বেড়েছে শিক্ষা সামগ্রীর দাম, ব্যয় সমন্বয়ে অভিভাবকদের কাটছাট

শিক্ষা উপকরণ
শিক্ষা উপকরণ © সংগৃহীত

দেশের বাজারে ২০০৩ সালে কাগজের দিস্তার দাম শুরু হতো ৬ টাকায়। বর্তমানে সবচেয়ে নিম্নমানের কাগজের দিস্তাও ২০-২৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আরেকটু ভালো মানের কাগজের দিস্তাপ্রতি দাম ছুঁয়েছে ৩০-৪০ টাকা পর্যন্ত। এ সময়ের ব্যবধানে কলম-পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স ও স্কুল ব্যাগের মতো অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের দামও বেড়েছে দুই-চার গুণ। যদিও সেই হিসেবে মানুষের জীবন যাত্রার মান বাড়েনি খুব বেশি। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের উপবৃত্তির অর্থের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় না করায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবারগুলো।

স্টেশনারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে পড়াশোনাসংক্রান্ত প্রায় সব উপকরণের দামই উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ৩০০ পৃষ্ঠার একটি খাতার দাম এখন অন্তত ১৩০ টাকা, যা মান–ভেদে ১৭০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। অথচ মাত্র চার–পাঁচ বছর আগেও এই খাতা পাওয়া যেত ৯০ টাকায়। একইভাবে ২০০ পৃষ্ঠার খাতার দাম ৭০–৮০ টাকা থেকে বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ১১৪ টাকায়। ১২০ পৃষ্ঠার খাতা আগে ৪০ টাকায় মিললেও এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৭২ টাকায়।

খাতার পাশাপাশি বেড়েছে কলম, পেন্সিল ও অন্যান্য শিক্ষাসামগ্রীর দামও। আগে যে বলপয়েন্ট কলমটি ৫ টাকায় পাওয়া যেত, এখন সেটির দাম ১০ টাকা। পরীক্ষার বোর্ড, রাবার, শার্পনারসহ অন্যান্য সরঞ্জামের দামও একই হারে বাড়তি। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, ২০২০–২১ সালেও প্রতি দিস্তা কাগজের দাম ছিল ১৬ টাকা, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৩৫ টাকা। কাগজের এ অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রভাব সরাসরি পড়েছে বই, খাতা ও ব্যবহারিক খাতার দামে। তাদের ভাষায়, গত পাঁচ বছরে শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়েছে গড়ে প্রায় শতভাগ।

আরও পড়ুন: পোস্টার ছাড়াই নির্বাচন করছেন তাসনিম জারা, জানালেন কারণ

রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকার স্টেশনারি ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ভাই, এখন খাতা-কলমের বাজারটা একেবারে হাতের বাইরে চলে গেছে। আগে যে খাতার রিম ৯৫০–১,০০০ টাকায় আনতাম, এখন সেটা ১,৭০০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। কলমের অবস্থাও একই—১০ টাকার কলম এখন ১৮–২০ টাকা। গ্রাহকরা আসে, দাম শুনে অনেকেই ফিরে যায়। আমরাও লজ্জায় পড়ি। এভাবে চললে পড়াশোনা সামগ্রী সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে।’

রাজধানীর নিউ মার্কেটের স্টেশনারি দোকানি মিজানুর রহমান ক্ষোভ ঝরে বলা কণ্ঠে বলেন, ‘আগে পড়াশোনার জিনিসপত্রের দোকানে বাচ্চাদের হাসি-আনন্দ দেখতাম, এখন দেখি অভিভাবকদের চিন্তা। একটা সাধারণ খাতাই ৫০–৬০ টাকায় যেত, এখন সেটা ১০০ টাকা ছুঁই ছুঁই। যে কলম ১২ টাকায় দিতাম, সেটার দামই এখন ২০ টাকা। বাচ্চাদের জন্য জিনিস কিনতে এসে অনেক মা-বাবা দাম শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আমরাও কী করব—নিজেদের হাতে দামের কিছু নেই।’

রাজধানীর নীলক্ষেত, ফার্মগেটসহ বেশ কয়েকটি এলাকার দোকানগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে, চীন থেকে আমদানি করা কলম, পেনসিল বক্স, প্লাস্টিক ফাইলসহ স্টেশনারি পণ্যের চাহিদা তুলনামূলক বেশি। তবে এ পণ্যে আমদানিকারকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকায় দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়েনি। মাঝে কলমের দাম বাড়লেও পরে তা আবার আগের অবস্থানে ফিরে এসেছে। পেনসিলের দাম অবশ্য কিছুটা বেশি রয়েছে।

শিক্ষা উপকরণের পাশাপাশি বাড়ছে স্কুলের বেতন (টিউশন ফি), প্রাইভেট পড়ার ব্যয়সহ নানা খাতে ব্যয়। অভিভাবকেরা বলছেন, এসব খরচ বাড়ার তুলনায় তাদের আয়ে তেমন বাড়তি যোগ হয়নি। ফলে সন্তানদের পড়ার খরচ সামলে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারকে।

রাজধানীর টিএনটি স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক আবদুল কুদ্দুস নিজের দৈনন্দিন সংগ্রামের কথা জানাতে গিয়ে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমার সন্তান ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে এবং আমি রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। আমার মাসিক বেতন ১৯ হাজার টাকা। 

তিনি জানান, সন্তানের শুধু প্রাইভেট পড়ার খরচই মাসে ৩ হাজার টাকা, খাতা–কলমসহ পড়ালেখার উপকরণে খরচ হয় আরও প্রায় ১ হাজার টাকা। বিদ্যালয়ের বেতন, পরিবহন ও অন্যান্য খরচ যোগ করলে প্রতি মাসে সন্তানের পেছনে ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ৬ হাজার টাকা।

তিনি বলেন, বাসা ভাড়া ও নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজারসহ সংসারের ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতি মাসেই তাকে প্রায় ৫–৬ হাজার টাকা ঋণ করে চলতে হয়।

বই–খাতা, স্কুলের বেতন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন নামে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের প্রবণতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধূরী। 

তিনি বলেন, ‘সরকার সৎ উদ্দেশ্যে বেতন–ভাতা বাড়ালেও বাস্তবতা হলো—একাধিক সন্তান থাকলে নিম্ন আয়ের অভিভাবকদের পক্ষে এই ব্যয় বহন করা অত্যন্ত কঠিন।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘উপবৃত্তি ও মিড–ডে মিল কার্যক্রম ভালো উদ্যোগ হলেও লাগামহীন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এসব সুবিধা বাড়ানো হয়নি।’

আরও পড়ুন: লটারিতে বালক বিদ্যালয়ে ভর্তির ‘সুযোগ’ পেল বালিকা!

জাতিসংঘের ইউনেসকোর গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট–২০২২ অনুযায়ী, বাংলাদেশে শিক্ষাব্যয়ের ৭১ শতাংশই বহন করতে হয় পরিবারকে। এনজিও বিদ্যালয়ের ফি সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি, আর কিন্ডারগার্টেনে এ ব্যয় বাড়ে নয় গুণ পর্যন্ত। সেই সঙ্গে প্রাইভেট পড়ার খরচও বছর বছর বাড়ছে—যেখানে গ্রামাঞ্চলে এ ব্যয় ২০০০ সালের ২৮ শতাংশ থেকে ২০১০ সালে বেড়ে হয়েছে ৫৪ শতাংশ, আর শহরে ৪৮ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭ শতাংশে।

শিক্ষা খাতে ক্রমবর্ধমান ব্যয় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে দেশের অধিকাংশ পরিবার, যা নতুন শিক্ষাবর্ষ সামনে রেখে আরও চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে অভিভাবকদের ওপর।

এদিকে, এমপিওভুক্ত ও নন–এমপিও স্কুল–কলেজের বেতন ছাড়া অন্যান্য সব ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি নীতিমালা–২০২৪ অনুসারে মহানগরের এমপিওভুক্ত স্কুলে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বছরে ২ হাজার ৪৬৫ টাকা পর্যন্ত ফি নেওয়া যাবে। জেলা সদর, পৌরসভা ও উপজেলা সদরের এমপিওভুক্ত স্কুলের ক্ষেত্রে এ ফি ১ হাজার ৮৫০ টাকা, আর মফস্বলের ক্ষেত্রে ১ হাজার ৪০৫ টাকা। নন–এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ব্যয় আরও বেশি।

নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো এই ব্যয় বহন করতে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে অভিভাবক মহলে। অভিযোগ রয়েছে, অনেক বেসরকারি বিদ্যালয় বিভিন্ন খাত দেখিয়ে অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছে। বিদ্যালয়গুলোর এসব অনিয়মে কোনো কার্যকর তদারকি নেই বলেও মন্তব্য করেন রাশেদা কে চৌধূরী।