যে কারণে টিপ পরেন বাঙালি নারীরা
বাংলাদেশে একজন নারীকে টিপ পরার কারণে পুলিশের একজন কনস্টেবল হেনস্থা করেছেন এমন অভিযোগ ওঠার পর ওই পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। শনিবারের ওই ঘটনা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়েছে। অসংখ্য নারী নিজেদের টিপ পরা ছবি পোস্ট করে হয়রানির নিন্দা জানিয়েছেন। এমনকি বাংলাদেশের সংসদ সদস্য সুবর্ণা মোস্তফা ওই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে সংসদে বক্তব্য রেখেছেন।
বাংলাদেশ বা বাঙালিদের মধ্যে অথবা দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের মধ্যে টিপ পরা নতুন কিছু নয়। কিন্তু টিপ পরার এই রীতি চালু হলো কীভাবে? বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলছেন, হাজার হাজার বছর ধরেই বিশ্বের অনেক দেশের নারীদের মধ্যে টিপ পরার রীতি চালু রয়েছে।
তিনি বলছেন, এটা শুধুমাত্র বাঙালি জাতির বা হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন ব্যাপার ছিল না। আঠারো শতকে তো টিপের ব্যবহার খুব সাধারণ হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে তখনকার ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বার্মা, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়ার নারীরা টিপ ব্যবহার করতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলছেন, সেই সময় সব ধর্মের নারীদের মধ্যেই টিপ পরার প্রচলন ছিল। তখনকার মুসলমানদের মধ্যেও টিপ ব্যবহারের প্রচলন ছিল। তার মতে, ইসলামেও টিপ পরা নিষিদ্ধ করা হয়নি।
আরও পড়ুন- পাঠ্যবইয়ে পণপ্রথার উপকারিতা, কুৎসিত মেয়েদেরও বিয়ে দেয়া যায়!
তিনি বলছেন, টিপকে বরাবরই অঙ্গসজ্জার একটি অনুষঙ্গ হিসাবে দেখা হয়েছে। বিশেষ করে অনুষ্ঠানে যাওয়া, বিশেষ সাজগোজ করার সময় টিপকে শেষ উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করতো নারীরা। সব ধর্ম, সব শ্রেণির নারীদের মধ্যেই এই রীতি চালু ছিল।
বরিশালের বাসিন্দা তানিয়া ইয়াসমিন রোজা রাখেন, প্রায় নিয়মিত নামাজ পড়েন। কিন্তু তিনি টিপ পরতেও পছন্দ করেন। তিনি বলছেন, যখন শাড়ি বা কোন রঙিন কাপড় পরি, একটা টিপ পরলে পুরো চেহারাটাই যেন বদলে যায়। নিজের কাছেই ভালো লাগে। তাই বেশিরভাগ সময়েই টিপ পরা হয়। ইসরাত সুলতানা বলেছেন, টিপ পরতে ভালো লাগে। শাড়ি বা কামিজের সঙ্গে টিপ পরলে অন্যরকম সৌন্দর্য ফুটে ওঠে চেহারায়।
ভারতীয় উপমহাদেশে পুরুষ বা নারীদের শ্রেণি বা অবস্থান বোঝাতে টিপের ব্যবহার হতো বলে লিখেছেন জিয়াউল হক। ইতিহাসের অলিগলি বইয়ে জিয়াউল হক টিপ প্রসঙ্গে পুরো একটি অধ্যায় লিখেছেন- কপালে টিপ বাঙালি তথা আধুনিক বাঙালি নারীর প্রাত্যহিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হচ্ছে। স্থান কাল আর পাত্র, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ নারীরা পুরুষের তুলনায় সৌন্দর্য চর্চা করেন বেশি।...বাঙালি নারীদের ক্ষেত্রে কপালে বড় একটি টিপ দেয়া, তার সৌন্দর্য চর্চার অন্যতম এক অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। পাক-ভারত উপমহাদেশে এটা প্রায় প্রতিটি নারীর জন্যই একরকম বাধ্যতামূলক বিষয় যেন।
আরও পড়ুন- বিসিএসে স্বপ্নভঙ্গ, নন ক্যাডার পেয়েও হতাশ নন তারা
তিনি লিখেছেন, আমাদের সমাজে এ প্রথাটা এলো কোথা হতে? এর উৎস খুঁজতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়, বাল্মীকি যুগে। এর বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, এই রীতি চালু হয়েছে প্রায় ৯৫০০ থেকে ১১৫০০ বছর আগে থেকে, যাকে বাল্মীকি যুগ বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। সেখানে তিনি লিখেছেন, সেই সময় তৎকালীন হিন্দু সমাজে জাতিভেদ বা শ্রেণিভেদ প্রবল ছিল।
ব্রাহ্মণরা উচ্চ শ্রেণির, তারা ঈশ্বরের অতি নিকটজন, পূত-পবিত্র। পবিত্রতার প্রতীক হিসাবে তারা কপালে সাদা তিলক (চন্দন তিলক) দিতেন। এখনও দেন। ক্ষৈত্রিয় হলো যোদ্ধা শ্রেণি, তাদেরকে বীর হিসাবে গণ্য করা হতো। ক্ষিপ্ততা, হিংস্রতা ও সাহসের প্রতীক হিসাবে তারা কপালে লাল টিপ দিতো। বৈশ্যয় শ্রেণির লোকজন হলো ব্যবসায়ী, পেশাই হলো ব্যবসা। এরা কপালে হলুদ রঙের টিপ ব্যবহার করতো। আর সমাজে সবচেয়ে নিচু লোকজন হলো শূদ্ররা। ....তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল কালো রঙের টিপ। তারা কপালে কালো টিপ ব্যবহার করতে বাধ্য হতো।
সূত্র: বিবিসি বাংলা