বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

খাগড়াছড়িতে কিশোরীকে ‘দলবদ্ধ ধর্ষণের’ অভিযোগ নিয়ে যা জানা যাচ্ছে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি © সংগৃহীত

পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে এক কিশোরীকে ‘দলবদ্ধ ধর্ষণের’ অভিযোগ উঠেছে। তিন সপ্তাহ আগের এ ঘটনা আলোচনায় আসার পর দুই দিন ধরে খাগড়াছড়িতে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হচ্ছে। ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর সাত সংগঠন এবং নৃ-গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংগঠন এ প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করছে।

নৃ-গোষ্ঠীর ওই কিশোরীর বাবা গত বুধবার রাতে ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন এবং মামলার পরপরই রাত তিনটার দিকে ধর্ষণের অভিযোগে চারজনকে গ্রেফতার করেছে খাগড়াছড়ি পুলিশ। 

সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভুক্তভোগী ওই কিশোরী আত্মহত্যার চেষ্টা করে এবং তার অবস্থার অবনতি হয়। সে অবস্থায় তাকে গতকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

এই ‘দলবদ্ধ ধর্ষণের’ ঘটনায় অভিযুক্তদের সবাই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও স্থানীয় বিএনপি নেতারা এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন।

প্রতিবাদ-বিক্ষোভ অব্যাহত
এ ঘটনার বিচারের দাবিতে আজও খাগড়াছড়িতে প্রতিবাদ–বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। আজ শুক্রবার বিকেলে এই ঘটনার প্রতিবাদে ও বিচারের দাবিতে মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে বাংলাদেশ ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম। 

ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরামের খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা শাখার সভাপতি আকাশ ত্রিপুরা বলেন, ‘আমাদের মা-বোনেরা প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কিন্তু কোনো শাস্তি দেখতে পাচ্ছি না। গ্রেফতার করা হয়, দুইদিন জেলে পাঠায়। এরপর আবার বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়।’

এ ছাড়া আজ বেলা ১১টায় ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে জেলার মানিকছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল করেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) নেতা-কর্মীরা। পিসিপির দাবি, এ ঘটনায় অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।

আরও পড়ুন: প্রাথমিক শিক্ষকদের ঢাকায় মহাসমাবেশ, চার দফা দাবিতে লাগাতার অনশনের হুঁশিয়ারি

ধর্ষণের ঘটনার বিচারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর সাত সংগঠন। সংগঠনগুলো হলো, বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ, বাংলাদেশ ত্রিপুরা ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ ত্রিপুরা যুব কল্যাণ সংসদ, বাংলাদেশ ত্রিপুরা যুব ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ ত্রিপুরা স্টুডেন্ট ফোরাম, বাংলাদেশ ত্রিপুরা যুব সংসদ ও বাংলাদেশ ত্রিপুরা শ্রমিক সংসদ। তবে খাগড়াছড়ির বাইরেও এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ হচ্ছে।

আজ শুক্রবার সকালে পাশের জেলা রাঙামাটিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ-পিসিপি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন। সমাবেশে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ম্রানুসিং মারমা বলেন, ‘পাহাড়ি নারীরা নিজের ঘরে বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হওয়া যেন নিত্যনৈমিত্তিক কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

তাদের অভিযোগ, পাহাড়ের যতগুলো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, তার সঠিক বিচার হয়নি।

এদিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল বৃহস্পতিবারও খাগড়াছড়িতে দিনভর বিক্ষোভ-সমাবেশ করেন শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা।

অভিযুক্তরা বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত বলে অভিযোগ
মামলার এজাহারে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাদের সবাই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে জানান স্থানীয় একাধিক সাংবাদিক এবং স্থানীয় অধিকারকর্মী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক সাংবাদিক বলেন, ‘খাগড়াছড়িতে বিএনপি প্রভাবশালী। প্রশাসনও তাদের কথা শুনে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা সবাই বিএনপির।’

তবে স্থানীয় বিএনপি নেতারা বলছেন, এই অভিযোগ সত্য নয়।

এ বিষয়ে খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপি'র সাধারণ সম্পাদক এম এন আফছারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এরা আমাদের দলের সাথে জড়িত নয়। এরা আমাদের নেতাকর্মী নয়। ওরা সাধারণ পাবলিক। যারা এটা বলতেছে, তারা সত্য বলতেছে না। আমরা মনে করি, এটা যাচাই-বাছাই করা দরকার।’

এদিকে আজ শুক্রবার যে সাত ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর সংগঠন এ ঘটনার বিচারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে, তাতে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়েছে, ‘সবাই যখন ভুক্তভোগীকে বাঁচানোর চেষ্টায় লিপ্ত, তখন একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার জন্য একটি দলের বিরুদ্ধে অপতৎপরতা চালাচ্ছে।’

আরও পড়ুন: শিক্ষার্থীদের আপত্তিতেও নতুন কারিকুলাম, নৈপথ্যে ছাত্রদল পুনর্বাসন

তবে স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, এ সাত সংগঠনের নেতাদের সবাই বিএনপি'র রাজনীতি করেন।

অভিযুক্তদের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাইলে খাগড়াছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল বাতেন মৃধা বলেন, ‘আমরা ওই বিষয়গুলো দেখবো না। কারণ অপরাধী অপরাধী-ই। সে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারে। সরকারি চাকরিজীবী হতে পারে। বেসরকারি সংস্থার সাথে জড়িত হতে পারে। এগুলো তাদের ব্যক্তিগত বিষয়।’

‘রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আমরা যাচাই করি না’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এদিকে খাগড়াছড়ি সদর থানার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরুল ইসলামও জানান যে, অভিযুক্তদের রাজনৈতিক পরিচয় তারা দেখেন না এবং ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই করাটা তাদের তদন্তের অংশও নয়। তারা অপরাধীকে অপরাধী হিসাবেই বিবেচনা করেন। যদিও কোনো কোনো জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ঘটনায় অভিযুক্তদের প্রত্যেকে বিএনপির কোনো না কোনো সংগঠনের পদধারী নেতা।

আত্মহত্যার চেষ্টা করে ভুক্তভোগী
মামলার এজাহার অনুযায়ী, গত ২৭ জুন ওই কিশোরী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। সেদিন ওই কিশোরী রথযাত্রা পূজা উৎসব পালন করার জন্য ভাইবোনছড়ার জগন্নাথ মন্দিরে যায়। 

ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরামের নেতা আকাশ ত্রিপুরার বর্ণনায়, ধর্মীয় নাচ-গান দেখতে গিয়ে রাত হয়ে যায়। ভুক্তভোগী তখন কোনো গাড়ি পায়নি বলে রাতে থাকার জন্য তার আপন কাকার বাসায় যান। ওই কাকার বাসা মন্দিরের কাছেই ছিল। কিশোরীর কাকা তার আরও তিন সহপাঠীকে নিয়ে ওই বাসাটিতে ভাড়া থাকেন। কিন্তু যাওয়ার পথে ওই কিশোরীকে অভিযুক্তরা অনুসরণ করে রাত নয়টার দিকে ওই বাসায় ঢুকে। এক পর্যায়ে তারা পালাক্রমে ভুক্তভোগীকে ধর্ষণ করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এজাহারে।

আকাশ ত্রিপুরা বলেন, ‘ওই ছয়জন এসে ছবি তোলে, ভিডিও করে। ছেলেদের বাসায় মেয়ে কেন নিয়ে আসবে, তাই কাকাসহ ওই চারজনকে হাত-পা বেঁধে মারধর করে বন্দি করে রাখে। এরপর মেয়েটিকে মুখ চেপে ধরে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয় এবং হুমকি দেওয়া হয় যে তারা যদি এই ঘটনার কথা কাউকে বলে, তাহলে তাদেরকে মেরে ফেলবে।’

আরও পড়ুন: ইবি শিক্ষার্থী সাজিদের মৃত্যুতে ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি গঠন

ভয়ে এ ঘটনার কথা তারা কাউকেই বলেনি এবং এক পর্যায়ে গত ১২ই জুলাই ভুক্তভোগী কিশোরী বিষ পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করে, বলছিলেন আকাশ ত্রিপুরা।

মামলার এজাহারেও ‘মানসিকভাবে ভেঙে পড়ায় ভয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করার কথা বলা হয়েছে’। পরে মেয়েটিকে উদ্ধার করে প্রথমে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা ধর্ষণের বিষয়টি জানতে পারেন। বর্তমানে ওই কিশোরী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

ধর্ষণের ঘটনা জানতে পেরে মেয়ের বাবা বাদী হয়ে গত বুধবার রাতেই খাগড়াছড়ি সদর মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ছয়জনকে আসামী করে মামলা করেন। মামলার পর পুলিশ চারজনকে গ্রেফতার করে। বাকি দুজন পলাতক আছে। তবে গ্রেফতারকৃতরা এখনও স্বীকারোক্তি দেয়নি বলে বিবিসিকে জানিয়েছে পুলিশ।

প্রাথমিকভাবে এ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পেয়েই পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেফতার করেছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরুল ইসলাম। এ ছাড়া আসামীদের আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন করেছে পুলিশ।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা