অস্তিত্ব সংকটে পাবনার বড়াল নদী
- ভাঙ্গুড়া প্রতিনিধি, পাবনা
- প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪:০৪ PM , আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪:৩৬ PM
একসময় উত্তরাঞ্চলের প্রাণ হিসেবে বিবেচিত বড়াল নদী আজ দখল, দূষণ এবং অযত্নের কবলে পড়ে মৃতপ্রায়। নদীমাতৃক বাংলাদেশের এই নদী শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, হাজারো মানুষের জীবন-জীবিকার অন্যতম উৎস ছিল। অথচ প্রভাবশালীদের অবৈধ দখল, দূষণের চরম অবস্থা এবং সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বড়াল আজ অস্তিত্ব সংকটে। বৃহত্তর চলনবিল এলাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই নদীর বর্তমান অবস্থাকে কাহিল বললেও কম বলা হবে। একদিকে ময়লা-আবর্জনায় নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে, অন্যদিকে তীর দখল করে গড়ে উঠছে স্থাপনা—সব মিলিয়ে নদীটি যেন মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
বড়াল নদী গঙ্গার শাখা নদী, এটি রাজশাহী জেলার চারঘাট থেকে উৎপন্ন হয়ে নাটোর ও পাবনা অতিক্রম করে শাহজাদপুরে করতোয়ার সঙ্গে মিলিত হয়ে হুরাসাগরে পড়েছে। প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই নদী চলনবিলসহ উত্তরাঞ্চলের ২০টি উপজেলায় প্রত্যক্ষ প্রভাব রাখে। দেশের বৃহত্তম পদ্মা ও যমুনা নদীর মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী বড়াল নদী স্থানীয় কৃষি, মাছ চাষ এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বড়াল নদী দখলে
বড়াল নদীর গড় দৈর্ঘ্য ১৫০ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১২৫ মিটার এবং গড় গভীরতা প্রায় ৬ মিটার। নদীটি বর্ষা মৌসুমে গঙ্গা থেকে প্রবাহ লাভ করলেও অন্যান্য সময়ে চলনবিলসহ স্থানীয় নিম্নাঞ্চল থেকে পানি প্রবাহিত হয়ে থাকে। রাজশাহী জেলার চারঘাট, বাগতিপাড়া, বড়ইগ্রাম, নাটোর, গুরুদাসপুর, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া এবং বেড়া নদীর তীরে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
কিন্তু এই নদীটির পাড়ে ক্রমাগত বাড়িঘর, সরকারি-বেসরকারি অফিস নির্মাণ, হাউজিং প্লট তৈরি করেছেন প্রভাবশালীরা। নদীর ওপর বাঁধ, স্লুইসগেট, ক্রসবাঁধ নির্মাণের কারণে এর প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। অপরদিকে, নদী তীরবর্তী শহরগুলোর পোলট্রি ফার্ম, হাসপাতাল, ক্লিনিক, হোটেল, কলকারখানা এবং বসত-বাড়ির বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশন নদীকে দূষিত করে ফেলেছে।
এখনো বড়াল নদীর সঙ্গে যুক্ত ছিল বড়াল, নন্দকুজা, চিকনাই, গুমানীসহ বেশ কয়েকটি নদী এবং নদী-তীরবর্তী প্রায় ৫০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা। বড়াল নদী চলনবিল অঞ্চলসহ আরো ২০টি উপজেলায় এর প্রভাব বিস্তার করেছে। দেশের বৃহত্তম দুটি নদী, পদ্মা ও যমুনা, এবং বৃহৎ জলাভূমি চলনবিলের মধ্যে প্রধান সংযোগ রক্ষাকারী এই নদী। এর সাথে প্রায় শতাধিক খাল সংযুক্ত, যার কারণে বড়ালের প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে, চলনবিলের অধিকাংশ বড় নদ-নদীতে নাব্য সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বড়াল নদী ঘিরে এই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা ছিল অত্যন্ত সুখী ও সমৃদ্ধ। তবে প্রভাবশালীদের অবৈধ দখল, অট্টালিকা নির্মাণ ও দূষণের কারণে বড়াল মরে যাচ্ছে, আর তা সেখানকার নৈর্সগিক চেতনাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
ঘটনার বিষয়ে ভাঙ্গুড়া টেকনিক্যাল এন্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের অধ্যক্ষ মো. বদরুল আলম বলেন, নদীতে ময়লা ফেলা এবং অবৈধভাবে দখল কোনভাবেই কাম্য নয়। এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণও করেন তিনি।
এ ব্যাপারে নদী রক্ষা কমিটির ভাঙ্গুড়া উপজেলার সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছা. নাজমুন নাহার বলেন, নদীতে ময়লা ফেলা প্রতিরোধে পৌর এলাকার কয়েকটি পয়েন্টে সাইনবোর্ড দিয়ে জনগণকে সচেতন এর পাশাপাশি ডাস্টবিন স্থাপন করা হয়েছে। নতুন করে কেউ যেন নদী দখল করে ভবন নির্মাণ করতে না পারে সে বিষয়ে প্রশাসনের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে।
এদিকে, নদী রক্ষার জন্য ২০০৮ সালের ২ আগস্ট গঠিত হয় 'বড়াল রক্ষা আন্দোলন' কমিটি। তাদের উদ্যোগে বড়াল নদীর ওপর নির্মিত নুরনগর, দহপাড়া, চাটমোহর নতুন বাজার, বোথড় ও রামনগর ক্রশ বাঁধ অপসারণ করা হয়েছে। এই আন্দোলনকারীরা দাবি জানিয়েছেন, বড়াল নদীকে পদ্মা ও যমুনার মতো ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় আনা হোক এবং নদীর পাড়ে অবৈধ দখল নির্মিত ভবন ও অট্টালিকা উচ্ছেদ করে নদীটির প্রাণ ফিরিয়ে আনা হোক।
এখনই সময়, বড়াল নদী রক্ষায় ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া না হলে এই প্রাকৃতিক সম্পদটি চিরতরে হারিয়ে যাবে।