ফেনীতে আধুনিক পণ্যের ভিড়ে জৌলুস হারাচ্ছে কামারশিল্প
- ০৪ জুন ২০২৫, ১৬:০১
ফেনীর শহরের ট্রাংক রোডে একটি কামারশালার মালিক পলাশ কর্মকার। বংশপরম্পরায় ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে কামারের কাজ করছেন তিনি। এক টুকরো লোহা হাতে পেলেই বানিয়ে ফেলেন দা, বঁটি, চাপাতি, ছুরিসহ নিত্য ব্যবহার্য লোহার সামগ্রী। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে ঢুকেছিলেন এই পেশায়, সেই থেকে আজও পৈতৃক পেশাকেই আঁকড়ে ধরে আছেন তিনি।
তবে পলাশ কর্মকার এখন দুশ্চিন্তায় দিন কাটান। আধুনিক মেশিনে তৈরি চকচকে দা-বঁটির দাপটে হাতে বানানো পণ্যের চাহিদা অনেক কমে গেছে। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কয়লার সংকট ও শ্রমিক সংকটের কারণে তার মতো অনেক কামারই আর আগের মতো কাজের অর্ডার পান না। কামারের হাতুড়ির টুং টাং শব্দ আজ অনেকটাই স্তব্ধ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, কোরবান ঈদের মাসে একটু ব্যস্ততা বাড়ে। কিন্তু এক মাসে ব্যস্ততা বাড়লেও বাকি ১১ মাস বসে কাটাতে হয়৷ তখন আর তেমন কাজ থাকে না। একসময় কামারশালায় ঢুকলেই চোখে পড়ত লাল হয়ে যাওয়া লোহার টুকরো পেটানোর দৃশ্য, হাতুড়ির শব্দে মুখর থাকত চারপাশ। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই চিত্র এখন বিরল। বর্তমান সময়ে ঈদুল আজহায় কিছুটা কাজ থাকলেও বাকি সময়টা অলসভাবে কাটাতে হয় পলাশ কর্মকারের মতো ফেনী শহরের অন্য কামারদের।
সরেজমিনে শহরের কয়েকটি কামারশালা ঘুরে দেখা যায়, হাতে গোনা কয়েকটি কামারশালাই এখন সচল আছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও কয়লার সংকটে পড়ে পণ্য তৈরি ব্যয় বেড়ে গেছে। উপরন্তু আধুনিক মেশিনে তৈরি চকচকে দা-বঁটির দাপটে হাতে বানানো পণ্যের চাহিদা অনেক কমে গেছে।
আরও পড়ুন: ১০ দিনের যুক্তরাষ্ট্র সফরে এমআইটি, হার্ভার্ডসহ যেসব জায়গায় যাবেন নটরডেম শিক্ষার্থীরা
কামারদের দেওয়া তথ্যমতে, একসময়ের জমজমাট কামারশিল্প এখন ফেনী শহরে সংকুচিত হয়ে আছে মাত্র ৪০টির মতো দোকান। শহরের মহিপাল, লালপোল, সহদেবপুর, মাস্টারপাড়া, পাঁছগাছিয়া, বারাহিপুর ও খাজুরিয়া সড়কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এসব কামারশালা। এ পেশার সঙ্গে শহরে এখনো জড়িত রয়েছেন ৫০ জনের মতো কামারশিল্পী। তবে এ পেশার জড়িত অনেকেই ঝুঁকছেন অন্য পেশায়।
হরিদাস নামে এক কামার শিল্পী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এ কাজ করে এখন প্রতিদিনের দোকান ভাড়া ও খাবারের খরচ বের করাটাই সম্ভব হচ্ছে না। দু-তিন বছর আগেও এক বস্তা কয়লার দাম ছিল ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। এখন সেই এক বস্তা কয়লার দাম হয়েছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। লোহার দামও কেজিতে বহু টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার অনেক আত্মীয় এই কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, এখন আর নেই। সবাই অন্য পেশায় চলে গেছেন।’
শহরের খাজুরিয়ায় কামাশালায় কাজ করছেন সুকেন কর্মকার নামের আরেক কামারশিল্পী। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় রেডিমেড আধুনিক যন্ত্রপাতির চাহিদার বৃদ্ধির কারণে আমাদের তৈরি লোহার জিনিসপত্রের চাহিদা আগের তুলনায় অনেকাংশে কমে গেছে। ফলে কামারশিল্পের সাথে জড়িতদের সংখ্যাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। তবে অনেকেই কোনো উপায় না পেয়ে তাদের পৈতৃক এ পেশাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।’
নারায়ণ কর্মকার নামের একই কামারশালার আরেক কামারশিল্পী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আগে অনেক ক্রেতা ছিল, কিন্তু এখন ক্রেতারা মার্কেটের আধুনিক মেশিনের সাহায্যে তৈরি দা-ছুরি বেশি কিনছেন। ফলে আগের মতো অর্ডার পাই না। আমরা কোনো রকম এই পেশাকে টিকিয়ে রেখেছি। আমাদের পরের প্রজন্ম এই পেশাকে টিকাতে পারবে না।’
আরও পড়ুন: সরকার ৩৩ প্রকল্পের ব্যয় কমালো ৪৬ হাজার কোটি টাকা
রঘুনাথ নামের শহরের পাঁছগাছিয়ার আরেক কামারশিল্পী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমার পরিবার থেকে এই কাজটা চলছে, তাই আমি এখনো এই পেশায় আছি। এখন বাজারে আধুনিক পণ্য বেশি আসায় আমাদের পণ্যের বিক্রি কমে গেছে। ছোটবেলায় আমি দেখেছি, আমার বাবা আর চাচারা ঈদের সময় খুব ব্যস্ত থাকতেন। তারা দিনরাত পরিশ্রম করেও গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করতে পারতেন না। কিন্তু এখন আধুনিক পণ্য সহজে পাওয়া যায়, তাই আমাদের ব্যবসায় অনেকটাই ক্ষতি হয়েছে। আমার অনেক সঙ্গী কামার এখন অন্য কাজ করছেন, কেউ কেউ নতুন কিছু ব্যবসায় হাত দিয়েছেন।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কামারশিল্পটি রক্ষায় সরকার উদ্যোগ না নিলে এই প্রাচীন পেশাটি অচিরেই বিলুপ্তির পথে চলে যাবে।
এদিকে কামারদের এ পেশা টিকিয়ে রাখতে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান শহর সমাজসেবা অফিসার শাহ কায়সার মাহমুদ। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কামারশিল্পটি একটি পেশা। এখানে সরাসরি ভাতা দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, এই পেশার মাধ্যমে কামাররা আয়-রোজগার করতে সক্ষম। তবে প্রান্তিক পেশাজীবীদের জীবনমান উন্নয়নে নেওয়া প্রকল্পের আওতায় কামারদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কারণ, কামার পেশাটি সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ে পড়ে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কামারশিল্পীরা আরও আধুনিক ও লাভজনকভাবে এই পেশাকে চালিয়ে যেতে পারবেন।