২৩১ দিনেই ববি উপাচার্যের পদ হারান শুচিতা শরমিন, পেছনে যত কারণ

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিন
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিন © সম্পাদিত

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) সাবেক উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিন। উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়া পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টি রীতিমতো খবরের শিরোনাম হয়ে উঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম উপাচার্য হিসেবে গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের এ অধ্যাপক। আট মাস  ১৭ দিনের মাথায় গত ১৩মে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাকে অপসারণ করে। এতে দায়িত্ব পাওয়ার মাত্র ২৩১ দিনের মাথায় বিদায় নিতে হয় তাকে।

ড. শুচিতা শরমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্কিত সাবেক রেজিস্ট্রার মো.মনিরুল ইসলামকে গত ৩০ জানুয়ারি স্বপদে বহাল রাখেন। সাবেক এ উপাচার্য ৬ ফেব্রুয়ারি ৪৯তম অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সভায় দুজন শিক্ষককে নিয়মবহির্ভূতভাবে সিন্ডিকেট সদস্য থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।  তারা হলেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফরহাদ উদ্দীন ও সমাজকর্ম বিভাগের প্রভাষক মোস্তাকিম মিয়া। এ ধরনের নানান কারণে বিতর্কিত হয়ে পড়েন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম রাব্বানী গত ৫ ফেব্রুয়ারি একটি নোটিশে ৯ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় অ্যাকাডেমিক অগ্রগতি নিয়ে সকল বিভাগের চেয়ারম্যানদের নিয়ে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে জানান। সাবেক উপাচার্য ৬ ফেব্রুয়ারি এক নোটিশে সভায় অংশগ্রহণ না করার জন্য বিভাগীয় চেয়ারম্যানদেরকে আহবান জানান। সেদিন সাবেক উপ-উপাচার্য ও উপাচার্যের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরকার পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তোলে।

১৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে উপাচার্যের বাসভবনে পূর্বনির্ধারিত সিন্ডিকেটের জরুরি সভা ডাকলে তা বাতিলের দাবিতে তার বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। সেদিন উপাচার্য বাসভবনের ফটক ভেঙে ভেতরে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা রেজিস্ট্রারের অপসারণের ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন এবং দুই শিক্ষককে সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থার কথা বলেন।

পরেরদিন শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার সানোয়ার পারভেজ বাদী হয়ে ১৭ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ২৫ জনের বিরুদ্ধে বন্দর থানায় অভিযোগ করেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদেরকে ফ্যাসিস্ট বলে মন্তব্য করেন সাবেক উপাচার্য। 

১৩ এপ্রিল সাবেক উপাচার্যের একটি নোটিশে অধ্যাপক মুহসিন উদ্দিনের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারের দোসরসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তাকে সিন্ডিকেট ও অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যপদ থেকে অব্যাহতি দেন। তার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ১৭ এপ্রিল বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় কর্মসূচি পালিত করেন।

২৭ এপ্রিল সাবেক রেজিস্ট্রার অপসারণের দাবিতে রেজিস্ট্রারের কুশপুত্তলিকা দাহ করেন শিক্ষার্থীরা, ওই দিন শিক্ষার্থীরা ১২ঘণ্টার আল্টিমেটামসহ রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে তাল ঝুলিয়ে দেন। এ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ এপ্রিল উপাচার্য নিজে বন্দর থানার ওসিকে ফোন করে ১০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। রেজিস্ট্রারের অপসারণ ও মামলা প্রত্যাহার নিয়ে ২৯ এপ্রিল শিক্ষার্থীরা ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেন। পরবর্তীতে ফের ১২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে তারা রাস্তা ছেড়ে দেন।

৩০ এপ্রিল শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে মৃত ঘোষণা করে কফিন মিছিল করেন। উপাচার্যের কাছে চিকিৎসার জন্য আর্থিক সাহায্যের আবেদন করেও পাননি ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী জেবুন্নেসা হক জিমি। পরবর্তীতে তার মৃত্যুতে চলমান আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ৩ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের নীচ তলায় প্রেস ব্রিফিংয়ে পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করেন শিক্ষার্থীরা। 

আরও পড়ুন: ববির নবনিযুক্ত উপাচার্যের কাছে শিক্ষার্থীদের ৮২ দাবি

৪ মে ১১টায় চলমান আন্দোলনসহ সামগ্রিক বিষয় নিয়ে উপাচার্য সংবাদ সম্মেলনে রেজিস্ট্রারকে অপসারণে কথা এবং ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খুঁজে বের করার জন্য এক সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করার কথা বলেন। সাবেক এই উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ৫মে শিক্ষার্থীরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুয়ায় শিক্ষার্থীরা ৬ মে প্রশাসনিক কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন। 

এর মধ্যে উপাচার্যে স্বাক্ষরের অভাবে তিন মাস যাবৎ ঝুলে আছে পরীক্ষা, এমন একটি সংবাদ শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে পরে। তাতে শিক্ষার্থীরা আরও ফুঁসে উঠেন। ৮ মে  শিক্ষকরা চলমান আন্দোলনে একাত্মতা পোষণ করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে শামিল হন। তার মধ্যে শিক্ষার্থীদের একদফা দাবিকে সমর্থন দিয়ে সহকারী প্রক্টরসহ প্রশাসনিক বিভিন্ন কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন।

পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা ১২ মে অ্যাকাডেমিক শাটডাউন কর্মসূচি পালন করেন। এরপর  রাত ১১টা থেকে ১১ জন শিক্ষার্থী আমরণ অনশন কর্মসূচিতে যোগ দেন। অনশনরত অবস্থায় এক দফা দাবিতে ১৩ মে বিকেল ৫টায় শিক্ষার্থীরা ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়কে অবস্থান নেন। ১৩ মে রাতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন মুখে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষকে অপসারণ করা হয়। 

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ তৌফিক আলম।  তিনি ১৫ মে যোগদান করেন। এরপর সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘যেহেতু সরকার আমাকে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে নিয়োগ দিয়েছে, তাই আমি আমার সাধ্যমতো সর্বোচ্চ চেষ্টা করব বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে।’ গত বুধবার (২৮ মে) তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ‘জুলাই-৩৬’ স্মৃতিফলক নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন।