চাইতে একটু অন্য রকম হয়; মানুষজন ঠিকই আপনাকে এই জন্য কথা শুনাবে। তখন আপনি নিজেই নিজেকে অসুন্দর ভাবতে শুরু করবেন। এবং মনে মনে চাইবেন- আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যেন এইসবের ভেতর দিয়ে যেতে না হয়।

আমাদের পরিবার এবং স্কুল গুলো কখনোই আমাদের শেখায় না- একজন মানুষের সৌন্দর্য নির্ভর করে তার কথাবার্তা, চাল-চলন এবং মন-মানসিকতার উপর। পরিবারের বড়রা কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলে ফিরে এসে আলোচনা করে- অমুকে কতো টাকা দামের ড্রেস পরেছে। কাকে কতো ফর্সা আর সুন্দর দেখাচ্ছিল। কে গাড়ি নিয়ে এসেছে ইত্যাদি বিষয়ে। আপনারা কি এইসব শুনে বড় হননি? আমি অন্তত হয়েছি।

এমন না আমি দেখতে শুনতে খুব একটা বাজে ছিলাম। সেই আমাকেও বড় হতে হতে নানান সব বাজে অভিজ্ঞতার মাঝে দিয়ে যেতে হয়েছে। এতে করে একটা সময় আমরা আমাদের নিজেদের প্রতি আত্মবিশ্বাসই হারিয়ে ফেলি। বিয়ে হয়ে যাবার পর, এমনকি বুড়ো হয়ে যাবার পরও শান্তি নেই।

আমার এক বান্ধবী সেদিন আমাকে বলছিল- "বিয়ে হয়েছে সেই কবে। প্রায় বুড়ো হতে চললাম। অথচ সেই দিন এক ভাবি আমাকে বলছিল-  আপনি তো একটু কালো, এই জন্য মনে হয় আপনার ছেলে-মেয়ে গুলো কালো হয়েছে।" আমার এই বান্ধবী'ই আমাকে বলেছে- তুই তো কতো কিছু নিয়ে লিখিস। এই বিষয়টা নিয়ে পারলে একটা সময় লিখিস।

আপনি বিরাট বড় কর্মকর্তা কিংবা বিশাল কিছু হয়ে যাবার পরও এইসব অভিজ্ঞতা আপনাকে ছাড়বে না। আপনি যদি দেখতে কালো কিংবা দেখতে শুনতে ভালো না হন; পুরো জীবনভর আপনাকে এইসব শুনে বেড়াতে হবে।

আমরা কখনো একটা মানুষকে; মানুষ হিসেবে বিচার করি না। এই সংস্কৃতি আমরা আদৌ গড়ে তুলতে পারিনি। আমরা একটা মানুষকে বিচার করি- কোন স্কুলে পড়ে, কোন কলেজে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কার রেজাল্ট কেমন। কে কতো ভালো চাকরি করে। কে দেখতে কেমন। কারো কতো টাকা। আরও কতো কি!

আরও পড়ুন : ভাবখানা এমন— বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে বিবস্ত্র; এ আর এমন কি!

আমি আমার পরিবারে জীবনে কখনো কোন বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ফেরত আসার পর কাউকে বলতে শুনিনি; কেউ বলেছে- অমুক ছেলেটা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে। তমুক মেয়েটার আচরণ খুব অমায়িক ছিল। কিংবা এই ধরণের কিছু। আমি শুনেছি- অমুক বিশাল দামী ড্রেস পরে এসেছে। তমুক দামী গহনা পরে এসেছে।

মেয়েটাকে অনেক ফর্সা আর সুন্দর লাগছিল। ছেলেটা দামী গাড়ি করে এসেছে ইত্যাদি। আপনি একবার নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন তো- আপনার পরিবারের সদস্যরা যখন কোন বিয়ের নিমন্ত্রণ থেকে বাসায় ফেরত আসে; তারা কি নিয়ে কথা বলে?

সেই আমরাই আবার চাই কেউ আমাদেরকে কালো না বলুক। এইসব বলে আমাদের ছোট না করুক।  হিরো আলমকে যেই পুলিশ অফিসার বলেছে- "তুই কি হিরো নাকি? আয়নায় তোর চেহারা দেখিস না?" সেই পুলিশ অফিসার তো আর আকাশ থেকে উড়ে আসেনি। সে এই সমাজেরই অংশ। তাই তার মনে হয়েছে একজন কালো, অসুন্দর মানুষকে দিব্যি এইসব বলে ফেলা যায়। এমনকি চাইলেই তুই তোকারিও করা যায়!

এখন আপনি হিরো আলমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন; আমার ধারণা সেও বলবে- আমি চাই না আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেখতে কালো হোক। ব্রিটিশরা হয়ত অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। কিন্তু আমরা যে সব কবি-সাহিত্যিকদের গল্প-কবিতা এই যুগে এসেও পড়ি; তাদের বেশীরভাগ সবাই কিন্তু ব্রিটিশ আমলের। তারা তাদের সাহিত্য কর্মে- "চুল তার কবে কার" কিংবা "দুধে-আলতা গায়ের রঙ" লিখে গিয়েছেন। আমরাও ধরে নিয়েছি এটাই সৌন্দর্য।

ফিরিঙ্গি'রা অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। কিন্তু ঔপনিবেশিক মন-মানসিকতা কি এত সহজে যায়! তাই আপনার গায়ের রঙ যদি দুধে-আলতায় না হয়; আপনার চুল যদি ঘন-কালো না হয়; আপনি এখনও এই যুগে এসেও অসুন্দর।

দেখুন আপনি ফর্সা হলেও আপনার দাঁত উঁচু হতে পারে। তখন এরাই বলবে- তোমার দাঁত উঁচু। আবার আপনার ফর্সা, ঘন-কালো চুল; কিন্তু আপনি বেশ খাটো কিংবা মোটা! তখন এরাই বলবে- আপনি মোটা- খাটো! আমরা কবে বুঝতে শিখবো- কোথাও না কোথাও আমাদের অবশ্যই কমতি আছে।

একজন মানুষ কখনোই কোন কিছুতে পারফেক্ট হতে পারে না। তাই এইসব নিয়ে কখনো কাউকে কিছু বলা অসভ্যতা। আপনি আজ কাউকে কালো বলছেন। কাল অন্য কেউ আপনাকে খাটো বলবে। দাঁত উঁচু বলবে কিংবা অন্য যে কোন কিছু নিয়ে বলবে।

কেন! কালো, চিকন-হ্যাংলা পাতলা হলে কেউ কি আপনাদের নেশাগ্রস্ত বলেনি? আমরা কবে বুঝতে শিখবো- হ্যাংলা-পাতলা ওই মানুষটা না; পুরো সমাজটাই আসলে নেশাগ্রস্ত!

লেখক: ড. আমিনুল ইসলাম
সিনিয়র লেকচারার ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড ইনোভেশন বিভাগ, এস্তনিয়ান এন্টারপ্রেনারশিপ ইউনিভার্সিটি।