সম্মানীর নামে অসম্মান? ‘এক হাজারের গণ্ডি’ থেকে বের হতে পারছে না ঢাবি

  • অসচ্ছলতা দূরীকরণের লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না
  • ছয় মাসে মাত্র ১০০ জনকেও সুযোগ দিতে ব্যর্থ
  • সবাই বলছে দরকার, কিন্তু নেই পদক্ষেপ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো ও কার্জন হল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো ও কার্জন হল © টিডিসি সম্পাদিত

নির্দিষ্টসংখ্যক অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীর জন্য দীর্ঘদিন ধরে খণ্ডকালীন চাকরির ব্যবস্থা করে আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতর। উদ্যোগটির লক্ষ্য- শিক্ষার্থীকে নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এবং আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া। এ আর্থিক সহায়তার অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা এক মাস কাজ করে মাত্র ১ হাজার টাকা সম্মানী হিসেবে পান। যেটিকে সম্মানের নামে একপ্রকার ‘অসম্মানের নামান্তর’ বলে অভিহিত করছেন অনেকে।  

এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে অসচ্ছলতা দূর করার লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৩৭ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। যাদের মধ্যকার বড় একটা অংশের অসচ্ছলতা রয়েছে। এতৎসত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় ছয় মাসে মাত্র ১০০ শিক্ষার্থীকেও কাজের সুযোগ দিতে পারছে না। আর যারা সুযোগ পাচ্ছেন তাদের সম্মানীর পরিমাণ বার বার বাড়িয়ে সম্মানজনক পর্যায়ে নেওয়ার দাবি উঠলেও এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ।  

“বছরে দুইবার নির্দিষ্টসংখ্যক শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন চাকরি দেওয়ার উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কিন্তু তাদের নীতি অনুযায়ী মাসে ১ হাজার করে টাকা সম্মানী হিসেবে দেওয়া হয়। আমার মনে হয়, এটা সম্মানীর নামে অসম্মান” - শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

শুধু শিক্ষার্থীদের বেলায়ই এমন হচ্ছে, বিষয়টি এমন নয়। বরং শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও নামেমাত্র সম্মানী প্রদানের প্রথা চালু রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে একাধিক ছাত্র উপদেষ্টা নিয়োগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাদের সম্মানীও এই ১ হাজার টাকা করেই। আর আবাসিক হলের হাউজ টিউটরদের সম্মানী ১ হাজার ৪০০ টাকা মাত্র। প্রশ্ন উঠেছে, এসব বিষয়ে ‘এক হাজারের গণ্ডি’ থেকে কবে বের হতে পারবে ঢাবি?

“কাজের যথাযথ মূল্যায়ন না করা হলে শিক্ষকরা ভবিষ্যতে অনাগ্রহী হবেন। এটা নিয়ে শিক্ষকদের বিভিন্ন মিটিংয়ে আলাপ উঠেছে, কিন্তু বাজেট স্বল্পতার কথা বলে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি” - শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বছরে দুইবার ৭৫ জন করে মোট ১৫০ জন শিক্ষার্থীকে খণ্ডকালীন চাকুরির জন্য নিয়োগ দেয় টিএসসিস্থ ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতর। জানুয়ারি থেকে জুন এবং জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের জন্য তাদের এ নিয়োগ হয়। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো হলে ১ জন করে হল অ্যাসিস্ট্যান্ট (১৯-২০ জন), ২০ থেকে ২৫ জন কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের বিভিন্ন শাখায়, ১০-১৫ জন রেজিস্টার অফিসে (রেকর্ড শাখা) এবং টিএসসির পরামর্শদান দফতর অফিস ও কাউন্সেলিং শাখায় ৩০ থেকে ৩৫ জনকে ১ হাজার টাকা সম্মানিতে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। সে অনুযায়ী বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে বিভাগ/ইনস্টিটিউটগুলোর ছাত্র-উপদেষ্টাদের সহযোগিতায় বিভাগ থেকে মনোনীত ১ (এক) জন অসচ্ছল, মেধাবী ও নিয়মিত শিক্ষার্থী ফরম পূরণ করে ছবি ও সুপারিশসহ আবেদন করেন।  

“এক হাজার টাকা আসলে এই যুগে খুব কম টাকা। এটা তো বাড়ানো প্রয়োজন। সময়ের সাথে সাথে সব পরিবর্তন হয়, এটারও পরিবর্তন দরকার। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সক্ষমতার বিষয়টিও বিবেচ্য” - উপ উপাচার্য (শিক্ষা), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এর মধ্যে আবাসিক হলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন, সুবিধা অনুযায়ী সময়ে তারা হল কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করেন, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে নিয়োগপ্রাপ্তরা মাসে মোট ৩০ ঘণ্টা লাইব্র্র্রেরি সংশ্লিষ্ট করেন, রেজিস্টার অফিসে নিয়োগপ্রাপ্তদের প্রতি মাসে অন্তত ৩০০ নাম এন্ট্রি করতে হয়, কাউন্সেলিং শাখায় মূলত সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষার্থীদেরকে নেওয়া হয়। ৬ মাসে তাদের কমপক্ষে ৬০ জন ক্লায়েন্ট দেখতে হয় অথবা ৯০টি সেশন পরিচালনা করতে হয়। অন্যদিকে, পরামর্শদান দফতরে নিয়োগপ্রাপ্তরা দফতর সংশ্লিষ্ট কাজে মাসে ৩০ ঘণ্টা অ্যাসিস্ট করে থাকেন।  

আরও জানা যায়, ২০১৫ সালের আগে শিক্ষার্থীদের খণ্ডকালীন চাকরির সম্মানীর পরিমাণ ছিল মাত্র ৫০০ টাকা। নতুন নীতিমালা করে তৎকালীন সময়ে সিন্ডিকেট সভায় ১০০০ টাকা সম্মানীর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তারপরও এ পরিমাণটি যথোপযুক্ত নয় বলে প্রশ্ন তুলে বিভিন্ন সময়ে তা বাড়ানোর দাবি তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।  

“এক হাজার টাকা সম্মানীর বিষয়টি কোনোভাবেই উপযুক্ত নয়, যা আমরাও উপলব্ধি করি। আমরা বিষয়টি নিয়ে বহুদিন ধরে কথা বলছি” - পরিচালক, ছাত্র-নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতর, ঢাবি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আশিকুর রহমান রাফি নিজের অনুভূতি ও মতামত জানিয়ে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আর্থিকভাবে ইনস্ট্যাবিলিটি নিয়ে গ্রাম থেকে আসা আমি জানি যে, জীবনধারণের জন্য একজন শিক্ষার্থীর জন্য টিউশন বা পার্ট টাইম জবের কতটা প্রয়োজন। কথিত ভাল সাবজেক্টে পড়ুয়ারা একাধিক টিউশন পেলেও ভাষা, সংস্কৃতি বা ইতিহাসভিত্তিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা সংকটে থাকেন। তাদের জন্য পার্ট টাইম যে-কোনো জব অনেকবেশি দরকার। এ বিষয় বিবেচনায় বছরে দুইবার নির্দিষ্টসংখ্যক শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন চাকরি দেওয়ার উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কিন্তু তাদের নীতি অনুযায়ী মাসে ১ হাজার করে টাকা সম্মানী হিসেবে দেওয়া হয়। আমার মনে হয়, এটা সম্মানীর নামে অসম্মান।  

তিনি আরও বলেন, তারা শিক্ষার্থীর ফাইনান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটির (আর্থিক সচ্ছলতা) জন্য এই উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু ১ হাজার টাকায় এক মাসে আসলে একজন স্টুডেন্ট কী করতে পারে? বর্তমান যুগের চাহিদায় এই টাকা কিছুই না। বাহ্যিকভাবে এ উদ্যোগের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি রক্ষার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেলেও আদতে ফাঁকা বুলি টাইপের বিষয় এটি। আর ৩৭ হাজার শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে মাত্র ১৫০ জনকে কাজের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, তাও ১ হাজার টাকায়। এটা দুঃখজনক। উন্নত বিশ্বে বিভিন্ন সেক্টরে শিক্ষার্থীদেরকে কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় সম্মানজনক বেতনে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই চর্চা কবে হবে তা দেখার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু পাব কিনা, সেই প্রশ্ন রাখলাম কর্তৃপক্ষের কাছে।  

আরও পড়ুন: ডাকসুর চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তার ছেলে আর নেই

হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলে একসময় হল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে খণ্ডকালীন চাকরি করেছেন ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী মো. মোজাহিদুল ইসলাম। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন কাজে যে সম্মানী প্রদান করা হয়, তা অতি সামান্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে এ সম্মানীর মাধ্যমে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদেরকে সহায়তা করা। কিন্তু বাস্তবে জীবনধারণের জন্য যেখানে মাসে অন্তত ৪০০০ টাকা প্রয়োজন, সেখানে মাত্র ১০০০ টাকা সম্মানী কার্যত অপ্রতুল। শিক্ষার্থীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী ও শিক্ষার পাশাপাশি জীবনধারণে সহায়ক হওয়ার ক্ষেত্রে এটি যথার্থ নয়।

জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক ছাত্র উপদেষ্টা ও হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের সিনিয়র হাউজ টিউটর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম বলেন, বিভাগের ছাত্র উপদেষ্টা ও হলগুলোর হাউজ টিউটরদের সম্মানী প্রায় কাছাকাছি। যা যথোপযুক্ত নয়। যদিও শিক্ষকরা নির্দিষ্ট সময় এসব দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণভাবে কিছু সুবিধা পেয়ে থাকেন। তারপরও আমার মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে পারে। কারণ, দায়িত্বপ্রাপ্তদের এসব বিষয়ে অনেক কাজ করতে হয়।  

তিনি আরও বলেন, কাজের যথাযথ মূল্যায়ন না করা হলে শিক্ষকরা ভবিষ্যতে অনাগ্রহী হবেন। এটা নিয়ে শিক্ষকদের বিভিন্ন মিটিংয়ে আলাপ উঠেছে, কিন্তু বাজেট স্বল্পতার কথা বলে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। একবার অধ্যাপক আখতারুজ্জামান স্যার ভিসি থাকাকালীন সিনেটে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ বিষয়ে প্রস্তাব উত্থাপিত হলে, তা বিবেচনায় না নিয়ে উল্টো প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।

আরও পড়ুন: ভাষা সৈনিক আহমদ রফিকের মৃত্যুতে ঢাবি উপাচার্যের শোক

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার মুনসী শামস উদ্দিন আহম্মাদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি যতদূর জানি বিশ্ববিদ্যালয়ের অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট সময় কাজের সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে একটা সম্মানী প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে নীতিমালা রয়েছে, সে অনুযায়ীই তা পরিচালিত হয়। তবে সম্মানীর পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে আমার ধারণা নেই। এ ব্যাপারে কোনো ফোরামে নতুন কোনো সিদ্ধান্তও আমি রেজিস্টার হওয়ার পর গৃহীত হয়নি। তবে আরও খোঁজ নিয়ে জানানো যাবে।  

তিনি আরও বলেন, খণ্ডকালীন চাকরির বিষয়টি সম্পূর্ণই দেখে টিএসসির ছাত্র-নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতর। তারাই এ ব্যাপারে জানাতে পারবে।  

বক্তব্য জানতে চাইলে ছাত্র-নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতরের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মেহজাবীন হক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এক হাজার টাকা সম্মানীর বিষয়টি কোনোভাবেই উপযুক্ত নয়, যা আমরাও উপলব্ধি করি। আমরা বিষয়টি নিয়ে বহুদিন ধরে কথা বলছি। বাজেট ইস্যু এবং ইউজিসি থেকে অ্যাপ্রুভালের বিষয় আছে, যার কারণে কর্তৃপক্ষ বাড়াতে চাচ্ছে না। শুধু শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেই নয়, ১০ বছর ধরে ছাত্র উপদেষ্টাদের সম্মানীও ১ হাজার টাকা। কিন্তু তাদের অনেক কাজ করতে হয়। সে সাপেক্ষে ২ হাজারের দাবি জানানো হয়েছিল। সেটা আর হয়নি। 

তিনি আরও বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করে বা কাউন্সেলিং করায় তাদেরকেও ১ হাজার টাকা করে সম্মানী দেওয়া হয়। তাদের কাজের চাপও বেশি। আমি আমার সাধ্যের বাইরে তো কিছু করতে পারিনা।  

সম্মানী বাড়ানেরা বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এক হাজার টাকা আসলে এই যুগে খুব কম টাকা। এটা তো বাড়ানো প্রয়োজন। সময়ের সাথে সাথে সব পরিবর্তন হয়, এটারও পরিবর্তন দরকার। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সক্ষমতার বিষয়টিও বিবেচ্য। এ আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনা করে যখন বা যে পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন হবে, বিশ্ববিদ্যালয় সে অনুযায়ী কাজ করবে।