বিনামূল্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেবে এআই অ্যাপ ‘মনতরঙ্গ’, অভিনব উদ্যোগ
- ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯:৩১
যাপিতজীবনে অনেকে মুখে হাসি আর চোখে স্বপ্ন নিয়ে হাঁটেন, অথচ ভেতরে ভেতরে কেউ লড়ছেন নিঃশব্দ এক যুদ্ধে, কেউবা চুপচাপ ভেঙে পড়ছেন অজানা ক্লান্তিতে। মনের কষ্টগুলো অনেক সময় বলা হয়ে ওঠে না, আর বলার মতো কাউকে পাওয়া তো আরও বিরল। কিন্তু মনও যত্ন চায়, বোঝার কেউ চায়—যেমন শরীর বিশ্রাম চায়, তেমনি মন সহানুভূতি চায়। তাই আজ মানসিক সুস্থতা কেবল কামনার বিষয় নয়, বরং বেঁচে থাকার অপরিহার্য শর্ত। এ বিশ্বাস থেকেই জন্ম ‘মনতরঙ্গ’। এটি একটি বাংলাভাষী এআই অ্যাপস, সেখানে বিনামূল্যে মিলবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা। এ অভিনব উদ্যোগে যে কেউ সপ্তাহে যে কোনোদিন ২৪ ঘণ্টায় পেতে পারে মানসিক চিকিৎসার সহায়তা।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে আনুমানিক ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ও ১২.৬ থেকে ১৩.৬ শতাংশ শিশু-কিশোর মানসিক স্বাস্থ্যের কোনো না কোনো সমস্যায় ভুগছেন, অথচ মানসিক সহায়তা এখনো অনেকের নাগালের বাইরে। ঠিক এমন সময়েই কিছু তরুণ প্রথমবারের মতো নিয়ে এসেছেন বাংলাভাষী মানসিক স্বাস্থ্য সঙ্গী এআই ‘মনতরঙ্গ’। এটি একটি ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন (https://montorongo.com/) যা ডিপ্রেশন, উদ্বেগসহ নানা মানসিক চাপের সময়ে সহানুভূতিশীল কথোপকথনের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের পাশে দাঁড়ায়। এটি শুধু তথ্যভিত্তিক নয়, বরং সহমর্মিতা ও দিকনির্দেশনার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সহায়তা করার উদ্দেশ্যে তৈরি একটি সেবামূলক উদ্যোগ।
আরও পড়ুন: যেসব খাবার খেলে বাড়বে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
‘মনতরঙ্গ’-এর মানবসম্পদ বিভাগে দায়িত্বে থাকা শামিহা মালিক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, একটি নির্বাহী কাউন্সিল মনতরঙ্গ তৈরির মূল কারিগর, যেটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু তরুণ মিলে তৈরি করেছেন। এই উদ্যোগ আপাতত একটি ওয়েবসাইট আকারে চালু হলেও, ভবিষ্যতে এটি অ্যাপ হিসেবেও আসছে। যাতে আরও সহজে সবার কাছে পৌঁছানো যায়। তিনি বলেন, ‘যখন একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষার আগের রাতে এতটাই বিষণ্নতায় থাকে যে কারও সঙ্গে কিছু ভাগাভাগি করতে পারে না, তখন সে মনতরঙ্গ সাইটে এসে নক করে সহজেই সহানুভূতিশীল সহায়তা পেতে পারে—যাতে মন হালকা করে আবার পড়াশোনায়ও মনোযোগ দিতে পারে।’
‘মনতরঙ্গ’-এর মানবিক উদ্যোগে একত্র হয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা, যাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠছে সহমর্মিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ, নির্ঝর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ইউনিভার্সিটি অব সাইবারজায়া, বিএএফ শাহীন কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কবি নজরুল সরকারি কলেজ এবং গভর্নমেন্ট সায়েন্স কলেজের শিক্ষার্থীরা মিলে এ প্রয়াসকে এগিয়ে নিচ্ছেন একযোগে। শিক্ষা শুধু শ্রেণিকক্ষেই সীমাবদ্ধ নয়—এই তরুণরাই প্রমাণ করছেন, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রকৃত শিক্ষার আলো।
মূল উদ্দেশ্য
এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসঙ্গী তৈরি করা যা সপ্তাহে ২৪ ঘণ্টা পরিষেবা প্রদান করবে। প্রায় ১৩ থেকে ৩০ বছর বয়সের যারা আছেন তাদের মানসিক স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার এবং মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে তাদের জন্য একটি নিরাপদ স্থান প্রদান করা। বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই ব্যবহারকারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা শনাক্ত করা ও গুরুতর ক্ষেত্রে পেশাদার মনোবিজ্ঞানীদের শরণাপন্ন হতে অনুপ্রাণিত করা। বিনা মূল্যে, সুলভে ও সামাজিক কলঙ্কমুক্ত মানসিক সহায়তা নিশ্চিত করা। একটি দীর্ঘমেয়াদী ‘মানসিক স্বাস্থ্য সহায়ক’ হিসেবে দেশব্যাপী একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করা—চ্যাটবটের পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জুড়ে কন্টেন্ট, অংশীদারত্ব এবং সম্প্রদায় সচেতনতার মাধ্যমে। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির দ্বারপ্রান্তে তাদের সেবা আরো সহজে পৌঁছে দিতে তাদেরই প্লাটফর্ম থেকে বিভিন্ন রিপ্রেজেন্টেটিভ নিয়োগ করা। এ যুগে স্মার্টফোন ব্যবহারকে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির একটি মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলা।
বৈশিষ্ট্যসমূহ
এই প্ল্যাটফর্মে রয়েছে সপ্তাতে প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টাএআই চ্যাটবট সহায়তা, যা টেক্সট ছাড়াও ফোন কলের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর সাথে যোগাযোগ করতে পারে এবং স্বরের ফ্রিকোয়েন্সি বিশ্লেষণ করে মানসিক অবস্থা শনাক্ত করতে সক্ষম। ব্যক্তিগত মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এতে রয়েছে মুড ট্র্যাকিং, চিন্তাভাবনা-ভিত্তিক জার্নালিং এবং আবেগ প্রতিফলনের মতো সরঞ্জাম। পাশাপাশি, বিষণ্নতা ও উদ্বেগের প্রাথমিক শনাক্তকরণের জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত পিএইচকিউ-৯ এবং জিএডি-৭ মূল্যায়ন টেস্ট।
ইউজারের নিজের যত্ন সম্পর্কিত কাজ
মনতরঙ্গ ব্যবহারকারীদের একটি সুশৃঙ্খল ও সচেতন জীবনধারা গড়ে তুলতে সহায়তা করে। যেসব দিনে ব্যবহারকারী নিজের যত্ন নেওয়া ভুলে যান, সে দিনগুলোতে মনতরঙ্গ তাদের সতর্ক করে, স্ব-যত্নের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয় এবং নিয়মিত জীবনযাপনে ফিরে যেতে প্রয়োজনীয় অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা ধীরে ধীরে ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতে পারে, যা মানসিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
জরুরি সহায়তা ও সংকটকালীন দিকনির্দেশনা
গুরুতর মানসিক অবস্থার ক্ষেত্রে, মনতরঙ্গ সর্বাগ্রে ব্যবহারকারীর সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে তাকে পেশাদার সহায়তা বা জরুরি সহায়তা নেওয়ার জন্য যথাযথ দিকনির্দেশনা প্রদান করে। পাশাপাশি, এটি অফলাইনেও অ্যাক্সেসযোগ্য বিভিন্ন সহায়ক সামগ্রী সরবরাহ করে, যার মধ্যে রয়েছে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় কিউরেটেড ভিডিও/অডিও কনটেন্ট, স্থানীয় প্রাসঙ্গিক নিবন্ধ, বাস্তবভিত্তিক গল্প এবং আবেগ প্রকাশে সহায়ক ইন্টার্যাকটিভ টুলস—যা সংকটময় সময়ে ব্যবহারকারীদের মানসিক স্থিতি বজায় রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
কেন অন্য সকলের থেকে আলাদা?
‘মনতরঙ্গ’ অন্যদের থেকে আলাদা কারণ এটি বিশেষভাবে বাংলাদেশের জন্য তৈরি—স্থানীয় ভাষা, প্রেক্ষাপট ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতাকে গুরুত্ব দিয়ে ডিজাইন করা হয়েছে। এটি কেবল রোবোটিক চ্যাটবট নয়, বরং একজন বন্ধুর মতো আবেগীয়ভাবে সংবেদনশীল সহযাত্রী। এখানে নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়—শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যাগুলো প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করে সংকটের আগেই সহায়তা করা হয়। পাশাপাশি, এটি সম্প্রদায়কেন্দ্রিক সহায়তা গড়ে তোলে, সহপাঠী ও প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে একটি দীর্ঘমেয়াদি সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি করে। প্ল্যাটফর্মটির লক্ষ্য এক শক্তিশালী, আবেগীয়ভাবে সচেতন নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলা, যারা কেবল যন্ত্রণা থেকে বাঁচবে না বরং মানসিকভাবে দৃঢ় হয়ে উঠবে। ‘মনতরঙ্গ’ ডিজিটাল ইক্যুইটি বজায় রেখে এমন স্থানেও পৌঁছাতে চায়, যেখানে পেশাদার থেরাপির সুযোগ সীমিত। আর যদি একজন মানুষকেও দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়ে একটু সাহস দিতে পারে, সেটাই প্ল্যাটফর্মটির সবচেয়ে বড় অর্জন।
প্ল্যাটফর্মটির কাজের কৌশল
যখন ব্যবহারকারী চ্যাটবটের সাথে কথোপকথন শুরু করেন, তখন এটি প্রদত্ত কথোপকথন থেকে সমস্যার লক্ষণগুলো শনাক্ত করে। ব্যবহারকারীকে তাদের অনুভূতি সম্পর্কে খোলামেলা হতে সহায়তা করে, তারপর তাদের সেগুলো নিয়ে চিন্তা করতে, শ্বাস-প্রশ্বাস/মননশীলতার সরঞ্জামগুলো ব্যবহার উৎসাহিত করে। যদি তাদের অবস্থা গুরুতর বলে মনে হয়, তাহলে এআই মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দেয়। নামবিহীন ব্যবহারকারীর সাথে হওয়া অভিজ্ঞতা থেকে শেখা এবং সে অনুযায়ী সেবাকে আরও উন্নত করা।
বিশেষায়িত বৈশিষ্ট্যসমূহ
মনতরঙ্গ প্ল্যাটফর্মটি প্রায় ১০ জন অভিজ্ঞ মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞের সরাসরি পর্যবেক্ষণে পরিচালিত হচ্ছে, যারা প্রতিনিয়ত ব্যবহারকারীদের সহায়তায় যুক্ত আছেন। এ ছাড়াও ব্যবহারকারীদের পোস্ট ও বার্তাগুলোর উত্তর দিতে ‘মনোবিজ্ঞান’ বিষয়ে প্রশিক্ষিত প্রায় ১৫ জন মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থী নিবেদিতভাবে কাজ করছেন, যাতে প্রতিটি কথোপকথন হয় সহানুভূতিপূর্ণ, তথ্যভিত্তিক ও বাস্তব সহায়ক।
সবশেষে, ‘মনতরঙ্গ’ ২০২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি অলাভজনক সংস্থা, যা বাংলাদেশের তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্ল্যাটফর্মটি ডিজিটাল ইনোভেশন ও কমিউনিটি এনগেজমেন্টের মাধ্যমে একটি টেকসই মানসিক সুস্থতার সংস্কৃতি গড়ে তুলছে। ‘মনতরঙ্গ’ শুধু একটি চ্যাটবট নয়, বরং এটি একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ, যেখানে দেশ-বিদেশের মনোবিজ্ঞানী ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা একসাথে কাজ করছেন—যাতে তরুণ সমাজ নিজেদের মানসিক যাত্রায় একা না থাকে, বরং প্রতিটি পর্যায়ে সহায়তা পায়।