প্রাথমিক সতর্কবার্তা ভূমিকম্প, লক্ষণ কেয়ামতের— কী আছে কোরআন-হাদিসে
- ২২ নভেম্বর ২০২৫, ১৯:৪০
পৃথিবীতে যত প্রাকৃতিক দুর্যোগ রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ও অপ্রতিরোধ্য বিপর্যয় হলো ভূমিকম্প। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, সুনামি বা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত— এসব দুর্যোগের কিছু না কিছু পূর্বাভাস পাওয়া গেলেও ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। পূর্বাভাসহীনভাবে সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে যাওয়া এই বিপর্যয়ে মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে শহর-জনপদ, বিলীন হয়ে যেতে পারে হাজারো প্রাণ।
ইসলাম ধর্মে ভূমিকম্পকে কেবল একটি প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে নয়, বরং মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যখন সমাজে পাপাচার, অন্যায়, নির্লজ্জতা ও অবিচার বেড়ে যায়— তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের সাবধান করতে ভয়ংকর বিপর্যয়ের মাধ্যমে সতর্ক করেন।
ভূমিকম্প— আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা!
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বারবার মানুষকে সতর্ক করে বলেছেন, আল্লাহর শাস্তি যে-কোনো সময় নেমে আসতে পারে, তাই মানুষকে সবসময় সৎপথে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সুরা যিলজাল–এর প্রথম দুটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিনের ভয়াবহ ভূমিকম্পের দৃশ্য অত্যন্ত শক্তিশালী ও বাস্তবভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন— “যখন পৃথিবী প্রবল কম্পনে কাঁপবে, আর পৃথিবী তার বোঝা বের করে ফেলবে…”
— সুরা যিলজাল: ১–২
এই আয়াতগুলোতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কেয়ামত আসার মুহূর্তে পৃথিবী এমন তীব্র ভূমিকম্পে কেঁপে উঠবে, যা মানবজাতি আগে কখনো দেখেনি। পৃথিবী তার ভেতরে থাকা সব কিছু— লাশ, ধন-সম্পদ, গুপ্তধন— সবই বের করে দেবে। ভূমণ্ডল ও পর্বত ভেঙে ধসে পড়বে, জমিন পুরোপুরি উল্টে-পাল্টে যাবে।
এই ভূমিকম্প হবে কেবল প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়— বরং এটি হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে কেয়ামতের ঘোষণা। মানুষের কর্মফল বিচার করার জন্য জমিন তার বুকের সবকিছু উন্মুক্ত করে দেবে। সেই দিনের ভয়াবহতা এতটাই প্রবল হবে যে মানুষ বিস্ময়ে, আতঙ্কে ও অসহায়ত্বে স্তব্ধ হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: এবারের ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল রাজধানীর বাড্ডা
আল্লাহ সুরা আরাফ-এ বলেন— ‘জনপদের অধিবাসীরা কি এতই নির্ভয় হয়ে গেছে যে, আমার আজাব রাতের বেলা তাদের ওপর এসে পড়বে, যখন তারা ঘুমে বিভোর থাকবে?’ — সুরা আরাফ: ৯৭
এ আয়াত স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, গাফিল ও পাপাচারী সমাজ যখন আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়, তখন তাদের ওপর আল্লাহর শাস্তি হঠাৎ নেমে আসে।
মানুষের পাপের কারণে বিপর্যয় আসে!
মানুষের অন্যায় ও অবাধ্যতার ফলেই অনেক বিপদ-আপদ এসে থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন— ‘আর তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তা তোমাদের হাত যা অর্জন করেছে তার কারণে এবং অনেক অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন।’ — সুরা শুরা: ৩০। অর্থাৎ, মানুষের পাপ ও অপরাধই অনেক সময় ভূমিকম্পসহ বড় ধরনের দুর্যোগ ডেকে আনে। তবুও আল্লাহ তাআলা ক্ষমাশীল— অনেক অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন, কিন্তু কখনো কখনো সতর্ক করার জন্য পরীক্ষায় ফেলেন।
পবিত্র কোরআনে ভূমিকম্প বোঝাতে দুটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে— ‘যিলযাল’ এবং ‘ধাক্কা’। ‘যিলযাল’ অর্থ হলো একটি বস্তুর কাঁপুনিতে আশপাশের অন্য বস্তুর নড়ে ওঠা; অর্থাৎ ধারাবাহিক কম্পন বা টানা কাঁপুনি, যা ভূমিকম্পের স্বাভাবিক কম্পনের ধারণাকে তুলে ধরে। অন্যদিকে ‘ধাক্কা’ শব্দের অর্থ হলো: প্রচণ্ড শব্দ, ধাক্কা বা আঘাতের ফলে কোনো কিছু তীব্রভাবে নড়ে ওঠা বা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়া। এটি আকস্মিক ও বিধ্বংসী ধাক্কার চিত্র তুলে ধরে, যা বড় মাত্রার ভূমিকম্প বা মহা ধ্বংসের দৃশ্যকে নির্দেশ করে। এই দুটি শব্দই কোরআনের ভাষায় ভূমিকম্পের ভয়াবহতা ও এর সতর্কবার্তামূলক বার্তাকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
হাদিসে ভূমিকম্পের উল্লেখ
হাদিসে ভূমিকম্পকে আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি, সতর্কবার্তা এবং কেয়ামতের আলামত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সতর্ক করেছেন,, “আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন গনীমাতের (যুদ্ধলব্ধ) মাল ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হবে, আমানাতের মাল লুটের মালে প্রচলন হবে, পুরুষ স্ত্রীর অনুগত হয়ে যাবে কিন্তু নিজ মায়ের অবাধ্য হবে, কলরব ও হট্টগোল করবে, পাপাচারীরা গোত্রের নেতা হবে, নিকৃষ্ট লোক সমাজের কর্ণধার হবে, কোনো মানুষের অনিষ্ট হতে বাঁচার জন্য তাকে সম্মান দেখানো হবে, গায়িকা-নর্তকী ও বাদ্যযন্ত্রের বিস্তার ঘটবে, মদপান করা হবে, এই উম্মতের শেষ জামানার লোকেরা তাদের পূর্ববর্তী মনীষীদের অভিসম্পাত করবে, তখন তোমরা অগ্নি বায়ু, ভূমিধস, ভূমিকম্প, চেহারা বিকৃতি ও পাথর বর্ষণ রূপ শাস্তির এবং আরো আলামতের অপেক্ষা করবে, যা একের পর এক নিপতিত হতে থাকবে, যেমন পুরানো পুতির মালা ছিঁড়ে গেলে একের পর এক তার পুতি ঝরে পড়তে থাকে।” এই বর্ণনা স্পষ্ট করে যে, সমাজে যখন অন্যায়, অশ্লীলতা, নৈতিক অবক্ষয়, গান-বাজনা ও মদপানের মতো পাপ কাজ বেড়ে যায়, তখন আল্লাহ মানুষের উপর সতর্কতা বা শাস্তি হিসেবে ভূমিকম্প পাঠাতে পারেন।
আরও পড়ুন: তৃতীয় ভূমিকম্পের মাত্রা ৪.৩, ধরন জানাল আবহাওয়া অধিদপ্তর
এ ছাড়া হাদিসে আরও উল্লেখ আছে যে— কেয়ামত যত নিকটবর্তী হবে, পৃথিবীতে ভূমিকম্প তত বৃদ্ধি পাবে, মানুষ বারবার ভয়াবহ কম্পনের সম্মুখীন হবে। এটি কেয়ামতের গুরুত্বপূর্ণ আলামতগুলোর একটি। হাদিসের এসব বর্ণনা প্রমাণ করে যে, ভূমিকম্প শুধু প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, বরং মানুষের আচরণ, সমাজের নৈতিক অবস্থা এবং আল্লাহর নির্দেশ অমান্যের সাথেও সম্পর্কিত একটি সতর্ক সংকেত।
আল্লাহ তাআলা বলেন— “হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, কেয়ামতের কম্পন এক ভয়ানক জিনিস।
সেদিন তুমি দেখবে প্রতিটি দুগ্ধদায়িনী ভুলে যাবে তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে, আর প্রত্যেক গর্ভবতী গর্ভপাত করে ফেলবে, আর মানুষকে দেখবে মাতাল, যদিও তারা প্রকৃতপক্ষে মাতাল নয়, কিন্তু আল্লাহর শাস্তি বড়ই কঠিন (যার কারণে তাদের ঐ অবস্থা ঘটবে)।” (সুরা হজ: ১-২)
বর্তমানে পৃথিবীতে যে-সব ভূমিকম্প হচ্ছে, তা শুধু ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন নয়— বরং মানুষের জন্য আল্লাহর সতর্কবার্তার প্রতীক। সমাজে পাপাচার ও নৈতিক অধঃপতন বাড়লে আল্লাহ বান্দাদের সতর্ক করেন, যাতে তারা তওবা করে তাঁর দিকে ফিরে আসে। তাই আমাদের উচিত প্রতিটি দুর্যোগকে শিক্ষার আলোকে দেখা, পাপ থেকে দূরে থাকা এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করা।