শিক্ষা সংস্কার কমিশনের দাবি, উদ্যোগ নেই অন্তবর্তীকালীন সরকারের
- আহমেদ ইউসুফ
- প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৮ PM , আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩২ PM
জুলাই আগস্টের আন্দোলনের পর নতুন বাংলাদেশ গড়ার আলাপ আসে সব মহলে। ঘুণে ধরা বাংলাদেশকে নতুন করে গড়তে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে সরকার। বেশ কয়েকটি কমিশন ইতোমধ্যে সংস্কারের রূপরেখাও দিয়েছে। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্র সংস্কারে মোট দশটি কমিশন গঠন করা হলেও জুলাই আগস্টের আন্দোলনের সূত্রপাত হওয়া শিক্ষাখাতে সংস্কারে কোনো কমিশন কিংবা উদ্যোগ দেখা যায়নি অন্তবর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে।
বিভিন্ন স্তরের বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বললেও সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই বলে জানা গেছে। সরকারের উচ্চ মহলের ব্যক্তিরা জানান, সংস্কারের যে পরিধি হওয়া উচিত তার পর্যাপ্ত সুযোগ পাচ্ছে না সরকার। এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগও নেই। তবে সংস্কারের বিষয়ে সরকারের এমন অবস্থানকে মানতে পারছেন না শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এমন পর্যাপ্ত সুযোগ পাওয়ার পরও শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গনে সংস্কার না হওয়া দুঃখজনক।
‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কাজের জন্য গঠিত হয়। তবে বর্তমানে তারা যেমন কাজ করছেন, যে-সব মন্তব্য করছেন, তাতে লোকের মনে নানা সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। তবে শিক্ষার সংস্কার সবার আগে জরুরি— অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, সভাপতি, বাংলা একাডেমি
মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শিক্ষা খাতের সংস্কারে সরকারের কোনো উদ্যোগ না থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। তিনি বলেন, অবাক হয়ে লক্ষ করছি, সরকার প্রচুর কমিশন গঠন করেছে, কিন্তু শিক্ষা কমিশন করেনি। অধ্যাপক আজম আরও বলেন, শিক্ষার গুণগত সংস্কার করতে হবে। শিক্ষার সংস্কার খুবই জরুরি ছিল। সরকার যেকোনো কারণে হোক, এখনো এটা করেনি। কিন্তু করতে হবে। কারণ, (শিক্ষার মানোন্নয়নে) এটাই একমাত্র উপায়।
ড. শেখ আব্দুর রশীদ, ড. শেখ আব্দুর রশীদ, মন্ত্রিপরিষদ সচিব
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে শিক্ষাব্যবস্থা চলমান রয়েছে এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বৈশ্বিক নাগরিক হয়ে উঠতে পারছে না। দেশের প্রাইমারি থেকে উচ্চশিক্ষার সব স্তরে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ ও প্রায়োগিক শিক্ষার অভাব প্রকট হওয়ায় বৈশ্বিক সূচকে আমাদের উচ্চশিক্ষালয়গুলো নিজেদের অবস্থান দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে। যদিও প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান প্রতিবছর তাদের শিক্ষাঙ্গনকে বৈশ্বিক সূচকে রাখতে পারছে।
শিক্ষা সংস্কার কমিশন নিয়ে এখনও কোনো উদ্যোগ নেই। তবে আমরা পূর্বের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এ ধরনের সংস্কারের জন্য লম্বা সময়ের প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকার এত লম্বা সময় থাকার বিষয়ে শঙ্কা দেখা যাচ্ছে— ড. শেখ আব্দুর রশীদ, সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ
এছাড়াও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার একাডেমিয়ার সাথে ইন্ডাস্ট্রির সম্পর্ক কম থাকায় বছর বছর গ্র্যাজুয়েট বৃদ্ধি পেলেও সেক্টরভিত্তিক দক্ষতার ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। আবার দক্ষতার ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের ফলে তাদের মাধ্যমে দেশের উল্লেখযোগ্য অর্থ বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। তবে জুলাই আগস্টের অভ্যুত্থানের সাড়ে চার মাস পরও শিক্ষা সংস্কারে নিরুদ্যোগ দেখা গেছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। বিষয়টিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
শিক্ষা সংস্কারে কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক নেতারাও। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান সম্প্রতি কথা বলেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, শিক্ষা সংস্কারের জন্যও একটি কমিশন থাকলে ভালো হতো। একটা নিরপেক্ষ জায়গা থেকে এই সংস্কার করা উচিত। শিক্ষা উপদেষ্টা একজন দক্ষ ও প্রজ্ঞাবান অর্থনীতিবিদ এবং সকলের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য ও সৎ মানুষ। আমি মনে করি তিনি শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্য যে উদ্যোগ নেবেন তা যেমন শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেবে তেমনি সার্বিকভাবে এ দেশকে এগিয়ে নিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
শিক্ষা সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ জানান, শিক্ষা সংস্কার কমিশন নিয়ে এখনও কোনো উদ্যোগ নেই। তবে আমরা পূর্বের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এ ধরনের সংস্কারের জন্য লম্বা সময়ের প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকার এত লম্বা সময় থাকার বিষয়ে শঙ্কা দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সেটা এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। কাজেই শিক্ষার সংস্কার বাস্তবায়নের অন্তর্বর্তী সরকার এত লম্বা সময় পাবে কি না সেটাই এখন কনফিউশন সৃষ্টি করছে। বিষয়টি উপদেষ্টা পরিষদ ভালো জানবে।
আরও পড়ুন: সেক্টরভিত্তিক দক্ষ গ্রাজুয়েট না থাকায় বাড়ছে বেকারত্বের ফাঁদ
তবে এ প্রসঙ্গে কথা বলতে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার মতামত পাওয়া যায়নি।
বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, জাতি গঠনের জন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা উচ্চশিক্ষা সব জায়গায় শিক্ষা কাঠামোর আমূল পরিবর্তন আসা জরুরি। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো সরকার আন্তরিকতার সাথে সংস্কার করেনি। বরং প্রতিটি সংস্কার কমিশনের ফলাফল একটা থেকে আরেকটা আরো খারাপের দিকে গিয়েছে।
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, সভাপতি, বাংলা একাডেমি
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো মানুষকে মানসম্মত শিক্ষা দিতে চায় না। কারণ, সঠিক শিক্ষা পেলে মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চায়। তাতে রাজনীতিবীদদের স্বার্থ হাসিলের পথ রুদ্ধ হয়। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ সেক্টরে কাজ করার কথা থাকলেও তারা সেটা করতে পারছে না। আমার মনে হয় সমালোচনা করা যত সহজ, কাজ করা তত সহজ নয়। এটা তারই প্রতিফলন।
আরও পড়ুন: শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের জন্যও একটি কমিশন গঠনের প্রয়োজন ছিল
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় স্বল্পতার দিকে ইঙ্গিত করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, দীর্ঘস্থায়ী সংস্কার করতে হলে নির্বাচিত সরকারকে দায়িত্ব নিতে হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কাজের জন্য গঠিত হয়। তবে বর্তমানে তারা যেমন কাজ করছেন, যে-সব মন্তব্য করছেন, তাতে লোকের মনে নানা সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। তবে শিক্ষার সংস্কার সবার আগে জরুরি।
শিক্ষা সংস্কার কমিশনের রূপরেখা প্রসঙ্গে এই অধ্যাপক বলেন, যারা দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে কাজ করছেন, অবদান রাখছেন, তাদের নিয়ে কমিশন গঠন করা যেতে পারে। যে-সব গুণী অধ্যাপকরা আছেন তাদের পরামর্শে জরুরি ভিত্তিতে এই সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া উচিত। এর বাইরে কিছু লোক আছেন যারা আগেরও শিক্ষার সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কমিশনে তাদের অন্তর্ভুক্ত রাখার প্রয়োজন আছে।