গাজীপুর মসজিদের খতিব ‘অপহরণ’ নিয়ে এখনো যেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে পুলিশ
- ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৫৫
গাজীপুরে মুফতি মুহিবুল্লাহ মিয়াজীর ‘অপহরণ’ ঘটনাকে ঘিরে একের পর এক নতুন তথ্য ও প্রশ্ন উঠে আসছে। পুলিশের তদন্তে ঘটনার নানা অসঙ্গতি প্রকাশ পাওয়ার পর এখন তদন্তকারীরা বলছেন এটি অপহরণ নয়, বরং একটি ‘নিজের সাজানো নাটক’। তবে, তদন্তের কিছু দিক এখনও স্পষ্ট নয়, যেগুলোর উত্তর খুঁজছে পুলিশ।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোহাম্মদ তাহেরুল হক চৌহান মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) বলেন, ‘তাকে যে জোরপূর্বক অপহরণ করা হয়নি, সেটি যেমন আমাদের তদন্তে স্পষ্ট, তেমনি কিছু প্রশ্নের উত্তর আমরা এখনও পাইনি। সেই সব প্রশ্নের উত্তরও আমরা খুঁজছি।’
এর আগে বিকেলে মুফতি মুহিবুল্লাহকে পরিবারের জিম্মায় বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়। তার ভাগ্নে আসাদ সিদ্দিকী জানান, ‘মঙ্গলবার তাকে বাসায় পাঠানোর পর এখন তিনি বিশ্রামে আছেন।’ তবে বিস্তারিত আর কিছু বলতে চাননি।
গাজীপুরের টঙ্গী টিএন্ডটি এলাকার বিটিসিএল জামে মসজিদের পেশ ইমাম ও খতিব মুফতি মুহিবুল্লাহ মিয়াজী থাকতেন সেখানকার কলোনি মসজিদের কোয়ার্টারে। গত ২২ অক্টোবর সকাল সাতটার দিকে হাঁটতে বের হওয়ার পর তিনি নিখোঁজ হন। পরদিন সকাল সাড়ে ৬টার দিকে উত্তরের জেলা পঞ্চগড় সদর ইউনিয়নের সিতারাম হেলিপ্যাড এলাকায় পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা মহাসড়কের পাশে তাকে উদ্ধার করা হয়। সেদিন রাতেই পরিবারের সদস্যরা টঙ্গী থেকে পঞ্চগড়ে গিয়ে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন।
আরও পড়ুন: জামায়াত আমিরের বক্তব্য নিয়ে মন্তব্যের অভিযোগে ওসি প্রত্যাহার
ঘটনার পরদিন শুক্রবার টঙ্গী পূর্ব থানায় বাদী হয়ে মামলা করেন মুফতি মুহিবুল্লাহ। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, ‘বুধবার সকাল সাতটার দিকে হাঁটতে বের হলে অ্যাক্সস লিংক ফিলিং স্টেশনের সামনে একটি অ্যাম্বুলেন্স তার পথরোধ করে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে চার-পাঁচজন ব্যক্তি তাকে জোরপূর্বক অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নেয়, চোখ-মুখ কালো কাপড়ে বেঁধে নির্যাতন করে এবং প্রায় একদিন গাড়ি চলার পর তাকে মারধর করে বিবস্ত্র অবস্থায় গাছের সঙ্গে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখে যায়।’
অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ তদন্তে নামে এবং নিখোঁজ হওয়ার এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে। টানা কয়েকদিনের তদন্ত শেষে মঙ্গলবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে গাজীপুর মহানগর পুলিশ জানায়, মুফতি মুহিবুল্লাহ নিজেই অপহরণের নাটক সাজিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ কমিশনার তাহেরুল হক চৌহান বলেন, ‘তদন্তে আমরা জানতে পারি, উনি সকালে হাঁটতে বের হয়ে একটানা হাঁটতে থাকেন। পরে জয়দেবপুর চৌরাস্তায় পৌঁছে কোনো এক সময়ে সিএনজি, কোনো এক সময়ে অটোরিকশা, এবং এক পর্যায়ে বাসযোগে সোবহানবাগ হয়ে গাবতলী যান।’
প্রাথমিক তথ্য পাওয়ার পর সোমবার সকালে মুফতি মুহিবুল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে আনা হয়। তাকে ফুটেজসহ নানা প্রমাণ দেখানো হলে তিনি কিছু তথ্য দেন এবং অসঙ্গতিগুলো স্বীকার করেন।
পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘তিনি দাবি করেছেন, তাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নির্যাতন করা হয়েছে। কিন্তু আমরা সিসিটিভিতে তার স্বাভাবিক চলাফেরার দৃশ্য পেয়েছি। অভিযোগের সঙ্গে তার বক্তব্যের গড়মিল রয়েছে।’
তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, গাবতলী থেকে তিনি নিজেই পঞ্চগড়গামী শ্যামলী পরিবহনের বাসের একটি টিকিট কিনেছিলেন। টিকিটের তথ্য তার মোবাইল নম্বর থেকে পাঠানো মেসেজে পাওয়া যায়। সেই সূত্র ধরে পুলিশ বাস কাউন্টার, সুপারভাইজার এবং পাশের যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে।
কমিশনার চৌহান বলেন, ‘মুহিবুল্লাহ সাহেবের মোবাইল নম্বর দিয়েই টিকিট কাটা হয়েছিল। টিকিটের তথ্য তার ফোনে পাওয়া মেসেজে ছিল, সেখান থেকেই আমরা ক্লু পাই। এরপর বাসের সুপারভাইজার ও তার পাশের যাত্রীর সঙ্গে কথা বললে তারা নিশ্চিত করেন, তিনিই ওই যাত্রী ছিলেন।’
তদন্তে আরও জানা যায়, শ্যামলী পরিবহনের ওই বাসটি সন্ধ্যায় বগুড়ার শেরপুর থানাধীন পেন্টাগন হোটেলে বিরতি নেয়। সেখানে নেমে তিনি ওজু করে নামাজ পড়েন, পরে আবার বাসে ওঠেন। পুলিশ বাসের ই-ওয়ান সিটে বসা মুফতি মুহিবুল্লাহর পাশের ই-টু সিটের যাত্রীকেও শনাক্ত করে। তিনিও নিশ্চিত করেন যে, মহিবুল্লাহ তার পাশের সিটেই যাত্রা করেছিলেন।
পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘সুপারভাইজার ও পাশের যাত্রীর বক্তব্যে আমরা কোনো অমিল পাইনি। তবে তিনি নিজেই টিকিট কেটেছিলেন, নাকি অন্য কেউ তাকে সহায়তা করেছিল—তা এখনও আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। বিষয়টি তদন্তাধীন।’
পুলিশের দাবি, মুফতি মুহিবুল্লাহ নিজেই ‘অপহরণের নাটক’ সাজালেও, এর পেছনে অন্য কারও ইন্ধন ছিল কি না, সেটিও এখন তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।