নীল দলে শিক্ষকের অভাব হতো না, সাদা দলে পাওয়া যেত না—এখন চিত্র উল্টো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নীল দল ও সাদা দলের কর্মসূচি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নীল দল ও সাদা দলের কর্মসূচি © টিডিসি সম্পাদিত

শিক্ষার্থীদের আর্থিক ক্ষমতায়নই ছাত্ররাজনীতি সংস্কারের মূল চাবিকাঠি বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন। তিনি বলেছেন, শিক্ষকরা যদি সামান্য লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠতে না পারেন, তারা ছাত্রদের কি শেখাবেন বা কিভাবে উদাহরণীয় হবে? আগে নীল দলের মিটিংয়ে শিক্ষকের অভাব হতো না, আর সাদা দলে পাওয়া যেত না, এখন চিত্র উল্টো বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

আজ রবিবার (১০ আগস্ট) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে এ মন্তব্য করেন অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা যদি বলি বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করলে গুপ্ত রাজনীতি বেড়ে যাবে, তখন এইটা আসলে আওয়ামী বয়ানের মতো হয়ে গেল। ঠিক যেমন আওয়ামী লীগ বলতো, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে দেশে জঙ্গিবাদী ভর করবে। কি বেড়ে যাবে আর কি কমে যাবে, এইটা দেখেতো সঠিক কাজটি করব কি করব না, তা নির্ধারিত হবে না। 

‘যেমন- আওয়ামী লীগ যদি তখন এই জুজুর ভয়ের আড়ালে আকাম-কুকাম না করে পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করতো, সকল মানুষের কল্যানে রাজনীতি করতো, অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন দিতো- তাহলেই দেশের সত্যিকারের উন্নয়ন দেখতাম। একইভাবে আমরা যদি ছাত্রদের জন্য need based এবং merit based স্কলারশিপ চালু করি, ক্যাম্পাসে ছাত্রদের পার্ট-টাইম চাকুরীর ব্যবস্থা করি, যাদের প্রয়োজন তাদের সকলের আবাসন ব্যবস্থা করি তাহলে ইচ্ছের বিরুদ্ধে গুপ্ত, সুপ্ত কিংবা অনিচ্ছায় ছাত্রদেরকে রাজনীতিতে জড়ানো যাবে না,’ যোগ করেন তিনি।

তার ভাষ্য, ‘অর্থনৈতিক vulneberibility-কে ব্যবহার করেই অনেক শিক্ষার্থীকে রাজনীতির চোরাবালিতে ঢোকানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ার সুযোগ পাবে তাদের সবাইকেই অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের আর্থিক ক্ষমতায়নই ছাত্র রাজনীতির সংস্কারের মূল চাবিকাঠি। যখন শিক্ষার্থীরা স্কলারশিপ, পার্ট-টাইম চাকরি বা অন্যান্য সহায়তার মাধ্যমে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হয়ে উঠবে, তখন তারা আর প্রয়োজনের তাগিদে নয়, বরং প্রকৃত বিশ্বাস ও আদর্শের প্রেরণায় রাজনীতিতে যুক্ত হবে।’

এ পরিবর্তন ছাত্র রাজনীতিকে বেঁচে থাকার সংগ্রাম থেকে সরিয়ে এনে আদর্শভিত্তিক, সুস্থ ও নীতিনিষ্ঠ ধারায় রূপান্তরিত করতে পারে উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন বলেন, ‘বর্তমান বাস্তবতায় দেখা যায়, কারও জন্য একটি টিউশন খুঁজে দেওয়া, থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া বা সামান্য আর্থিক সাহায্য দেওয়ার মাধ্যমেই অনেক সময় শিক্ষার্থীদের স্বাধীন জীবনকে নির্ভরতার ফাঁদে বন্দি করা হয়। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা মানুষকে গভীরভাবে দুর্বল করে তোলে। তাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর এই দুর্বলতা যদি আমরা দূর করে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করতে পারি, তবে তাদের মেরুদণ্ড দৃঢ় হবে।’

তিনি বলেন, ‘তখনই আমরা জাতি হিসেবে মেরুদণ্ডওয়ালা, স্বনির্ভর ও মর্যাদাবান মানুষ গড়ে তুলতে সক্ষম হব। এরপর স্বেচ্ছায় যারা রাজনীতি করবে তাদেরকে আটকানো উচিত না। আমাদেরকে তখন শুধু দেখতে হবে কেউ আইন লঙ্ঘন করছে কিনা।’

আরও পড়ুন: ঢাবি ছাত্রীদের সঙ্গে উপাচার্যকে জড়িয়ে জবি ছাত্রদল সদস্য সচিবের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, সমালোচনার ঝড়

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন আরও বলেন, ‘শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও একই কথা। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। তাদেরকে এমন বেতন দেওয়া হয় যেন শিক্ষকরা সরকারি রাজনীতিতে জড়িয়ে আবাসিক শিক্ষক, সহকারী প্রক্টর ইত্যাদি নানা প্রশাসনিক পদের পেছনে দৌঁড়ায়। কারণ এসব পদ পেলে কিছুটা আর্থিক লাভ হয়, একটি বাসা পায়, প্রমোশনের জন্য পয়েন্ট পায়। রাজনীতি করলে অনেক অনেক সুবিধা আছে।’

তিনি বলেন, ‘ছাত্র-শিক্ষকদের আর্থিক দিকটা ঠিক করলে অন্তত শিক্ষকদের মেরুদন্ডটা সোজা হতো। দেখুন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সরকারি দল নীল দলের মিটিং-এ শিক্ষকের অভাব হতো না। আর সাদা দোলের মিটিং-এ শিক্ষক পাওয়া যেত না। এখন চিত্র ঠিক উল্টো। শিক্ষকদের উন্নত বিশ্বের না হউক নিজ দেশের একই শহরের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন বেতন দেয়। তার কাছাকাছি দেন আর তারপর দেখুন রাজনীতি করার জন্য শিক্ষক পান কিনা। শুধু তাই না সামান্য নিজ কোর্সের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মূল্যায়নের জন্য কোন টাকা চাইবে না কেউ।’

তার কথায়, ‘শিক্ষকদের কম বেতন দিয়ে এসব খুচরা খাচরা অর্থপ্রাপ্তি নিয়ে মনোমালিন্যে পর্যন্ত লিপ্ত হয়, যা কাঙ্ক্ষিত নয়। শিক্ষকরা যদি সামান্য লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠতে না পারে, তারা ছাত্রদের কি শেখাবে বা কীভাবে উদাহরণীয় হবে?’