গত ৫ বছরে সড়কে ঝরেছে ৩৭ হাজার ১৭০ প্রাণ
- মোঃ রাকিবুল হাসান তামিম
- প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২০, ১১:২৯ AM , আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২০, ১২:১৪ PM
২০১৮ সালের ৩ এপ্রিল। রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের ডিগ্রীর শিক্ষার্থী রাজীব হোসেন যাত্রাবাড়ি থেকে ক্লাস করতে কলেজে আসার জন্য বিআরটিসির দোতলা বাসে চড়েন। বাসটি সার্ক ফোয়ারার কাছে পান্থকুঞ্জের পাশে সিগনালে থেমে ছিল। ঐসময় সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকা বিআরটিসির ঐ বাসটি ওভারটেক করতে স্বজন পরিবহন নামের একটি বাস দ্রুতগতিতে এসে দোতলা বাসের পাশের ফাঁকা দিয়ে ঢুকে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করে।
এসময় দুই বাসের রেষারেষিতে রাজীবের ডান হাত দোতলা বাসের সাথে লেগে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় রাজীবের।
নিহত রাজীবের বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। তিন ভাইয়ের সেই ছিলো সবার বড়। পড়ালেখার পাশাপাশি একটি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার টাইপ করে তার নিজের এবং ছোট দুই ভাইয়ের খরচ চালাতেন।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই। অন্যদশটি দিনের মতোই ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরতে রাজধানীর হোটেল র্যাডিসনের বিপরীত পাশের সড়কে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলো কয়েকজন শিক্ষার্থী । কিন্তু বিধি বাম! নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর বদলে মুখোমুখি হতে হয় ভয়াবহ দুর্ঘটনার। জিল্লুর রহমান উড়ালসড়কের ঢালের সামনের রাস্তার ওপর জাবালে নূর পরিবহনের তিনটি বাস রেষারেষি করতে গিয়ে একটি বাস রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপর উঠে পড়ে।
এতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীব ও একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম।
এ ঘটনায় আহত হন আরও ৯ জন।
এ ঘটনায় সারাদেশে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক চাই— আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিরা কিছুটা নড়েচড়ে বসেন। দুর্ঘটনা রোধে গ্রহণ করা হয় নানা পদক্ষেপ। তবে সাধারণ মানুষ মনে করছেন, কার্যত এসব পদক্ষেপ বড় ধরণের কোন প্রভাব ফেলতে পারছে না।
এর পরের বছরই খোদ রাজধানীতেই ‘ট্রাফিক শৃঙ্খলা সপ্তাহ’ চলার মধ্যে নর্দ্দা এলাকায় সুপ্রভাত বাসের চাপায় পিষ্ট হয়ে নিহত হন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী।
দেশের সড়কে প্রতিদিনই এমন অসংখ্য ট্রাজেডির জন্ম হচ্ছে। রাত পোহালেই বিয়ে, কিন্তু এর আগেই সড়কে প্রাণ গেল যুবকের। ছেলেকে মাইক্রোবাসে তুলে দিয়ে বাবা বাড়ি ফিরলেন লাশ হয়ে। মাকে দেখতে বিদেশ থেকে দেশে ফিরতে পারলেও বাড়িতে পৌঁছানোর রাস্তায় হয়ে গেল নিথর মৃতদেহ। প্রিয়জনের জানাজার নামাজ থেকে ফেরার দুর্ঘটনায় পথে নিজেই পরিণত হয়েছেন মৃতদেহে। সড়কে দায়িত্বপালনকারীদের প্রাণও ঝরছে সড়কেই। এমন অসংখ্য ট্র্যাজেডির সবিশেষ পরিসংখ্যান হলো—
গত পাঁচ বছরে দেশে ২৬ হাজার ৯০২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭ হাজার ১৭০ জন নিহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৮২ হাজার ৭৫৮ জন।
আজ বৃহস্পতিবার (২২ অক্টোবর) জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক বিবৃতিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৫ সালে ৬ হাজার ৫৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত ও ২১ হাজার ৮৫৫ জন আহত হয়েছে। ২০১৬ সালে ৪ হাজার ৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৫ জন নিহত ও ১৫ হাজার ৯১৪ জন আহত হয়েছে। ২০১৭ সালে ৪ হাজার ৯৭৯টি দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৩৯৭ জন নিহত ও ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত হয়েছে। ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জন নিহত ও ১৫ হাজার ৪৬৬ জন আহত হয়েছে এবং ২০১৯ সালে ৫ হাজার ৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮৫৫ জন নিহত এবং আহত হয়েছে ১৩ হাজার ৩৩০ জন।
এসব সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো এবং বিপদজনক ওভারটেক বেড়ে যাওয়ার কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়াও সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাস্তবায়নের পরও সড়কে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন লক্ষ্য করা যায়নি।
বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, ভাড়া নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি আগের মতোই আছে। ফলে যাত্রী ভোগান্তি, যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ রকম অসংখ্য মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা এখন স্বাভাবিক খবরে পরিণত হয়েছে।
যাত্রী অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক কেফায়েত শাকিল মনে করছেন, নিরাপদ সড়কের জন্য অনতিবিলম্বে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, সড়ক শৃঙ্খলার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত তাঁদেরকে আরো দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হতে হবে। সরকার বা সংশ্লিষ্ট প্রশাসন অন্যান্য বিষয়কে যেমন গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে আমার মনে হয় না সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণহানির ব্যাপারটির ক্ষেত্রে এতটা গুরত্ব প্রদান করছে। কিন্তু সরকারের উচিত সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সড়কে প্রাণহানির ব্যাপারটি কতটা ভয়াবহ অবস্থায় পরিণত হয়েছে তা নতুন করে বলার কিছু নেই।
জনসচেতনতা এবং প্রয়োজনীয় সরকারি বেসরকারি পদক্ষেপই এই মহামারীকে রুখে দিতে পারে বলে মনে করছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ( ডিএমপি) ট্রাফিক ইন্সপেক্টর সারোয়ার-ই-দ্বীন।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সাথে আলাপচারিতায় তিনি বলেন, আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা অধিকাংশই যোগাযোগের জন্য সড়ক পথের ওপর নির্ভরশীল। তাই এই পথের গুরুত্ব অনেক বেশি। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সবার সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টার পাশাপাশি আরও কিছু ব্যাপারে পরিবহন চালক, মালিক এবং সর্বোপরি সবাইকে সচেতন হতে হবে।
এক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় পরিবহন মালিক, চালক, শ্রমিক এবং যাত্রীদের মেনে চলা জরুরি। যেমন— ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন নিয়ে রাস্তায় না নামা, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে গাড়ি না দেওয়া, সড়কের ওপর অবৈধ হাটবাজার বন্ধ করা, সঠিক জায়গায় ফুট ওভার ব্রীজ নির্মাণ করা, বিকল্প রাস্তার ব্যবহার না করে এক লেনে চলার চেষ্টা করা, যখন-তখন রাস্তা খোঁড়াখুড়ি না করে ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা, রাস্তার মধ্যে প্রয়োজনীয় ডিভাইডার যথাস্থানে নির্মাণ করা, ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা, রাস্তার সংখ্যা বাড়ানো ও প্রয়োজনীয় ফ্লাইওভার তৈরি করা, রিকশার জন্য আলাদা লেন তৈরি এবং রাস্তাগুলো সংস্কার ও মেরামত কাজ দ্রুত শেষ করতে করা, এছাড়াও দূরপাল্লার গাড়ির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি না চালিয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, নিরাপদ সড়কের জন্যে যত পদক্ষেপই গ্রহণ করা হোক না কেন যতক্ষণ না আমরা সাধারণ মানুষজন সচেতন না হব ততদিন নিরাপদ সড়ক কেবল মিছে এক স্বপ্নের মতোই থাকবে। কারণ নিরাপদ সড়ক শুধু কথার কথা নয়, বরং সকলেরই অন্যতম একটি চাওয়া।