সাত বছরেও কান্না থামেনি, করোনায় গার্মেন্টস খোলার সিদ্ধান্তে নতুন আতঙ্ক

  © ফাইল ফটো

আজ ২৪ এপ্রিল। ২০১৩ সালের এই দিনে ঢাকার অদূরে সাভার বাস স্ট্যান্ডের পাশে ধসে পড়ে রানা প্লাজা নামক ৯ তলা বিশিষ্ট একটি বহুতল ভবন।  দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত মাটির নিচে দেবে যায়। মুহূর্তের মধ্যেই ধসা পড়া ভবনের ভেতর থেকে ভেসে আসে আত্মচিৎকার, আটকে পড়া আহত মানবের বাঁচার আকুতি। প্রকম্পিত হয়ে উঠে গোটা সাভারের আকাশ-বাতাস। এরপর একের পর এক বের হতে থাকে নিস্তেজ মরদেহ। দুর্ঘটনায় মোট মারা যান এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক, আহত হন ২৫০০ শ’রও বেশি। অন্যদিকে ৯৯৬ জনের কোন খোঁজই মেলেনি।

এ বছর ২৪ এপ্রিল এমন এক সময়ে হাজির; যখন গোটা বিশ্ব তো বটেই, বাংলাদেশেও নোভেল করোনার দাপট চলছে। আর এর মধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে গার্মেন্টসসহ সব কলকারখানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যদিও সেখানে দুটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি-৪ শাখা থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনের ২ (ঙ) নং শর্তে বলা হয়েছে, ‘ঔষধশিল্প, উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী শিল্পসহ সকল কলকারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করে চালু রাখতে পারবে।’ জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুনও বলেছেন, ‘হ্যাঁ, সরকার শর্ত সাপেক্ষে সকল কলকারখানা খোলার সুযোগ দিয়েছে।’ তবে কবে তা খুলবে, সেটা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। এর আগে আরেকদফায় গার্মেন্ট খোলার নোটিস জারি করেছিল বিজিএমইএ।

জানা যায়, রানা প্লাজার দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনা। শুধু তাই নয় এটিকে পৃথিবীর ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা বলা হয়। পৃথিবীতে ভবন ধসে এত এত মৃত্যুর ঘটনা আর একটিও নেই। তবে রানা প্লাজা ধসের ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলা হলেও শ্রমিক নেতারা এ ঘটনাকে কোনভাবেই দুর্ঘটনা বলতে রাজি নন। তাদের মতে ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও শ্রমিকদের কাজে যোগদান করতে বাধ্য করা নিছক কোন দুর্ঘটনা হতে পারে না, এটা হত্যাকাণ্ড। মালিক শ্রেণীর অতিরিক্ত মুনাফার লোভ, পুঁজির পাহাড় গড়ার প্রতিযোগিতা এ হত্যাকাণ্ডের জন্ম দিয়েছে।

প্রতিবছর ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের ১ বছর উপলক্ষে শ্রমিকদের স্মরণে নির্মাণ করা বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে শ্রমিক পরিবার এবং বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। কিন্তু তাতে কি আর শ্রমিকের রক্তের দাগ শুকাতে পারে?

জানা যায়, ভবনটির ভূগর্ভস্থ স্থানে গাড়ীর গ্যারেজ ছিল, নিচতলায় ব্যাংক-বীমার অফিস, ২য় তলায় বিপণী কেন্দ্র যেখানে ২৭০টির মতো দোকান ছিল, ৩য়-৯ম তলায় পর্যন্ত মোট পাঁচটি পোশাক কারখানা ছিল যেখানে পাঁচ হাজারের মতো শ্রমিক কাজ করতেন। ঘটনার আগের দিন ৩য় তলার নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের একটি গার্ডলে ফাটল ধরলে আতঙ্কিত হয়ে শ্রমিকরা ছোটাছুটি করার ফলে সঙ্গে সঙ্গে গোটা ভবনটির লোকজনদের নিরাপদে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এর পরের দিন গার্মেন্টস মালিক এবং রানা প্লাজার মালিক, স্থানীয় প্রভাবশালী যুবলীগ নেতা সোহেল রানাসহ কিছু প্রভাবশালী লোকের হুমকিতে ফাটল ধরা ভবনে শ্রমিকেরা কাজে যেতে বাধ্য হয়।

ভবনটি বিল্ডিং কোড না মেনেই ডোবার মধ্যে অবৈধভাবে তৈরি করেন যুবলীগ নেতা সোহেল রানা এবং ফাটল ধরা ভবনে জোর করে শ্রমিকদের কাজে যোগদানেও বাধ্য করেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। যার জন্য এই দুর্ঘটনায় মূল হোতা হিসেবে সোহেল রানার নাম উঠে আসে।

ঘটনার সাত বছর পার হতে চলেছে এখনো সোহেল রানার কোন বিচারিক কার্য সম্পন্ন হয়নি। ঘটনার ৫ দিন পরে ২৯ এপ্রিল যশোরের বেনাপোল বন্দর থেকে সোহেল রানাকে র‌্যাব আটক করে নিয়ে এসে জেল হাজতে রাখলেও আদতে এর বিচার কার্যের সুরাহা হয়নি। ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ৪১ জনকে মামলায় জড়ালেও বাকি আসামিদের কোন খোঁজই নেই। ঘটনার পরপরই সাভার মডেল থানার পুলিশ একটি মামলা করে এবং এই মামলাটিই বর্তমানে চলমান। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক এবং বিভিন্ন সংগঠন আরো ৫টির মতো মামলা করলেও বিচারিক কাজ শুধু ঐ একটি মামলারই সেটাও ঢিলেঢালা।

এদিকে, মামলার বিচার না পাওয়া শ্রমিক পরিবার ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের কান্না-আহাজারি সাত বছরেও থামেনি। ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক পরিবার তার প্রিয় মানুষের লাশটি এখনো খুঁজে বেড়ায়। এখনো বুকভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সহকর্মীর স্মৃতিচারণ করতে আসে বহু পঙ্গু শ্রমিক। তাদের হৃদয়ে দগ্ধ ক্ষত কখনোই যেন শুকাবার নই। মনের ভিতের পোড়া স্মৃতির সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ আর অনিশ্চিত জীবনের টানা-পোড়নে ভূগছে বহু পঙ্গু,অসহায় শ্রমিক এবং নিখোঁজ স্বজনের আত্মীয়রা। সরকারের দেওয়া ক্ষতিপূরণ পায়নি বহু পরিবার, আবার বহু পরিবারের সন্তানের লাশ সনাক্ত না হওয়ায় ক্ষতিপূরণের আওয়াতায়ও আসতে পারেনি।

আয়েশা আক্তার (২৬) নিউ ওয়েভ স্টাইল লিমিটেডে অপারেটরের কাজ করতেন। ঘটনার দিন তিনিও চাপা পড়েন বিশাল অট্টালিকায় ধ্বংসস্তুপে। দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা পর সন্ধ্যার দিকে তাকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরতে পারেননি। দুর্ঘটনায় তার একটি পা হারতে হয়েছে। সকাল আর সন্ধ্যা তার জীবনের দুটি অধ্যায়ে মোড় নিয়েছে। তার টাকায় পরিবারের খরচ চলতো কোনভাবে কিন্তু পা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন তিনি। সরকারের কিছু ক্ষতিপূরণ মিললেও জীবনের প্রয়োজন ফুরোয়নি।আজও দ্বারে দ্বারে চাকরির খোঁজে ছুটে বেড়ান। কিন্তু চাকরি আর মেলে না।

রানা প্লাজার অপর একটি পোশাক কারখানায় হেলপারের কাজ করতেন শ্রাবণ আহমেদ জাহাঙ্গীর। দুর্ঘটনায় মারাত্মক ভাবে জখম হন তিনি। আজও চাইলেও যেকোন কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। যেখানে ৮ হাজার টাকার বেতনের চাকরি দিয়ে কোনভাবে সংসার চলতো সেখানে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পিয়নের কাজ করে ৬ হাজার টাকায় মানবেতর দিন কাটাতে হচ্ছে তাকে। ৭ বছর আগে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা তাকে নীরবে কাঁদায়, বয়ে বেড়াতে হচ্ছে অভিশপ্ত জীবন। গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠনের দেওয়া তিন হাজার ৪০০ জনের তালিকায় নেই জাহাঙ্গীরের নাম।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যেখানে ৫ হাজার শ্রমিকের ক্ষেত্রে কেবল ৩ হাজার ৪০০ জনের হিসাব দিয়েছিল বিজিএমইএ। যাদের মধ্যেও বহু শ্রমিক তাদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পায়নি। ক্ষতিপূরণ পাওয়া বহু শ্রমিক স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্তের অর্থ দিয়ে জীবনও বয়ে নিয়ে যেতে পারছে না।

বেসরকারি সংস্থা একশন এইড বাংলাদেশ বলছে, তারা এরকম ১৪০০ জনের খবর পেয়েছে যারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। পুরুষের অনেকেই রিক্সা, ভ্যান চালক কিংবা দিনমজুর এবং মহিলারা গৃহ শ্রমিকের কাজ করছেন। বাকিদের অবস্থা যে কতটা করুণ, তা কেবল হয়তো সৃষ্টিকর্তাই বলতে পারেন।

রানা প্লাজা ধসের সাত বছর হয়ে গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ভয়াবহ অভিশপ্ত জীবনের কাছে প্রতিটা দিনই ভয়াবহ, দুর্ধর্ষ রকমের ভয়ংকর, তাদের জীবনে সময়টা যত পার হচ্ছে তত কষ্টের তীব্র যন্ত্রণার দিন বেড়েই যেতে চলেছে। প্রতি মুহূর্তে তাদের জীবনটা শেষ হওয়ার অপেক্ষার প্রহর গুনছে।

বর্তমানে করোনায় যেখানে প্রতিটি জীবনের জন্য আপ্রাণ লড়াই করছে পুরো দেশবাসী সেখানে ঝরে যাওয়া ও বেঁচে ও মরার চেয়ে তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করা শ্রমিকদের কষ্ট কখনো মেনে নেওয়ার নয়। দুর্ঘটনার মূল হোতা সোহেল রানার ফাঁসি ও ৪১ আসামীর মধ্যে মারা যাওয়া দুজন আসামী বাদে বাকী ৩৯ আসামির উপযুক্ত বিচার সহ প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের বাঁচার মতো ক্ষতিপূরণসহ কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রতিবছরই জোরালো দাবি তোলেন শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতারা। যদিও তার অনেকটাই ৭ বছর পরও আজ অপূর্ণ।


সর্বশেষ সংবাদ