নূরকে নিয়ে আওয়ামী লীগের ‘অস্বস্তি’ কোথায়?

নুরুল হক নূর
নুরুল হক নূর  © ফাইল ফটো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রলীগের প্রার্থীকে হারিয়ে নুরুল হক নূর যখন ভিপি নির্বাচিত হন, তখন গণভবনে ডাকসুর সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সে অনুষ্ঠানে নিজেকে ছাত্রলীগের সাবেক ‘ছোটখাটো’ নেতা দাবি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করেন নুরুল হক নূর। সে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাবও ছিল বেশ ইতিবাচক।

কিন্তু এরপর থেকেই ভিন্ন আরেক পরিস্থিতির তৈরি হতে থাকে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক হামলার শিকার হন নুরুল হক নূর।প্রতিটি হামালার ক্ষেত্রেই অভিযোগ আসে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। যদিও সংগঠনের তরফ থেকে বারবার সেটি অস্বীকার করা হয়েছে।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের কর্মীদের দ্বারা যে ব্যক্তিটি সবচেয়ে বেশি হামলার শিকার হয়েছেন তিনি হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হক নূর। এসব হামলার কোন বিচার হয়নি, এমনকি পুলিশ কোন অভিযোগ গ্রহণ করতেও রাজী হয়নি।

কিন্তু এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ব্যতিক্রম। গত ২২শে ডিসেম্বর ডাকসু ভবনের ভেতরে নূর এবং তার অনুসারীদের উপর হামলার পর বিভিন্ন মহল থেকে তার প্রতি সহানুভূতি এবং হামলার প্রতিবাদ জানানো হয়।

তার পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নূরের প্রতি সমর্থন জানিয়ে অনেকে মত প্রকাশ করেছেন। এমন অবস্থায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা নূরের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছেন এবং পুলিশ একটি মামলাও দায়ের করেছে।

ভিপি নূর ও ক্ষমতাসীনদের অস্বস্তি
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা আসার পর থেকে আন্দোলনের মুখে সরকারের কাছ থেকে কোন দাবি আদায় করার নজির নেই। বিরোধী দলগুলোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি এবং মানবতা-বিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে আন্দোলন বেশ ভালো ভাবেই সামাল দিয়েছে ক্ষমতাসীনরা।

সে হিসেবে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ব্যতিক্রম। কোটা ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরকার সে দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ক্ষমতাসীনরা ভালোভাবে মেনে নেয়নি। নূরকে নিয়ে ক্ষমতাসীনদের আরেকটি অস্বস্তির জায়গা হচ্ছে ডাকসু নির্বাচনে তার কাছে ছাত্রলীগ প্রার্থীর পরাজয়।

ছাত্রলীগের একাধিপত্যের প্রতি ‘চ্যালেঞ্জ’ নূর
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কার্যত কোন বিরোধী ছাত্র সংগঠন নেই। অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কার্যত নিষ্ক্রিয় কিংবা অনেকের ভাষায় 'অস্তিত্বহীন।

এমন প্রেক্ষাপটে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের একচ্ছত্র আধিপত্যের প্রতি নুরুল হক নূর কার্যত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন।

কোটা সংস্কার আন্দোলন সফল হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে 'গেস্ট-রুম' 'গণ-রুম' এবং ছাত্রলীগ নেতাদের সালাম দিয়ে চলার যে সংস্কৃতি ছিল সেটি অনেকটা কমে এসেছে।

‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভয়ের পরিবেশ ছিল, সেটি অনেকটা কমে আসছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন মনে করছে যে এভাবে চলতে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। এ কারণে তারা নূরকে মাঠ থেকে সরিয়ে দিতে চায়,’’ - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছিলেন একথা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের কর্তৃত্ব না থাকে তাহলে সেটি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছড়িয়ে যেতে পারে - এমন আশংকা থেকেই নূরকে নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের এক ধরণের অস্বস্তি কাজ করে বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষার্থীটি বলছিলেন।

ভিপি নূর ও বিরোধীদের তৎপরতা
বাংলাদেশে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা যখন রাজনীতির মাঠে গরহাজির - তখন নুরুল হক নূর ক্রমাগত হামলার শিকার হয়েও জায়গা ছেড়ে দেননি। উল্টো তিনি ছাত্রলীগের সমালোচনায় মুখর। এ বিষয়টি তার জন্য একটি ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে বলে মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।

নূরের উপর হামলার পর যারা প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন তাদের মধ্যে সরকার বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও রয়েছে।নূরকে যারা সমর্থন করছেন, তাদের অনেকেই তাকে ‘সরকারবিরোধী মতের প্রতীক’ হিসেবে বর্ণনা করছেন।

রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘‘যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে কেউ তেমন সক্রিয় হতে পারছে না, বা সক্রিয় হবার মতো সক্ষমতা তাদের নেই, এখন নূরকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ বিরোধিতা দানা বাঁধছে।’’

আওয়ামী লীগ কী বলছে?
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা মি: নূরকে রাজনৈতিকভাবে তেমন একটা গুরুত্ব দিতে চাইছেন না। তাদের ভাষায় রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সামনে ভিপি নূর কোন দূরতম কোন প্রতিপক্ষও নয়।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুবুল আলম বলেন, ‘‘এটা একবারেই হাস্যকর ছাড়া আর কিছু নয়। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। আওয়ামী লীগ অনেক বড়-বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে।’’

‘‘সেই আওয়ামী লীগ কোন একটা ছাত্র নেতার জন্য অস্বস্তি বোধ করবে, এই ধরণের যারা চিন্তা করে তাদের প্রতি করুণা ছাড়া করার আর কিছু থাকেনা’’- বলেন তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ