আর কখনো ক্লাসে ফিরবে না ১৫১ শিক্ষার্থী

খুলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শুধু থাকবে না ওরা
খুলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শুধু থাকবে না ওরা  © টিডিসি ফটো

করোনা সংক্রমণ কমলেই কিছুদিন পরই খুলে দেওয়া হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরপর সশরীরে চলবে ক্লাস-পরীক্ষা। করোনার প্রাদুর্ভাবে প্রায় দেড় বছর পর শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরবে। তারপর ক্লাস, আড্ডা, বন্ধুদের হুল্লোড়— যেন প্রাণ ফিরে পাবে সেই চিরচেনা জায়গাটি। বন্ধুকে কাছে পেয়ে সেকি উচ্ছ্বাসে মাতবে তারা।

তবে চিরচেনা সেই প্রতিষ্ঠানে আর ফেরা হবে না স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৫১ শিক্ষার্থীর। এরমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে ১০ শিক্ষার্থী। জানা গেছে, গত বছরের মার্চ থেকে দেশে করোনা সংক্রমণের পর  এসব শিক্ষার্থী পৃথিবী থেকে চিরবিদায় জানিয়েছেন।

করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় বিভিন্ন নেশা এবং মোবাইল ফোনের গেমে আসক্ত হয় শিক্ষার্থীরা। গত ১ জুন মুরছালিন নামে এক শিক্ষার্থীকে মোবাইলে গেম খেলতে নিষেধ করলে ৪ জুন সে আত্মহত্যা করে। সে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার সরকারি সোহাগপুর এসকে পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের চলতি বছরের এসএসসির পরীক্ষার্থী ছিল। এর পাঁচ দিন আগে একই ধরনের ঘটনায় অভিমান করে অতিরিক্ত গ্যাসের ট্যাবলেট খেয়ে মারা যায় উল্লাপাড়া উপজেলার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মো. রাফি।

এর আগে  ২৯ মে বাবা মায়ের সাথে অভিমান করে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী ফাতেমা আক্তার (১৭)।  এদিকে প্রেমঘটিত কারণে পরিবারের সঙ্গে মনোমালিন্য হলে গত ২ জানুয়ারি আত্মহত্যা করেন ফাবিহা সুহা নামে ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। গত ৩১ মে স্মার্টফোন নিয়ে মা-বোনের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে হতাশায় ভুগে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের শিক্ষার্থী ফারহানুজ্জামান রাকিন। গত ৭ জুন রাজধানীর কামরাঙ্গীর চরে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠায় পুষ্প আক্তার মনিকে (১৫) বকাঝকা করেন মা। অভিমানে ওই দিনই আত্মহত্যা করে দশম শ্রেণির এই ছাত্রী।

শুধু মুরছালিন, রাফি, ফাতেমা, ফাবিহা, রাকিন ও মনিই নয়, দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ১৫ মাসে অন্তত ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে ৭৩ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ৪২ জন বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী, ২৭ জন কলেজ শিক্ষার্থী ও ২৯ জন মাদরাসার শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের বেশির ভাগের বয়স ১২ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। গত বছরের ১৮ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর থেকে গত ৪ জুন পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসংক্রান্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ফলে আগামী দিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলেও আর ফেরা হবে না তাদের।

মনোচিকিৎসক ও গবেষকরা বলছেন, করোনাকালে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত জীবনের ওপর মানসিক চাপ বাড়ছে। পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা, পরিবারের শাসন, কোনো কিছু বায়না ধরে না পাওয়া, প্রেমঘটিত টানাপড়েন, আর্থিক সংকট, বিষণ্নতা ও একাকিত্বসহ ছোট ছোট সমস্যায়ও অনেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে তারা তুচ্ছ ঘটনায়ও আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করছে না।

তরুণদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেছেন। সংগঠনটির দাবি করোনাকালে আত্মহত্যার প্রবণতা প্রায় ৪৫ শতাংশ বেড়েছে। মোট আত্মহত্যার মধ্যে ৫৭ শতাংশ নারী এবং ৪৩ শতাংশ পুরুষ।

এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার ছেলে স্কুল পড়ে। দীর্ঘদিন ঘরবন্দি। এখন শাসন করতেও ভয় হয়। পত্রপত্রিকায় দেখি ছোট ছোট কারণেই অভিমান করে ছাত্র-ছাত্রীরা আত্মহত্যা করছে। তাই তাদের ভালো-মন্দের বিষয়ে পরিবারসহ বড়দের সবাইকে সচেতন হতে হবে।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল ওয়াহাব একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীরা ঘরে বন্দি, খেলাধুলা ও বন্ধু-বান্ধবের সান্নিধ্য তারা পাচ্ছে না। কারণ বন্ধু-বান্ধবের কাছে যা বলা যায়, তা তো আর মা-বাবার সঙ্গে বলা যায় না। সরকার অটো পাস দিচ্ছে, এ রকম করুণা তো অনেক শিক্ষার্থীর কাম্য নয়। এর সঙ্গে চারপাশ থেকে আত্মীয়-স্বজনসহ অন্যদের প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সংবাদ শুনছে; এসব কিছু মিলিয়ে অনেকের মধ্যে হতাশা ও বিষণ্নতা বেড়েছে। এসব কারণে কেউ কেউ আত্মহনন করছে।’

আব্দুল ওয়াহাব বলেন, ‘যদি কোনো অভিভাবক দেখেন তাঁদের সন্তানের আচরণ হঠাৎ অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে, তাহলে তাদের মনোবিজ্ঞানী বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে নিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া এ সময়ে অভিভাবকদের অন্যতম দায়িত্ব স্কুল-কলেজপড়ুয়া সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীরাও যদি মনে করেন তাঁরা নানা কারণে উদ্বিগ্ন ও বিষণ্নতার মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন, তাহলে নিজ দায়িত্বে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে কাউন্সেলিং নিলে আত্মত্যার পরিমাণ অনেকাংশে কমে আসবে।

রিলেটেড সংবাদ: 

প্রাণের ক্যাম্পাসে আর ফেরা হবে না ওদের

মোবাইল কিনে না দেয়ায় অভিমানে স্কুলছাত্রের আত্মহত্যা


সর্বশেষ সংবাদ