শৈশবেই স্মৃতি আটকে যায় হাওরের শিক্ষার্থীদের
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২১, ০৯:৩৬ AM , আপডেট: ১৩ জুন ২০২১, ০৯:৩৬ AM
গত বছরের ২২ জুন সকালে স্কুলে বিস্কুট বিতরণ হবে জেনে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার পাইকুরাটি ইউনিয়নের চকিয়াচাপুর গ্রাম থেকে প্রথম শ্রেণিতে সদ্য ভর্তি হওয়া সুমাইয়া আক্তারসহ ৭-৮ জন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা দেয় একটি ছোট ডিঙি নৌকায় করে। মাঝরাস্তায় আফালের কবলে পড়ে নৌকা ডুবে যায়। অন্যরা কোনোমতে সাঁতরে পাড়ে উঠতে পারলেও মারা যায় ৬ বছর বয়সী শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার।
দেশের হাওর অঞ্চলগুলোতে স্কুলে যেতে গিয়ে এভাবেই অনেক শিশুর স্মৃতি শৈশবেই আটকে যায় নিদারুণ ভাগ্য বিড়ম্বনায়। এখানে শিক্ষার্থীদের দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা, সচেতনতার অভাব, দুর্গমতা, বাল্যবিয়েসহ নানা প্রতিকূলতা ছাড়াও লড়াই করতে হয় প্রকৃতির সঙ্গে। এসব যুদ্ধ শেষে খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী মাড়াতে পারে উচ্চশিক্ষার চৌকাঠ। এসব কারণে দেশে শিক্ষার হার ৭১ শতাংশ হলেও হাওর অঞ্চলে এই হারটি ২০ থেকে ৪০ শতাংশের বেশি নয়।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের গত বছরের তথ্য অনুযায়ী, হাওর অধ্যুষিত উপজেলাগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন শিক্ষার হার সুনামগঞ্জের শাল্লায়, মাত্র ২০ দশমিক ১০ শতাংশ। ৪০ দশমিক ৩০ শতাংশ শিক্ষার হার নিয়ে সর্বোচ্চ স্থানে আছে একই জেলার ধর্মপাশা। হাওর থাকা অন্য উপজেলাগুলোতেও শিক্ষার হার ২০ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি নয়।
ইউনিসেফের ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী হাওর বেষ্টিত সুনামগঞ্জ জেলায় শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার ৩৭ শতাংশ। এছাড়াও জেলায় হাওরের দুর্গম অঞ্চলে স্কুল শিক্ষকেরাও যথাসময়ে স্কুলে পৌঁছাতে পারেন না। পাশাপাশি অধিকাংশ বিদ্যালয়ের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নেই। বর্ষায় দ্বীপ গ্রামের এসব বিদ্যালয়ে যেতে বেগ পোহাতে হয় শিক্ষকদের।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের ২০১৭ সালে প্রকাশিত হওয়া 'বিদ্যালয় সম্পর্কিত তথ্য' পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে এক হাজার ৪৬৫টি। জেলার ১৬৬টি গ্রাম এখনও বিদ্যালয়হীন। প্রায় ৬০০ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই। সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে ৩৯৩টি। ঝড়-তুফানে ভেঙে পড়ায় এবং বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় জেলার সাতটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাস করতে হয় উন্মুক্ত স্থানে। ১৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন পরিত্যক্ত। ১২৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন অতিঝুঁকিপূর্ণ।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন, 'হাওর অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক কম। যাতায়াত ব্যবস্থা দুর্গম ও পানিনির্ভর হওয়ার কারণে এ অঞ্চলে আরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন ছিল।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঝুঁকিমুক্তভাবে আসা-যাওয়া করা এবং নিকটবর্তী স্থানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা না গেলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) চতুর্থ অভীষ্ট লক্ষ্যে যে অন্তর্ভুক্তিমূলক গুণগত শিক্ষার কথা বলা হয়েছে সেটি হাওর অঞ্চলে অর্জন করা সম্ভব হবে না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'বর্ষাকালে শিক্ষার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্কুল-কলেজে যায়। অতীতে অনেক নৌ-দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীদের প্রাণ হারাতে দেখেছি আমরা। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আলাদাভাবে নৌকার ব্যবস্থা করার জন্য আমরা দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসছি। বর্ষাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াতের সমস্যার কারণে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে এবং শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখা সম্ভব হয় না।'