জনস্বাস্থ্য সংকট তৈরি করেছে শ্বাসকষ্টের দীর্ঘস্থায়ী রোগ, ধূমপান-বায়ুদূষণ রোধের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
- ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ২০:৪৪
শ্বাসকষ্টের দীর্ঘস্থায়ী রোগ বা সিওপিডি এখন গভীর জনস্বাস্থ্য সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ধূমপান ও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয় বলেও মনে করছেন তারা। আজ মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) বিশ্ব সিওপিডি দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) আলোচনা সভায় তারা এসব মন্তব্য করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্ষব্যাধি (রেসপিরেটরি) বিভাগের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ডা. মিল্টন হলে ‘সিওপিডি: দ্য হিডেন পাবলিক হেলথ ক্রাইসিস’ শীর্ষক এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে সকালে বিএমইউ ক্যাম্পাসে একটি জনসচেতনতামূলক র্যালিও বের করে বিভাগটি। বিএমইউর কেবিন ব্লক থেকে এই র্যালি বের হয়। এসময় বেলুন ও পায়রা উড়ানো হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, সিওপিডি এখন বাংলাদেশের একটি গভীর জনস্বাস্থ্য সংকট। ধূমপান, বায়ুদূষণ, ইনডোর স্মোক এসব নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কোনো সমাধান হবে না। আমাদের চিকিৎসা শিক্ষা, গবেষণা, নীতিনির্ধারণ ও জাতীয় স্বাস্থ্যসেবায় সিওপিডিকে অগ্রাধিকারে আনতে হবে। একই সাথে সিওপিডি প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় গাইডলাইন ও নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।
আরও পড়ুন: ৫ বিভাগের মেডিকেল কলেজের দায়িত্ব থেকে রাবি-চবি-শাবি আউট, ঢাবির খবরদারিত্ব কেন রয়েই গেল?
সিওপিডি নিয়ে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, দ্রুত শনাক্তকরণ, কমিউনিটি–স্তরের স্ক্রিনিং এবং আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করাই বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আজকের এই আয়োজন আগামীতে গবেষণা, রেসিডেন্সি ট্রেনিং, পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশন কেন্দ্র এবং ডিজিজ রেজিস্ট্রি তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।
চেস্ট অ্যান্ড হার্ট অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ডা. মো. জহিরুল ইসলাম শাকিল বলেন, সিওপিডি প্রতিরোধে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। সম্মিলিতভাবে কাজ করলে সিওপিডি প্রতিরোধ করা সম্ভব। একই সাথে গবেষণা কার্যক্রমকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, সিওপিডি প্রতিরোধে ধূমপান পরিহার, বায়ুদূষণ হ্রাস করাসহ সকল ঝুঁকিসমূহ মোকাবিলায় গুরুত্ব দিয়ে সমন্বিত ও জাতীয় পর্যায়ে কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। গ্রামে রান্নার চুলা ব্যবহারের সঠিক নিয়ম মায়েদেরকে অবহিত করতে হবে। সিওপিডির রোগীরা যাতে গাইডলাইনভিত্তিক যথাযথ চিকিৎসা পায় সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় গণমানুষকে সচেতন করা জরুরি। সিওপিডি প্রতিরোধে পরিবেশ দুষণ প্রতিরোধ, ধুমপান পরিহার অপরিহার্য। উন্নয়ন ও রোগ প্রতিরোধে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।
আরও পড়ুন: ৪ তলা বাড়িয়ে হয়েছে সাত, ‘অতি ঝুঁকি’ নিয়েই মেডিকেল শিক্ষার্থীদের বাস এই ভবনে
রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ বলেন, মনে রাখতে হবে সিওপিডি প্রতিরোধযোগ্য। সিওপিডি প্রতিরোধই সবচেয়ে বড় শক্তি। একসাথে কাজ করলে আমরা এই রোগের বোঝা প্রায় অর্ধেক পর্যন্ত কমাতে পারব। আজকের সেমিনার ও আলোচনা স্পষ্ট করেছে সিপিওডি মোকাবিলার জন্য সমন্বিত গবেষণা, রোগী শিক্ষা, ধূমপান নিয়ন্ত্রণ এবং আধুনিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা জরুরি। বিএমইউ এ বিষয়ে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত। আজকের আলোচনার সুপারিশসমূহ আগামী বছরের অ্যাকশন প্ল্যানে যুক্ত করা হবে।
অন্য বক্তারা বলেন, সিওপিডির প্রকৃত বোঝা জানতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ ও স্ক্রিনিং জরুরি। সিওপিডি নিয়ে জাতীয় ডাটাবেজ ও মাল্টিসেন্টার গবেষণা আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। নারীদের ইনডোর এয়ার পলিউশন প্রতিরোধে জনসচেতনতা ও নিরাপদ রান্না পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসা শিক্ষা ও ইন্টার্ন ট্রেনিংয়ে সিওপিডিকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। তরুণ প্রজন্মের ধূমপান প্রতিরোধেই ভবিষ্যতের সিওপিডি বোঝা কমবে। সিওপিডি ব্যবস্থাপনায় গাইডলাইনভিত্তিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা এখন জরুরি। পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশন ইউনিট স্থাপনও এখন সময়ের দাবি। কমিউনিটি ক্লিনিকে স্পাইরোমেট্রি চালু হলে প্রারম্ভিক রোগ নির্ণয় বহুগুণ বাড়বে। বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর সিওপিডি ব্যবস্থাপনায় জটিলতা বাড়ছে এ বিষয় মোকাবিলায় বিশেষ পরিকল্পনা দরকার। সারা দেশে সিওপিডি ব্যবস্থাপনার মডেল তৈরি করা প্রয়োজন। নতুন ইনহেলার প্রযুক্তি ও রোগী শিক্ষা সিওপিডি নিয়ন্ত্রণে মূল হাতিয়ার এ বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। সারা দেশে সচেতনতা ক্যাম্পেইন আরও জোরদার করা দরকার। প্রাথমিক পর্যায়ে সিওপিডি শনাক্ত করতে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি গুরুত্বপূর্ণ। হাসপাতালভিত্তিক সিওপিডি কেয়ার পাথওয়ে উন্নত করলে অ্যাকিউট এক্সাসারবেশন অনেক কমবে। যুবকদের ভেপিং ও স্মোকিং নিয়ন্ত্রণ না করলে ভবিষ্যতে সিওপিডি আরও বৃদ্ধি পাবে, তাই এই বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
আরও পড়ুন: অনুমোদনের অপেক্ষায় ১২০০ কোটি টাকার মাস্টারপ্ল্যান, বদলে যাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিত্র
বক্তারা আরও বলেন, বাংলাদেশে সিওপিডি রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুত। ধূমপান, বায়ুদূষণ ও ইনডোর স্মোক প্রধান ঝুঁকি। প্রাথমিক পর্যায়ে স্পাইরোমেট্রি অপরিহার্য। গাইডলাইনভিত্তিক চিকিৎসা ও রিহ্যাবিলিটেশন জীবনমান উন্নত করবে। কমিউনিটি পর্যায়ে স্ক্রিনিং প্রয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল ও জাতীয় সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। আলোচনা শেষে বক্তারা বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি এবং চেস্ট অ্যান্ড হার্ট অ্যাসোসিয়েশন ভবিষ্যতে সিওপিডির বিরুদ্ধে আরও শক্তিশালী জাতীয় কর্মসূচি হাতে নেয়ার ঘোষণা দেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম, পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইরতেকা রহমান, ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল কাদের, অধ্যাপক ডা. কাজী মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আদনান ইউসুফ চৌধুরী, চেস্ট অ্যান্ড হার্ট অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল ডা. গোলাম সারোয়ার লিয়াকত হোসেন ভূঁইয়া, রেসপিরেটরি বিভাগের ডা. রাজশিস চক্রবর্তী প্রমুখ সভায় বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ।