ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে গাড়ি তুলে দিয়ে হত্যা করা হয় কলেজছাত্র সৌরভকে

গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহীদ সারদুল আশিস সৌরভ
গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহীদ সারদুল আশিস সৌরভ © টিডিসি সম্পাদিত

৪ আগস্ট ২০২৪। শেরপুর জেলা শহরের কলেজ মোড়ের রাজপথ তখন উত্তাল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে চলছিল ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিল। বিকেলের সেই উত্তপ্ত মুহূর্তে হঠাৎ করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে জেলা প্রশাসনের একটি দ্রুতগতির গাড়ি উঠে যায় মিছিলের ভেতরে। মুহূর্তেই সব কিছু থমকে যায়। সবার চোখের সামনে রাজপথে ছিটকে পড়ে একটি তরুণ দেহ—তিনি ছিলেন সারদুল আশিস সৌরভ (২২)। আর কোনো শব্দ করেননি। নিথর পড়ে ছিলেন।

সৌরভ ছিলেন শেরপুরের ঝিনাইগাতি উপজেলার পাইকুড়া গ্রামের সন্তান। পিতা মো. সোহরাব হোসেন এবং মাতা মোছা. শামসুন্নাহার বেগমের দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। শেরপুর সেকান্দার আলী কলেজের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। শেরপুর শহরের একটি ছাত্রাবাসে থেকে স্বপ্ন বুনতেন—নিজেকে গড়ে তোলার, দেশের পাশে দাঁড়ানোর।

সৌরভ শুধু পড়াশোনাই করতেন না, সমাজসেবার এক অদম্য আগ্রহ ছিল তার ভেতরে। তিনি নিজের উদ্যোগে দরিদ্র কল্যাণ তহবিল গড়ে তুলেছিলেন। ঈদের আগে গরিবদের খাবার বিলি করতেন। গ্রামের গণকবরস্থানের উন্নয়নের জন্য একাই আড়াই লাখ টাকা চাঁদা সংগ্রহ করেছিলেন। এক তরুণ, যে নিজের কষ্টে ফ্রিল্যান্সিং করে মোটরবাইক কেনার জন্য দুই লাখ টাকা জমিয়েছিল—সেই মানুষটিই আজ শুধু স্মৃতি।

আরও পড়ুন: শিক্ষার্থীদের মিছিলে ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ি চাপায় নিহত হন মাহবুব

তার বাবা মো. সোহরাব হোসেন বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো অন্যায় করে নাই। সে মানুষের জন্য কাজ করত, গরিবদের উপকার করত। সেই ছেলে আজ নেই এক বছর হলো। যারা গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলল, তারা এখনো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি চাই আন্তর্জাতিক মানের তদন্ত হোক। মরার আগে যেন ন্যায়বিচার দেখে যেতে পারি।’

সৌরভের বড় ভাই শাহরিয়ার আশিস শোভন বলেন, ‘আমরা জানতাম না ভাই আন্দোলনে গেছে। বিকেলে তার ফোন থেকে অপরিচিত একজন জানায় ‘সৌরভ এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি’। পরে গিয়ে দেখি, ভাই আর নেই। সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েছিল, শেষ পর্যন্ত বাদ পড়ে। এরপর নিজেকে বদলাতে ডায়েট করত, ফ্রিল্যান্সিং করে টাকা জমাত। এখন সেই টাকাগুলো মাটির ব্যাংকে পড়ে আছে—কিন্তু ভাইটা নেই।’

সৌরভের মৃত্যুর পর পরিবার পেয়েছে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সহায়তা। কিন্তু অর্থ নয়, তাদের এখন একটাই দাবি—সত্য উদঘাটন হোক, বিচার হোক, ন্যায় ফিরে আসুক।

আরও পড়ুন: মৃত্যুর একদিন পর জঙ্গলে পাওয়া গেল মোস্তফার লাশ

উল্লেখ্য, শেরপুর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন বিসিএস ৪১তম ব্যাচের কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম শাকিল। গত বছর ৪ আগস্ট শাকিলকে গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন চালক হারুনুর রশীদ। এ সময় ছাত্ররা শেরপুর শহরে সরকারবিরোধী স্লোগান দিয়ে আন্দোলন করতে থাকেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাকিলের নির্দেশে চালক হারুন গাড়ি দ্রুতগতিতে চালিয়ে দেন ছাত্রদের ওপর। এতে  ঘটনাস্থলে শিক্ষার্থী মাহবুব আলম ও শারদুল আশীষ সৌরভ নিহত হন। আহত হন অনেকে।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।