‘বাবার সঙ্গে মাকে নিয়েও প্রশ্ন করুন’

নুহাশ হূমায়ুন

সবাইকে ধন্যবাদ, আপানদের সহানুভূতি, সুচিন্তিত মতামত এবং ভালবাসা নিয়ে আমার পাশে থাকার জন্য। আমার সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতা জানানোর পর, অনেকেই আমাকে তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। দেখলাম, আমি-ই প্রথম এমন মানুষ না যে মিডিয়ার সামনে অপ্রস্তুত হয়েছি আর অপমানিত বোধ করেছি। এর মধ্যে ভালো লাগছে যে আমি আমার অনভুতির কথা সরাসরি লিখেছি, অনেকে হয়তো তাঁদেরটা বলতে পারেননি।

আবার খেয়াল করলাম, অনেক পেইজ, সঞ্চালকের ছবি দিয়ে অনাকাঙ্খিত মন্তব্য করছেন। আমি কোনভাবেই এ ধরনের সাইবার বুলিং সমর্থন করি না। আমি মনে করি, কিছু প্রশ্ন আপত্তিকর ছিল, কিন্তু হয়তো এখন মিডিয়াতে এইটাই একটা প্রবণতা হয়ে গিয়েছে। এর সমাধান করতে চাইলে ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে এমন ভাবে প্রস্তুত করতে হবে যেন তারা শ্রদ্ধাশীল থাকেন। কিন্তু কোনভাবেই একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যবহারের উত্তর সেরকম ব্যবহার হওয়া উচিত না। শেষ ‘ষ’ এর পর্বে একটা লাইন ছিল “দোষের চেয়ে বিচার বেশি” সেই অবস্থা যেন না হয়।

আমি চাই, ইন্টারভিউ এর আগে কি নিয়ে আলোচনা হবে, সেটার স্বচ্ছতা থাকুক। প্রথম আলো ক্যাফে লাইভের ইন্টারভিউ এর আগে আমাকে বলা হয়েছে এটা মূলত ‘ষ’ নিয়ে আলোচনা। হয়তো কিছু কথা হবে বাবা কে নিয়ে। আমি সেটার জন্যই প্রস্তুত ছিলাম।

অতীতে, আমার পরিবার নিয়ে আন্তরিক ভাবেই ব্যাক্তিগত বিষয় নিয়ে ইন্টারভিউ দিয়েছি। সেখানে আমার জীবনে আমার মায়ের ভূমিকার কথা বলেছি, আমার বাবাকে নিয়ে কথা বলেছি। কিন্তু এই ধরনের ইন্টারভিউ এর জন্য আমার মানসিক প্রস্তুতি লাগে। আমি হঠাৎ করে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হলে অপ্রস্তুত হয়ে যাই।

আরও পড়ুন: জাবিতে বেড়েছে আবেদন ফি

এটা মনে করিয়ে দিতে পারি, আমি ১৯ বছর বয়সে আমার বাবাকে হারিয়েছি। আমি আমার বাবাকে ঠিক ভাবে বিদায় জানাতে পারিনি, কারণ চারিদিকে ছিল ক্যামেরা আর সাংবাদিক। একটা মুহূর্ত একা তার পাশে বসতে পারিনি তাঁকে শুইয়ে দেয়ার আগে! তাই হঠাৎ যদি লাইভ অনুষ্ঠানে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, বাবা আমার জীবনে না থাকলে সেটা কেমন হতো - আমি অপ্রস্তুত হয়ে যাই। আমার জন্য এই বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর। এছাড়াও আমার মনে হয়, আমার জীবনে বাবার ভূমিকা নিয়ে কথা বলার জন্য - বাবা জীবনে না থাকলে কি হতো/কেমন হতো এই প্রশ্নগুলি খুব একটা শ্রদ্ধাশীল নয়।

আমার খুব ভালো লেগেছে, আমি কয়েকদিন আগে রাহাত রহমানের সাথে একটা পডকাস্ট করেছি। সেখানে তিনি জানতে ছেয়েছেন, কিভাবে দেশের বাইরে বিভিন্ন অনুদানের জন্য আবেদন করা যায়। যেহেতু আমি সানডেনস চলচিত্র উৎসবে, ফিল্ম ইন্ডিপেন্ডেন্ট এবং স্লোয়ান সামিটে অংশগ্রহণ করেছি। আরেকটা সাক্ষাৎকারে কথা বলেছি আমার বাবার লেখা উপন্যাসের মধ্যে কোনটা আমার সবচেয়ে প্রিয় - তা নিয়ে। এবং এটাকে ভিজুয়াল মিডিয়ায় রূপ দেয়ার জন্য কে হতে পারেন সবচেয়ে যোগ্য সহযোগী। এই সব সাক্ষাতকার নিয়েছেন তরুণ সঞ্চালকরা। আর সাক্ষাতকার দেয়ার সময়ই বোঝা গিয়েছে তাঁরা আমার কাজ নিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছেন। বড় বড় প্রতিষ্ঠান থেকেও আমি সেটাই আশা করি।

আমি যেসব কাজ করেছি, যতটুকু করেছি এবং যেখান থেকে আমি এসেছি - সব কিছু নিয়ে আমি খুব বিনয়ের সাথেই গর্বিত। আমার নিজের অর্জন বা সাফল্য নিয়ে কথা বললে দেখি অনেকেই খুব বিরক্ত হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ অজানা একজন মানুষের সাফল্যে কেন তাদেরকে এত বিরক্ত করে সেটাও বুঝিনা! আমার মনে হয়, আমাদের শেখানো হয়, আমাদের অর্জনের কথা শুধুমাত্র সিভিতে লেখা যাবে, মুখে বলা যাবে না। মুখে বলার মানে হল, ‘সে খুব অহংকারী’, ‘বড় বড় কথা বলে’ অথবা ‘নিজেকে কি মনে করে’। এই ধারনাগুলি পালটানো দরকার। নিজেদের অর্জনের কথা মাথা উঁচু করেই বলা উচিত।

আমি আমার পরিবার নিয়ে প্রচণ্ড ভাবে গর্বিত। আমি আমার বাবাকে ভালবাসি আর কখনোই আমার জীবনে তাঁর প্রভাবকে অস্বীকার করিনা। ‘আলোর মশাল’ লেখাটায় আমি লিখেছিলাম, কিভাবে আমার বাবা আমার জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দিয়েছেন আর কেমন করে ছোটবেলার আমি তাঁর মতন হবার চেষ্টা করতাম। কিভাবে আর কেনই বা আমি আমার বাবা বা মার প্রভাবকে অস্বীকার করবো!

যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি, আমার একটা লেখা পড়ে, আমার মার মনে হয়েছিল এই স্কুল আমার সৃজনশীলতাকে ঠিক মতন মূল্যায়ন করছে না - তিনি আমার স্কুল বদলে দিয়েছিলেন। মা আমার ১৩ বছর বয়সে একটা ডিজিটাল ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন। সেটা দিয়ে আমি আমার প্রথম শর্ট ফিল্ম বানানো শুরু করি।

আমি যা কিছু তৈরি করি, সব কিছুতে আমি আমার মার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার তো বাবাকে কৃতজ্ঞতা জানানো লাগে না, আমার নামের সাথেইতো আছেন সব সময়। কিন্তু আমার মার নাম আছে আমার সমস্ত নির্মাণে, সব কিছুতেই। মাকে ছাড়া আমি কখনোই আজকের জায়গায় আসতে পারতাম না।

আমার দেখা শ্রেষ্ঠ সিনেমাগুলো আমি দেখেছি আমার বাবার সাথে। বাবা আমার চলচিত্রের প্রতি ভালবাসা তৈরি করে দিয়েছেন। আমার মা, সেই ভালবাসার ছবি তৈরির পাশে আছেন।

আমি বলতে দ্বিধা করবো না, আমার বাবার অর্জনের পিছনেও আমার মার ভূমিকা অপরিসীম। আমার মনে হয়, হুমায়ূন আহমেদ বা নুহাশ হুমায়ূন কেউই সামনে এগিয়ে যেতে পারতো না , গুলতেকিন খানকে ছাড়া।

তাই আমার অনুরোধ থাকবে, কেউ আমার জীবনে আমার বাবার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করার সাথে সাথে মার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন করুন। আর যদি বাক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলতে চান, অনুগ্রহ করে আগে থেকেই জানিয়ে রেখেন। আমি প্রস্তুত থাকবো। ধন্যবাদ।