উদ্বোধনেই শেষ গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি শনাক্তে ঢাবির সফটওয়্যার
- ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৩০
বাংলা ভাষায় লিখিত গবেষণাপত্র, অ্যাসাইনমেন্ট, টার্ম পেপার, থিসিস পেপারসহ বিভিন্ন আর্টিকেলে সিমিলারিটি (প্লেজারিজম) শনাক্ত করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) `ডিইউবিডি২১’ নামে একটি সফটওয়্যার উদ্ভাবিত হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার তার টিম নিয়ে এটি উদ্ভাবন করেন।
সুফল তো দূরের কথা, তিন বছরেরও বেশি সময় আগে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হলেও এখন পর্যন্ত এ সফটওয়ারটি ব্যবহারই করেনি বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু তাই নয়, সফটওয়্যারটি যে উদ্ভাবিত হয়েছে বা অস্তিত্ব আছে সেটিও সংশ্লিষ্ট অনেকে জানেন না।
এছাড়া, উদ্ভাবক দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে থাকায় ও সংশ্লিষ্ট কোথাও হস্তান্তর না করায় এটি কেউ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অফিস অপারেট করতে পারছে না। তবে এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাফিলতি রয়েছে বলে জানা গেছে। দীর্ঘদিনের শ্রম দিয়ে উদ্ভাবক সফটওয়্যারটি বানালেও তা ফলপ্রসূ বা কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংবলিত রিসোর্স সংগ্রহ ও ফান্ডিং নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় কোনোরকম উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। বরং শুধু আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মাধ্যমে নামকাওয়াস্তে স্বান্তনাই দিয়েছে তাকে। ফলে প্রযুক্তিগত এমন মূল্যবান সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তা কাজে লাগানোর উদ্যোগ না নেওয়ায় উদ্বেগ জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
‘ডিইউবিডি সফটওয়্যারটির মৌলিক কাজ আব্দুস সাত্তার স্যার রেডি করেছেন ঠিকই। কিন্তু এতে বাংলায় লিখিত বিভিন্ন জার্নাল, বই, আর্টিকেলসহ অনেক তথ্যের ইনপুট দিতে হবে। কারণ, তথ্য না থাকলে লেখার সিমিলারিটি কীভাবে নির্ণয় করবে?’ - পরিচালক, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখা, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, ঢাবি।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষায় লিখিত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক লেখা, গবেষণাপত্র, অ্যাসাইনমেন্ট, থিসিস বা অন্য যেকোনো লেখার মৌলিকত্ব যাচাই ও চৌর্যবৃত্তি শনাক্ত করতে মূলত ‘টার্নিটিন’ নামক বিদেশি সফটওয়্যার দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এখনো যেটির ব্যবহার চলছে।
কিন্তু বাংলা লেখার চৌর্যবৃত্তি ঠেকাতে ডিজিটাল কোনো মাধ্যম বা সফটওয়্যার ছিল না। এদিকে, কলা অনুষদের অধিকাংশ বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণাপত্র বা থিসিস ও নিবন্ধ বাংলায় রচিত হয়ে থাকে। এগুলোর সিমিলারিটি যাচাই করতে সনাতন পদ্ধতি ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। যার কারণে, এক্ষেত্রে বড় ধরনের ফাঁকফোকর থেকে যায় বলে দাবি অনেকের।
এ সংকটের কথা চিন্তা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট শিক্ষক আব্দুস সাত্তারের টিম দীর্ঘ ৮ মাসের প্রচেষ্টায় ডিইউবিডি২১ সফটওয়্যারটি উদ্ভাবন করেন। যা ২০২২ সালের ২ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্দুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান উদ্বোধন করেন।
‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত প্রতিটি পত্রিকা এবং সব ধরনের লেখা এখন থেকেই ওয়ার্ড ভার্সনে ইউনিকোডে অনলাইনে আপলোড করতে হবে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে পুরানো পত্রিকা ও বইপত্র ইউনিকোডে রূপান্তর করার উদ্যোগ নিতে হবে। তখন যে কোনো সফটওয়্যারে ফেলে নতুন গবেষণার মৌলিকত্ব যাচাই করার কাজটি সহজ হবে।’ - তারিক মনজুর, অধ্যাপক, ঢাবি।
উদ্বোধনের সময় সংশ্লিষ্টরা জানান, এ সফটওয়্যারটি বাংলা ভাষায় লেখার মৌলিকত্ব যাচাই করার পাশাপাশি তাতে কোন কোন উৎস থেকে তথ্য নেওয়া বা ‘কপি করা’ হয়েছে, কত শতাংশ কপি করা হয়েছে, তা দেখাবে। তাছাড়াও তথ্যসূত্রের লিংকও দেবে এটি। সফটওয়্যারটি প্রথমে বাংলা ভাষায় লিখিত বিভিন্ন রিসার্চ আর্টিকেল, অ্যাসাইনমেন্ট প্রাইমারি সোর্স হিসেবে ইনক্লুড করবে। সে ক্ষেত্রে উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন গবেষণা জার্নালকে ব্যবহার করা হবে। তারপর নতুন কোনো গবেষণার সিমিলারিটি ইনডেক্স নির্ণয়য়ের জন্য সফটওয়্যারে ইনপুট করা হলে সেটি নির্ণয় করবে।
তবে সফটওয়্যারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আদৌও ব্যবহার করা হয় কিনা তা জানতে চাইলে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস কথা বলে ঢাবির প্রশাসনিক ভবনস্থ প্রশাসন-১ এর ডেপুটি রেজিস্টার জি এম মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সংবলিত যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, ‘স্যার (আবদুস সাত্তার) দেশের বাইরে আছেন। সফটওয়্যারটি হয়ত উনি বিশ্ববিদ্যালয়ে দিয়ে যাননি। তবে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও আইসিটি সেল ভাল বলতে পারবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেলের অতিরিক্ত পরিচালক মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘আমি যতদূর জানি, উদ্বোধন হওয়ার পর সফটওয়্যারটির প্রায়োগিক কার্যক্রম এগোয়নি। তারপরও এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ ভাল বলতে পারবে। আমাদের আইসিটি সেলে হস্তান্তর করা হয়নি বা আমরা এটি নিয়ে কোনো কাজও করিনি।’
‘এ সফটওয়্যারটির বিষয়ে আমার কাছে সে অর্থে কোনো তথ্য নেই। তথ্য জেনে জানাতে হবে যে, এটা বর্তমানে কার কাছে বা কোথায় আছে। যদি এটা থেকে থাকে তাহলে তো বিষয়টি ইন্টারেস্টিং।’ - উপ উপচার্য (শিক্ষা), ঢাবি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার মুনসী শামস উদ্দিন আহম্মাদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার ধারণা নেই। আমার নিয়োগ হওয়ার বেশিদিন হয়নি। আমার সময়ে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য নজরে আসেনি।’
আরও পড়ুন: নীলক্ষেতে ডাকসুর ব্যালট ছাপায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণাপত্র, থিসিস ও নিবন্ধের মৌলিকতা যাচাইয়ের কাজ কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার অধীনে সম্পন্ন হয়। এ শাখার পরিচালক আনিছুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ডিইউবিডি সফটওয়্যারটির মৌলিক কাজ আব্দুস সাত্তার স্যার রেডি করেছেন ঠিকই। কিন্তু এতে বাংলায় লিখিত বিভিন্ন জার্নাল, বই, আর্টিকেলসহ অনেক তথ্যের ইনপুট দিতে হবে। কারণ, তথ্য না থাকলে লেখার সিমিলারিটি কীভাবে নির্ণয় করবে?’
তিনি বলেন, ‘এতে শুধু বাংলা লেখাসংবলিত তথ্য ইনপুট দিলেই হবেনা, বরং সেই লেখাগুলো ইউনিকোড ফরম্যাটে দিতে হবে, কারণ ‘সুতনি এমজে’ অনলাইনে সাপোর্টিভ নয়। এজন্য এতে অনেক কাজ বাকী আছে। আর উদ্ভাবক বেশকিছু রিকোয়ারমেন্ট দিয়েছিলেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সে অনুযায়ী কাজ করতে পারেনি। এক্ষেত্রে ফান্ডিং একটা মেজর ফ্যাক্ট।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির ভারপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক কাজী মোস্তাক গাউসুল হক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমার জানামতে লাইব্রেরিতে বাংলা লেখার প্ল্যাজারিজম চেক করার কোনো সফটওয়্যার নেই। ডিইউবিডি২১ সফটওয়্যারটি হয়ত পরীক্ষামূলকভাবে উদ্বোধন হয়েছিল, কিন্তু কার্যক্রম শুরু হয়নি। আমি এর আগে এ বিষয়ে শুনিইনি, আজ প্রথম শুনলাম। তারপরও আমি লাইব্রেরিতে খোঁজ নেবো যে, এটা আসলে কখনো ব্যবহার করা হয়েছে কিনা।’
এদিকে, সফটওয়্যারটির সার্বিক বিষয়ে বিস্তারিত জানতে উদ্ভাবক আব্দুস সাত্তারকে কয়েকদিন ধরে কল দিয়ে এবং বার্তা ও ইমেইল পাঠিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি।
বক্তব্য জানতে তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. বি এম মাইনুল হোসাইনকেও একাধিকবার কল দিয়ে পাওয়া যায়নি।
এরপর এ বিষয়ে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের কথা হয় তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের সিনিয়র অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার আবুল খায়ের মো. দীন ইসলামের সঙ্গে। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ডিইউবিডি২১ সফটওয়্যারটির উদ্ভাবক আব্দুস সাত্তার পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করতে বিদেশে গিয়েছেন। এটির কোনো খবর তিনি জানেন না।
আরও পড়ুন: ঢাবিতে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক একজন, চিঠি ইস্যু হয় আরেকজনের নামে
তবে তিনি জানান, এটি উদ্ভাবনে ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শোয়াইব দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি এ ব্যাপারে জানেন। এরপর অধ্যাপক শোয়াইবকে ইমেইল পাঠিয়ে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্লেজারিজম যাচাই করার সফটওয়্যারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই বলে মন্তব্য করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদভুক্ত বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তারিক মনজুর। তবে এ ধরনের সফটওয়্যার পুরো কাজ করতে পারবে না বলে তিনি মনে করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সব বই, গবেষণা বা লেখা এখনও সফটকপিতে ইউনিকোডে রূপান্তর করা যায়নি। ফলে, কোনো থিসিস বা অভিসন্দর্ভে শতকরা কত ভাগ অনুকরণ করা হয়েছে, তা সফটওয়্যার দিয়ে পুরোপুরি যাচাই করা সম্ভব নাও হতে পারে। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই গবেষক প্যারাফ্রেজিং করেন, অর্থাৎ অন্যের বক্তব্য নিজের ভাষায় লিখে দেন। তাই শেষ পর্যন্ত বিষয়-বিশেষজ্ঞই গবেষণাকর্মের মৌলিকত্ব সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।’
অধ্যাপক তারিক মনজুর আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত প্রতিটি পত্রিকা এবং সব ধরনের লেখা এখন থেকেই ওয়ার্ড ভার্সনে ইউনিকোডে অনলাইনে আপলোড করতে হবে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে পুরানো পত্রিকা ও বইপত্র ইউনিকোডে রূপান্তর করার উদ্যোগ নিতে হবে। তখন যে কোনো সফটওয়্যারে ফেলে নতুন গবেষণার মৌলিকত্ব যাচাই করার কাজটি সহজ হবে।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এ সফটওয়্যারটির বিষয়ে আমার কাছে সে অর্থে কোনো তথ্য নেই। তথ্য জেনে জানাতে হবে যে, এটা বর্তমানে কার কাছে বা কোথায় আছে। যদি এটা থেকে থাকে তাহলে তো বিষয়টি ইন্টারেস্টিং।’
তিনি আরও বলেন, ‘অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, কোনো সফটওয়্যার বানিয়ে উদ্বোধনের পর যে কাজে বানানো হয় সে কাজে আর ব্যবহৃত হয় না বা প্রোপারলি কাজ করে না, কিংবা মানসম্মত হয় না। কোয়ালিটি নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার কারণেই এমন হচ্ছে নাকি অন্য কোনো কারণে, তা আমাদের খোঁজ নিতে হবে।’