গণঅভ্যুত্থানে শহীদের কথা
অর্থাভাবে পড়েননি ভালো কলেজে, ভাইকে পড়ানোর ইচ্ছা ছিল শহীদ বিশালের
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:০৫ PM , আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:১৯ PM
সংসারে টাকা-পয়সার অভাবে ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারেননি বিশাল। শেষ পর্যন্ত বিএমআই কলেজে ভর্তি হয়েছেন তিনি। আশা ছিল টেকনিক্যাল পাশ করে বিদেশ যাবেন। নিজে সরকারি চাকুরি করতে না পারলেও ছোট ভাইকে দিয়ে সে আশা পূরণ করে সংসারের হাল ধরবেন দুই ভাই মিলে। বাবা-মা’র কষ্ট লাঘব করবেন। কিন্তু সে আশা আর পূরণ হয়নি তার। ঘাতক বুলেট কেড়ে নিয়েছে তার সে স্বপ্ন।
গত ৪ আগষ্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় গুলিতে নিহত হন উত্তরাঞ্চলের ছোট্ট জেলা শহর জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার রতনপুর গ্রামের দ্বাদশ শ্রেনীর ছাত্র মোঃ নজিবুল সরকার বিশাল (১৯)। নিহত হবার পর এখন তার পরিবার অসহায়ত্বের ছাপ বুকে নিয়ে দিন পার করছে।
জেলার পাঁচবিবি উপজেলার রতনপুর গ্রামের দরিদ্র টিউবওয়েল মিস্ত্রি মজিদুল সরকার ও গৃহিণী বুলবুলি খাতুনের দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে নজিবুল সরকার বিশাল ও ছোট ছেলে মুমিন সরকার। তাদের নিয়ে সুখেই কাটছিল জীবন। বড় ছেলে বিশাল এসএসসি পাশ করার পর অভাবের কারণে ভাল কোন কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। তিনি পাঁচবিবি বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউটে ভর্তি হন।
বিশাল বাড়িতে বলতেন, আমি ম্যানেজমেন্ট থেকে পাশ করে দেশের বাইরে যাবো। বিদেশে গিয়ে অর্থ উর্পাজন করে ছোট ভাইকে ভালভাবে ভাল কলেজে লেখাপড়া করাবো। তাহলে সে একদিন সরকারি কোন চাকরি পাবে। তখন আমাদের দুই ভাইয়ের উর্পাজনে সংসার ভাল চলবে।বাবা-মা’ওসুখী হবেন। কিন্তু অঙ্কুরেই সেই আশা নষ্ট হয়ে গেল বিশালের। বিশাল এবছর বিএমআই কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। তিন বিষয়ে পরীক্ষাও দিয়েছিলেন তিনি।
ছোটভাই মুমিন সরকার রতনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেণীতে পড়ে। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলের কফিন মাথায় নিয়ে কবরস্থ করার যে কি বেদনা তা একমাত্র মজিদুলের মত বাবারাই জানেন।
এ ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার জন্য বিশালের বাড়িতে গেলে তার বাবা মজিদুল সরকার (৪৩) বাসস’কে বলেন, বিশাল বিএমআই কলেজে পড়তো। তিনটা পরীক্ষা দিয়েছে। ইতোমধ্যে ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরু হলে তার পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। সে মাঝে মাঝে পাঁচবিবিতে যেত আবার আসতো। বিশালের শরীর একটু মোটা ছিল, তাই তার শরীরের চামড়া অনেক সময় ফেটে ফেটে যেত। সে প্রায়ই গায়ে মলম লাগাতো। তবে কখনও আমরা জানতে পারিনি যে বিশাল আন্দোলনে অংশ নিত।
গত ৪ আগষ্ট রবিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিশাল বাসায় বলে, আমি একটু ঔষধ নেওয়ার জন্য বাজারে যাচ্ছি। এটাই পরিবারের সাথে তার শেষ কথা।
এরপর বেলা ১২ টার দিকে বিশালের পরিচিত একজনের মোবাইল ফোন থেকে তার বাবার কাছে ফোন আসে। জানায় বিশালের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর।
তিনি বলেন, তারা আমাকে জানায়, বিশালকে জয়পুরহাট ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ খবর পাওয়ার পর আমি আকাশ থেকে পড়ে যাই। পরে পরিবারের সকলকে জানিয়ে আমরা জয়পুরহাট হাসপাতালে যাই। হাসপাতালে গিয়ে দেখি বিশালের বুকের ডান দিকে হাতের বগলের নীচ দিয়ে একটি গুলি ঢুকে বাম দিকে পিঠের পিছন দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এরপর প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ডাক্তার বলে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে পাঠাতে হবে। তখন ছাড়পত্র দিয়ে বিশালকে অ্যাম্বুলেন্সে করে বগুড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য রওনা হই। আমরা বগুড়ায় যাবার পথে কালাই উপজেলা অতিক্রম করার সময় বিশাল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। আমরা বিশালের কোন সাড়া না পেয়ে কালাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর তাকে নিয়ে আমরা চলে আসি। তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনায় লাশ পোষ্টমর্টেম না করেই তাকে আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে এশার নামাজের পর দাফন করি। আমার বাড়ির পশ্চিম পার্শ্বে আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে আমার ছেলে শহিদ বিশাল চিরনিদ্রায় শায়িত আছে।’
শহিদ বিশালের মা বুলবুলি খাতুনের (৪০) সাথে কথা বললে তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বাসস’কে বলেন, ‘আমার বাবা আর নেই, এটা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।
আমার ছেলে বিশাল দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দিয়ে শহিদ হয়েছে। আমরা চাই আর যেন কোন মাকে তার বুক খালি করতে না হয়। আর যেন কোন মাকে নাড়ী ছেঁড়া ধন হারাতে না হয়। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে যেন দেশ পরিচালনা করা হয়। সুস্থ ও সুন্দর, বৈষম্যহীনভাবে দেশ পরিচালিত হলে বিশাল সহ যত ছেলে-মেয়ে জীবন দিয়েছে তাদের আত্মা শান্তি পাবে।’
তাদের অভাবের সংসারে ৫ শতাংশ জমি পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ও ৫ শতাংশ জমি পরে কিনে নেওয়া। এই জমিতেই বিশালের পরিবার বেড়া দিয়ে তৈরি ঘরে বসবাস করে। বিশালের মা বাসায় হাঁস-মুরগি পালন করেন। কয়েকটি ছাগলও পালন করেন তিনি। স্বামী টিউবওয়েলের মিস্ত্রীর কাজে যা পান তা আর তার নিজের পরিশ্রমে সংসার কোন রকমে চলে। এক ছেলে শহিদ হলেও অপর ছেলে আছে। তাকে নিয়েই বাকি সারাটা জীবন কাটাতে চান তিনি।
বিশালের বাবা জানান, গত ৫ তারিখে সরকার পরিবর্তনের পর হতে তাদের কাছে অনেকেই এসেছেন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি’র পক্ষ হতে তাদেরকে ৩ লাখ টাকা সহায়তা দেয়া হয়েছে। জেলা জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তাদেরকে ২ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া বিএমআই কলেজ, বিদ্যালয়ের পক্ষ হতে কিছু সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। জেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দ তাদের সাথে দেখা করে তাদের বাড়িঘর মেরামত করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।
পরিবারের সকলের দাবি, সরকার যেন বিশালের মত যারা নিহত হয়েছেন তাদের সকলকে শহিদের মর্যাদা দেয়। দেশে যেন আর কখনও বিশালের মত কাউকে জীবন দিতে না হয়। তাহলেই দেশে শান্তি আসবে। জনগণ শান্তি পাবে। আমাদের এই বাংলাদেশ সোনার বাংলায় পরিণত হবে।