৩০ আগস্ট ২০২২, ১৬:০৩

৪৫ বছর ধরে স্বামীকে খুঁজছেন নূরন্নাহার

স্বামীকে খুঁজছেন নূরন্নাহার  © সংগৃহীত

১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের প্রহসনমূলক বিচারের শাস্তি পাওয়া, ফাঁসি ও গুম হওয়া সেনা এবং বিমানবাহিনী কর্মকর্তাদের স্বজনরা মিলিত হয়েছেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। আন্তর্জাতিক গুম দিবসে তাদের দাবি, নিখোঁজ স্বজনের খোঁজ কিংবা কবরের ঠিকানা। জিয়াউর রহমানকে খুনি আখ্যা দিয়ে সেই প্রহসনের মার্শাল কোর্টের বিচারের জন্য মরণোত্তর শাস্তিও দাবি করেছেন তারা।

১৯৭৭ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত আলোচনা সভায় স্বজনরা মিলিত হন।

সেখানে ১৯৭৭ সালে গুম হয়ে যাওয়া সার্জেন্ট দেলওয়ার হোসেনের স্ত্রী নূরন্নাহার বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, দেলওয়ার বিমান বাহিনীতে চাকরি করত। আমি ৪৫ বছর ধরে দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। আমি জানি না আমার স্বামীর অপরাধ কি ছিল। তাকে কি ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, নাকি লাশ গুম করা হয়েছিল, নাকি নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমার বয়স আজ ৭১ বছর। আজও আমি এসব প্রশ্নের উত্তর পাইনি।

তিনি বলেন, আমার স্বামী কোথায়? আমার দেড় বছরের বাচ্চা নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। কারো মুখে শুনতে পাইনি, স্বামীকে কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক স্ত্রীই চায় তার স্বামীর ভালবাসা। অথচ আমি ২১ বছর বয়সেই স্বামীকে হারিয়েছি। জীবনে ভালোবাসা পাইনি। ভালবাসা তো দূরের কথা লাশটাও দেখতে পাইনি। বিমান বাহিনীতে চাকরির খবরে সবাই খুশি ছিল। স্ত্রী হিসেবে আমি গর্ব করতাম। জীবনে কতো কষ্ট করেছি, পাশে কাউকে পাইনি।

আজ ৪৫ বছর পর এখানে দাঁড়াতে পেরেছি। কুর্মিটোলা মেসে, কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়েছি। ঢুকতেও পারিনি। আত্মীয়-স্বজনরা বলেছে, ঘরের মেয়ে ঘরে আয়। স্বামীর খবর নেই, লাশটাও পাইনি, এ অবস্থায় স্ত্রী হয়ে কীভাবে আমি ঘরে ফিরব? 

জিয়ার এক মিনিটের বিচারে ফাঁসি হওয়া বিমান বাহিনীর কর্পোরাল মোবারক আলীর মেয়ে মমতাজ বেগম বলেন, আমার বয়স তখন ছিল মাত্র ছয় মাস। তখনই বাবার ফাঁসি দেয় খুনি জিয়া। কিন্তু বাবার লাশ পরিবারকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। এরপর আমার জীবনটা কেমন ছিল তা বলার মতো নয়। অনেক কষ্ট করেছি। বাবার মৃত্যুর পর একটু ভালোবাসা আমি পাইনি। খুনি জিয়া আমাকে এমন শাস্তি দিয়েছিল। বাবা ডাকতে পারিনি, বাবার ভালবাসাও পাইনি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ বাবা হত্যার বিচার যেন পাই।

জিয়ার প্রহসনের বিচারে ফাঁসি দণ্ডপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট আফাজ উদ্দিন ভূঁইয়ার সন্তান মাকসুদুল আলম বলেন, আমার বাবা কোথায় আমি জানি না। আমার বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আটকে রাখে। সেখান থেকে চিঠি আসে। দাদা দেখতে গেলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। আমার মা আজও বেঁচে আছেন। আত্মীয়ের বাড়ি ঘুরে বেড়িয়েছি। শত শত স্বামী হারা মায়ের কান্না কেউ দেখেনি, কেউ খোঁজ রাখেনি। যেদিন বাবাকে ধরে নিয়ে যায় সেই রাতেই মায়ের প্রসব বেদনা উঠে। আমার ছোট ভাইয়ের জন্য হয়। সেই যে বাবা গেল আর ফেরেনি। আমি আজ শুধু জানতে চাই, বাবার কবরটা কোথায়, জিয়ারত করতে চাই।

তিনি বলেন, হতভাগা বাবা হত্যার খুনি জিয়ার বিচারসহ শহীদ হিসেবে সম্মানিত করা, সন্তান, পরিবারকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। আমি মা হয়ত মারা যেতে পারি, কিন্তু দুই ভাই ও বাবা হত্যার বিচার যেন দেখে যেতে পারি।

গুমের শিকার সার্জেন্ট মোশরাফুল আলমের মেয়ে মাকসুদা পারভীন বলেন, সার্জেন্ট মোশরাফুল আলম কি করেছিল? কি ছিল তার অপরাধ তা জানতে পারিনি আজও। বিমান বাহিনীতে চাকরি করতেন বাবা। তার স্বপ্ন ছিল আমাকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে দেবে? কিন্তু বাবা আর ফেরেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনি তো আপনার বাবার কবর জিয়ারত করতে পারেন, আমরা তো পারি না। বাবা বেঁচে নাকি মরে গেছেন জানি না। 

জিয়ার শাসনামলে মার্শাল কোর্টের নামে ২০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ওয়ারেন্ট অফিসার হাবিবুর রহমান বলেন, আমি বীর মুক্তিযোদ্ধা। আন্তর্জাতিক গুম দিবসে আমি এখানে দাঁড়িয়েছি। জিয়া ছিলেন সিআইয়ের এজেন্ট। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে খুন করার প্রধান নায়ক। ১৫ আগস্ট, ২ নভেম্বর, ৩ নভেম্বর একই সূত্রে গাঁথা। 

আরও পড়ুন : ফল পুনর্নিরীক্ষার আবেদনের সুযোগ পাচ্ছেন গুচ্ছ ভর্তিচ্ছুরা

তিনি বলেন, জিয়ার মরণোত্তর বিচার করে খুনি হিসেবে বিচার করা হোক। আমরা যদি দোষী হই তাহলে আমাদের আবারও বিচার করেন, ফাঁসি দেন। তবে নির্দোষ হলে আমাদের সুযোগ সুবিধা দেন, চাকরি ফিরিয়ে দিন।

জিয়ার মার্শাল কোর্টে চার বছরের সাজাপ্রাপ্ত সার্জেন্ট এমএম মজিদ বলেন, দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের খুন করতে নানা বাহানার আশ্রয় নিয়েছিলেন মেজর জিয়া। যাদের হত্যা করা হলো, শাস্তির নামে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল তাদের কথা শোনার লোকও ছিল না। ক্যান্টনমেন্টের কী হয়েছিল তা সাধারণ মানুষের জানার সুযোগ ছিল না।

অনুষ্ঠানে মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ বলেন, এ দিনে দুই থেকে তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধা, সামরিক বাহিনীর সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়েছিল বিনা বিচারে, বিচারের নামে প্রহসন করে। মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আগেই দণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। কোনো নিয়মনীতি তোয়াক্কা করা হয়নি। ৪৫ বছর আগের ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের কান্না শুনে বিহ্বলিত হচ্ছি।

অনুষ্ঠানে মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ বলেন, এ দিনে দুই থেকে তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধা, সামরিক বাহিনীর সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়েছিল বিনা বিচারে, বিচারের নামে প্রহসন করে। মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আগেই দণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। কোনো নিয়মনীতি তোয়াক্কা করা হয়নি। ৪৫ বছর আগের ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের কান্না শুনে বিহ্বলিত হচ্ছি।

তিনি বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে আজ এখানে এসেছি। মুক্তিযুদ্ধে অনেক হতাহত দেখেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের আকুতি আমার কাছে পরিচিত। মুক্তিযোদ্ধাদের কথাবার্তা, দাবি-দাওয়ার কথা শুনতাম। সব আক্ষেপকে ছাপিয়ে তারা বিচার চান। বিচার না হলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মা শান্তি পাবে না। 

এ সময় জিয়ার প্রহসনের বিচারে নির্মমভাবে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ও চাকরিচ্যুত সেনা ও বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে ৭ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়।  

১. ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্য যারা খুনি জিয়ার সামরিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে অন্যায়ভাবে ফাঁসি, কারাদণ্ড ও চাকরিচ্যুত হয়েছেন তাদের নির্দোষ ঘোষণা করা।

২.  যারা খুনি জিয়ার সামরিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ফাঁসি, কারাদণ্ড ও চাকরিচ্যুত হয়েছেন তাদের প্রত্যেককে স্ব-স্ব পদে সর্বোচ্চ র‍্যাংকে পদোন্নতি দেখিয়ে বর্তমান স্কেলে বেতন-ভাতা ও পেনশনসহ সরকারি সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা প্রদান করা।

৩. খুনি জিয়ার সামরিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সেনা ও বিমান বাহিনী সদস্যদের অন্যায়ভাবে ফাঁসি হয়েছে তাদের শহীদ হিসাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা এবং কবরস্থান চিহ্নিত করে স্মৃতি স্তম্ভ তৈরি করা।

৪.  সেই সব সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের পুনর্বাসিত করার লক্ষ্যে তাদের পোষ্যদের যোগ্যতা অনুসারে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ প্রদান করা।

৫. সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্য যারা অন্যায়ভাবে ফাঁসি, কারাদণ্ড ও চাকরিচ্যুত হয়েছেন তাদের তালিকা প্রকাশ করা।

৬.  অন্যায়ভাবে ফাঁসি, কারাদণ্ড ও চাকরিচ্যুত করার অপরাধে খুনি জেনারেল জিয়ার মরণোত্তর বিচার নিশ্চিত করা। 

৭.  ষড়যন্ত্রকারী খুনি জিয়ার তথাকথিত কবর জাতীয় সংসদ এলাকা থেকে অপসারণ করতে হবে।