০২ জুলাই ২০২২, ০৮:৩১

ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কে টানাপোড়েনের ঘটনা ঘটছে কেন

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক  © সংগৃহীত

বাংলাদেশের অনেক শিক্ষকের ধারণা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যথাযথ অনুশাসনের সুযোগ না থাকার পাশাপাশি অবাধে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ এবং পারিবারিক মূল্যবোধ ও বন্ধন দুর্বল হওয়ার কারণেই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে।

ঢাকার পল্লবীর একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক খোদেজা বেগম বলছেন, সব যেন কেমন হয়ে গেছে। স্কুলে বাচ্চাদের কোন ভাবেই এখন আর কন্ট্রোল করা যায় না। আমি জানিনা এর দায় কার।

বাংলাদেশে সম্প্রতি হামলায় একজন শিক্ষকের মৃত্যুর পর একজন শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। এর আগেও ক্লাস রুমে শিক্ষকের কথা রেকর্ড করে বাইরে এনে ধর্মীয় সহিংসতা সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছিলো একদল শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধেই। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের হেনস্তার শিকার হয়েছেন।

কয়েক বছর আগে ঢাকার কাছে নারায়ণগঞ্জে শিক্ষার্থী ও স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধির উপস্থিতিতে কান ধরিয়ে ওঠ-বস করতে বাধ্য করা হয়েছিল একজন শিক্ষককে, যা সারাদেশে শোরগোল তুলেছিল।

শিক্ষা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান বলছেন সব ক্ষেত্রে সহনশীলতা আর নৈতিক মূল্যবোধের অভাব বড় একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরও পড়ুন: যেসব কারণে স্থগিত হলো জবি ছাত্রলীগের কমিটি

তিনি বলেন, তবে এই টানাপোড়েনের জন্য কোন এক পক্ষকে দায়ী করা ঠিক হবে না। এখানে নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক দরকার যারা শিক্ষার্থীদের সামনে রোল মডেল হয়ে উঠবেন। শিক্ষকদেরও যেমন শিক্ষার্থীদের অকৃত্রিম ভালোবাসতে হবে তেমনি ছাত্রদেরও তাদের শিক্ষকদের মানতে হবে,

অনুশাসনের অভাব কতটা দায়ী
বাংলাদেশে একসময় স্কুল পর্যায়ে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শাসন করতেন যা ছিলো নিয়মিত সাধারণ ঘটনা এবং অনেক অভিভাবকও শিক্ষকদের কাছে তাদের সন্তানদের শাসন করার অনুরোধ করতেন।

আর এ শাসন করার ক্ষেত্রে অনেক সময় শিক্ষকরা শারীরিক শাস্তি দিতেন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এ ধরনের শাস্তি দেবার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

শিক্ষকরা অনেকে এখন বলছেন শাস্তি তো নয়ই শিক্ষার্থীকে ধমক দিলেও অনেক সময় অভিভাবকরা স্কুলে এসে উচ্চবাচ্য করেন বলে অনেক শিক্ষকই এগুলো সচেতনভাবে এড়িয়ে যান।

কুষ্টিয়ার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জেব উন নিসা বলছেন অনেক শিক্ষক হয়তো শাস্তির নামে বাড়াবাড়ি করেছেন, কিন্তু এখন শাসন একেবারেই না থাকায় ‘অনুশোচনা’ বলে একটি বিষয় যে আছে সেটিই অনেক শিক্ষার্থী জানেইনা।

তার মতে বরং সব শিক্ষার্থী জানে যে তাদের কোন শিক্ষক সামান্য জোরে কিছু বললেও তারা বাড়িতে গিয়ে শিক্ষকের নামে নালিশ করলে উল্টো শিক্ষকেরই সমস্যা হবে।

অনেক অভিভাবক একেবারেই ছোট শিশুদের হাতে মোবাইল ও মোটর সাইকেল দিচ্ছেন-যা তাদের ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে এবং এর প্রভাব পড়ছে ক্লাসরুমেও বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশে শিক্ষা নীতি প্রণয়ন ও কারিকুলাম প্রণয়নসহ বেশ কিছু উদ্যোগের সাথে জড়িত থাকা শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ছিদ্দিকুর রহমান বলছেন দায়টা শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, বরং যে শিক্ষক ছাত্রদের ভালোবাসেন, সহায়তা করেন এবং নিবেদিত প্রাণ হয়ে তাদের খোঁজ খবর রাখেন বা নিজের ছেলে মেয়ের মতো যত্ন করেন- তাদের সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করে না বলেই মনে করেন তিনি।

তিনি জানান বাংলাদেশের পাঠ্যক্রমে একসময় শুধু জ্ঞান অর্জনকে গুরুত্ব দেয়া হতো। কিন্তু প্রায় এক দশক আগে থেকে এটি ছাড়াও ছাত্রদের নৈতিক ও মানবিক গুণাবলী, সমাজ ও দেশকে ভালোবাসা, ভালোকে গ্রহণ ও খারাপকে বর্জন— এগুলো আনার চেষ্টা করা হয়েছে।

এগুলো কারিকুলামে আনা হলেও ক্লাস রুমে সেগুলো ঠিক মতো নেয়া যায়নি শিক্ষকদের প্রস্তুতিহীনতার কারণেই, বলছিলেন তিনি।

সে কারণে কাউকে শিক্ষক হিসেবে নেয়ার আগে তার ব্যক্তিত্ব কেমন ও শিক্ষাদানে তার আগ্রহ কতটা আছে সেটাও দেখা দরকার বলে মনে করেন তিনি। একই সাথে তাদের তেমন সুযোগ সুবিধাও দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের সাথে নিজের সম্পর্ক উন্নয়নে শিক্ষককে নিজের ব্যবহারে পরিবর্তন আনতে হবে। নিজেকে (রোল) মডেল হয়ে উঠতে হবে। কিন্তু এগুলো এখনো আমরা ক্লাসে নিতে পারিনি।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে এখন শিক্ষক নিয়োগ একটি পরীক্ষার মাধ্যমেও হলেও এগুলোতে মানসম্পন্ন শিক্ষক কতটা নিয়োগ হয় তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আবার অনেক শিক্ষক নিজেরা রাজনীতিসহ নানা কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখছেন বলেও অভিযোগ ওঠে। ।

এমনকি নিজ প্রতিষ্ঠানে ভালো সুযোগ নিতে অনেকের বিরুদ্ধে ছাত্রদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের এবং অন্য শিক্ষকদের হেয় করার অভিযোগও পাওয়া যায়।

বরিশালের একজন অভিভাবক রফিকুল ইসলাম বলছেন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ তো বটেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের অনেক শিক্ষক এখন শিক্ষাদানের চেয়ে রাজনীতিসহ অন্যও কাজে বেশি ব্যস্ত থাকেন।

তাদের মধ্যেই পরমত-সহিষ্ণুতা বা সহনশীলতা খুব একটা দেখা যায় না। বিশেষ করে উপজেলা বা প্রত্যন্ত এলাকায় আগের মতো পণ্ডিত ও নিবেদিত-প্রাণ শিক্ষক নেই বলেই এখনকার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন এই অভিভাবক।

অথচ এক সময় শিক্ষক পরিচয় পেলেই তাকে সম্মান করতো সবাই। এমনকি এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় গেলেও শিক্ষকরা আলাদা সম্মান পেতেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সূত্র- বিবিসি বাংলা